কারবালা; শব্দটি শুনলেই মনটা আচমকা কেঁদে ওঠে। ইসলামী ইতিহাসের লোমহর্ষক ট্রাজেডি বুকে ধারণ করে ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে প্রতি বছর পৃথিবীবাসীর দুয়ারে এসে হাজির হয় ‘কারবালা’ । এই সেই ‘কারবালা’ যার মূলে রয়েছে এক ফোয়ারা রক্তের করুণ ইতিবৃত্ত। প্রিয়জনকে হারাবার অসহনীয় ব্যথা,অসহনীয় যন্ত্রণা,করুণ আর্তনাদ । যে স্থানে মহানবী (স.) এর প্রিয় দৌহিত্র, আলী ও ফাতেমা (আলাইহিমাস সালাম) এর কনিষ্ঠ সন্তান এবং ইমাম হাসান (আ.) এর প্রাণপ্রিয় ভ্রাতা ইমাম হুসাইন (আ.) ৬১ হিজরীতে শহীদ হয়েছিলেন সে স্থানের নাম ‘কারবালা’।
নিষ্পাপ শিশু জয়নুল আবেদীনের কোমল দেহ থেকে প্রবাহিত খুনের বারিধারা। আহলে বায়াতের পূঁত-পবিত্র রমণীদের করুণ আর্তনাদ। পিপাসায় কাতর নিরপরাধ শিশুদের কলিজাফাটা চিৎকার। অপরদিকে ইয়াজিদ-শিমার-যিয়াদদের অট্টহাসি, ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা। আর মজলুমের খুনে হাত রঞ্জিত করে ঔদ্ধত্যের বাহাদুরীর স্থান কারবালা।
সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। এক মুসলমানের বিপদের কথা পৃথিবীর অপর প্রান্তে বসবাসকারী মুসলমানের বুকে শূলের মত বিদ্ধ হয়। কিন্তু এক ভাই যখন আপন রক্তের আরেক ভাইকে; এক মুসলমান যখন আরেক মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে খন্ডিত মস্তক নিয়ে ঔদ্ধত্যের বাহাদুরীতে মেতে ওঠে তখন সভ্য জগতের ইতিহাস নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাই হয়ে আরেক ভাইকে; মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানকে কিভাবে নির্দয়ভাবে কচুকাটা করতে পারে জগৎ সংসার একবার দেখেছিল ‘কারবালা’য় নরপিশাচ ইয়াজিদের মধ্যে। আরেকবার দেখল ১৯৭১ সালে বাংলার মাটিতে।
কথায় আছে এক হাতে তালি বাজে না। যে কোন ঘটনায় দু’পক্ষ অবশ্যই থাকে। আর যুদ্ধের মত ভয়াবহ ঘটনায় কেবল দু’পক্ষ নয়, বহুপক্ষের সমাহারও ঘটে। তবে যত পক্ষই থাকুক সকল পক্ষই ঐ দু’পক্ষের দুই সূতোয় পরস্পর অথবা বিচ্ছিন্নভাবে অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে ব্রতি হয়। যে পক্ষ জিতে যায় ইতিহাস তাকে কেন্দ্র করেই যুগ-যুগ,কালের কাল আবর্তিত হয়।
সুখের কথা মিথ্যা কখনও ইতিহাসে স্থান পায় না। সত্য প্রতিষ্ঠার নিদর্শন হয়ে মানবতার ধিক্কার পিষ্ট বলের মত অন্ধকারের অতল গহব্বরে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
যু্দ্ধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। আর তা কখনও অনন্তকাল চলে না(স্নায়ু যুদ্ধ কেবল স্নায়ুর অন্তরালে কিছুকাল ব্যপ্তি হয়)। জয় পরাজয়ের অমোঘ চিত্তে তারও সমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু যুদ্ধ কৌশলের বাইরে গিয়ে যুদ্ধরত পক্ষগুলো যখন একে অপরের ধবংশ লীলায় মত্ত হয়ে ওঠে তখনই ঘটে যুদ্ধাপরাধ।
যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও যুদ্ধের ব্যপ্তি কেউ কেউ নদী-নালা,খাল-বিল পেড়িয়ে মনুষ্যবসতিতে ছড়িয়ে দেয়। যেন যুদ্ধা তৈরীর ক্ষেত্র অঙ্কুরেই ধবংশ হয়। তখন মা বোনের ইজ্জত ও আবাল বৃদ্ধবণিতার জীবন নিয়ে চলে হলিখেলা। একেই বলে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
যে অপরাধ যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধারা করে না। স্ব-জাতির কিছু নিমকহারাম গোছের লোকের মাধ্যমে হয়। যুদ্ধাপরাধের চেয়েও মারাত্বক এই মানবতাবিরোধী অপরাধ।
যুদ্ধাপরাধের বিচার সাধারণত যুদ্ধ শেষেই হয় অথবা অনধিক সময়ের মধ্যেই তা শেষ করতে হয়। বাংলাদেশের বয়স এখন ৪১ বছর।
এতকাল পরে কোন জাতি যুদ্ধাপরাধের বিচার করে না। এখন যা হচ্ছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। যুদ্ধাপরাধের বিচার সহজ,মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সহজ নয়। কারণ এর বাদী-বিবাদী সবই হয় স্ব-জাতীয়,একই বৃক্ষের ফল। যা জাতি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ কৌশলের বাইরে গিয়ে একে অপরের ধবংশ লীলায়ই কেবল যুদ্ধাপরাধ হয় না। পরাজিত পক্ষের প্রতি নির্ধারিত আচরণের বাইরে অতিরিক্ত যা কিছুই ঘটবে তাও যুদ্ধাপরাধ। এটাই ইসলামের শিক্ষা। কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধাপরাধ,মানবতাবিরোধী অপরাধ দু’টোই ঘটেছে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। কারবালা সম্পর্কে আবাল-বৃদ্ধ সবারই কমবেশী জানা আছে।
তবে কারবালা প্রান্তরে ঘটে যাওয়া ঐ মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব হতেই নবীগণ অবগত ছিলেন। কেননা নবীগণের জীবনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর নবীগণকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কারবালা ও ইমাম হুসাইন (আঃ) সম্পর্কে পূর্ব হতেই অবগত করেছেন। ইসলাম কারবালা অপরাধের দায়মুক্তি নিতে পারে। কিন্তু ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্থানে যে দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল তার পূর্বাভাস নিশ্চয়ই কোন কিতাবে নেই। ইসলামও কখনও পূর্ব পাকিস্থানে ঘটে যাওয়া অপরাধের দায় নিবে না।
পূর্বেই বলেছি যুদ্ধাপরাধের চেয়েও মারাত্বক মানবতাবিরোধী অপরাধ। যে অপরাধের বিচার করতে জাতির অপরাপর অংশের সম্মতি ও একতা দৃঢ়ভাবে প্রয়োজন হয়। অবশ্যই যাদের বিচারকার্য হয় তারাও এ জাতিই অংশ। অতএব স্ব-জাতির লোকের অপরাধের বিচার স্ব-জাতির লোকের দ্বারা সম্পন্ন করাটা কতটুকু কষ্টসাধ্য কল্পনা করুন।
২৬ জুলাই ২০১০, সোমবার ,১১ শ্রাবণ ১৪১৭ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল যাত্রা শুরু করে জাতির অনেক আশা ও প্রতিক্ষা নিয়ে।
আজ ১৫ই ডিসেম্বর,২০১২। মহান বিজয় দিবস শুরুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে লিখতে হচ্ছে জাতির আশা-আকাঙ্খার স্বপ্নে ধারণ করা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের অপমৃত্যু ঘটেছে।
মায়ের কোলের শিশু নিজের পরিপার্শ্ব থেকে শিখে নিজের পার্শ্বিক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। স্কুলের গন্ডি পেরুতে শিক্ষকদের সংস্পর্শে সে নব জীবন লাভ করে। চেনা-অচেনা অসুখ বিসুখে কখনও তাকে ডাক্টারের ছুরির নীচেও নিজেকে সোর্পদ করতে হয়।
কোন অচেনা মায়ের সন্তান আরেক অচেনা ডাক্টারের সঠিক চিকিৎসায় নব জীবন প্রাপ্ত হয়ে মায়ের সন্তান মায়ের কাছে ফিরে যায়। শিক্ষক, ডাক্টারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শাখা বিচার বিভাগ মানবতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানুষের নিত্য চলার পথকে স্বাভাবিক ছন্দময় করে রাখে। রাষ্ট্রের এই প্রয়োজনীয় স্তরগুলিতে যদি মেধা, জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাব থাকে তবে জাতি কখনও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)পদত্যাগ করেছেন। যে ট্রাইবুনাল জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক।
যার প্রতি পুরো জাতি তাকিয়ে আছে। সেই ট্রাইবুনাল প্রধান (চেয়ারম্যান)কিনা নিয়মিত বিচারের নানাদিক নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে স্কাইপি কথোপকথন করেন!আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সময়ে তিনি মোট ১৭ ঘণ্টার কথোপকথন করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোন কেসটা কীভাবে আগাবে, কোনটার রায় কখন দিলে ভালো হবে, কতজন সাক্ষী নিলে সুবিধা—ইত্যোকার সবকিছু পাওয়া যায় তার স্কাইপি কথোপকথনে। সরকারের নানা ব্যক্তির মুখেও শুনা গেল এই বিজয়ের মাসেই(হতে পারত তা ১৬ই ডিসেম্বরের আগেই) অন্তত একজনের বিচারের রায় পাওয়া যাবে। কিন্তু বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপকথন থেকে জানা যায়, সরকার ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রায়ের জন্য চাপ দিচ্ছে ট্রাইব্যুনালকে।
স্কাইপি কথোপকথনে তিনি একসময় বলে ফেলেন ”সরকার রায়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। সরকার শুধু একটা রায় চায়। ” সরকার রায় চাইতেই পারেন। কিন্তু সেই রায় ঘোষণার পর্যায়ে যদি ট্রাইবুনাল না আসে তবে তা কিভাবে সম্ভব? ফরহাদ মজহার
গতকাল বলেছেন শুধু সম্ভব নয় পদোন্নতির বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়ও সম্ভব ! এই হলো জাতির আশার গুড়ে বালির বস্তার কাহিনী। যে বিচারের কথা ঘরের স্ত্রীর সাথে আলোচনা করাও অপরাধ সে আলোচনা কিভাবে বাইরের আরেকজনের সাথে দীর্ঘ তিন মাস ধরে চলল তাই বিবেকের কাছে প্রশ্ন।
তবে কি তার মধ্যে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল?থাকলে চেয়ারম্যান হলেন কেমনে?দলবাজি করে প্রশাসনের বড় কর্তা হওয়া যায়। দলবাজি করে অভিজ্ঞতার ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার মহৌষধ কি কোন দলের গঠনতন্ত্রে আছে?আর সরকারই বা কেন একটি জাতীয় ইস্যুকে দলীয়করণ করতে গেলেন?যারা বিচারের বিরোধী আছে বা বিচার প্রক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখছেন সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ বিচার করে তাদের মুখে চুনকালি দেওয়া যেত।
ট্রাইবুনাল পুর্নগঠন করা হয়েছে কিন্তু মানুষের মনের বিশ্বাসকে তো আর পুর্নগঠন করা যায় না। বিরোধীদের কখা বিচার প্রক্রিয়া নতুনভাবে শুরু করতে হবে। এখানেই তাদের দাবির যুক্তি পাই।
নিজামুল হক কেবল স্কাইপি কথোপকথনই করতেন না। মেইলও আদান প্রদান করতেন। যাদের সঙ্গে কথোপকথন হয় তাদের একজন রায় ও আদেশের স্ট্রাকচার এই মেইলে লিখে পাঠান বলেও ঐ স্কাইপি আলোচনায় উঠে আসে। অতএব, তার রেখে যাওয়া ট্রাইবুনালে নিশ্চয়ই বাহির থেকে আসা অনেক রায় ও আদেশের স্ট্রাকচার রয়েছে। যেখান থেকে পুর্নগঠিত ট্রাইবুনাল যাত্রা শুরু করবে।
অতএব বিচার প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ তেঁতুলের শিকড় থেকে তো আমের চারা গজায় না ! মানুষের বিশ্বাস থেকে এই ট্রাইবুনালের অপমৃত্যু হয়েছে। এই ট্রাইবুনালের কাছে এখন কেবল কয়েকটি রাজনৈতিক রায়ই আশা করা যায়। যা সরকার চাচ্ছে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।