আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দায়ী শুধু এই ছাত্রলীগের ছেলেরা নয়, দায়ী আমরা সবাই

জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই দায়ী শুধু এই ছাত্রলীগের ছেলেরা নয়, দায়ী আমরা সবাই। নেতারা তো নেতা হয়েছেন আমাদেরই ভোটে। আমরাই যদি বারবার চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী-হত্যাকারীদের ভোট দিই, তাহলে নেতা হওয়ার জন্য, ভোট পাওয়ার জন্য উৎসাহী ব্যক্তিরা তো আগে চাঁদাবাজ হবে, তারপর ভোট চাইবে। সামনের সপ্তাহে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ভোটাররা যদি আগপাছ বিবেচনা না করে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন, তাহলে এ অবস্থা চলতেই থাকবে।

টিআইর দুর্নীতি সূচকের মতো প্রার্থীদেরও দুর্নীতি সূচক দরকার। অন্তত সহায়-সম্পত্তির হিসাব। কিন্তু আমরা, ভোটাররা যত দিন ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের বাছবিচার না করব, তত দিন উঠতি নেতাদের হাতে বিশ্বজিৎ দাসের মতো নিরীহ পথচারী খুন হবে আর রাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। আমরা দানব তৈরি করব কিন্তু দানবের কাছ থেকে আশা করব মানবিক আচরণ—এটা তো হয় না। এই লেখাটা আমার না।

লিখেছেন শাহদীন মালিক। চমৎকার লেখা। শেয়ার না করে পারলাম না। নতুন নেতৃত্বকে স্বাগত, অভিনন্দন ১১ ডিসেম্বরের অনেক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশিত হয়েছে। হত্যাকারীদের ছবির আকার কোনো পত্রিকায় অনেক বড়, কোনো পত্রিকায় একটু ছোট।

ছবিগুলোর ওপরে প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল, ‘হামলাকারীরা ছাত্রলীগ কর্মী’। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ—কেউ এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানেন না। পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করেছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে। অর্থাৎ আসামি অজ্ঞাতনামা। ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক দল বলেছে ছবির মানুষগুলো তাদের খাস লোক নয়।

হয়তো একটু-আধটু সম্পৃক্ত ছিল, কিন্তু দলীয়ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়। ধরে নিচ্ছি, তাদের সবার কথাই ঠিক। কিন্তু সেটা অতীত। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর আমার বিশ্বাস তাঁরা এখন অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। নেতৃত্বে তাঁরাই আসছেন।

নতুন নেতা হিসেবে তাঁদের আমরা স্বাগতম জানাচ্ছি, অভিনন্দন জানাচ্ছি। নেতৃত্বের যে গুণাবলি তার সবই তো দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের দু-একজনের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা আছে। চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজে শুধু হাতেখড়িই হয়নি, পাকাপোক্ত ও বিশদ অভিজ্ঞতাও আছে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বহু নেতা-কর্মীরই এ গোছের চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আছে।

এসব অভিজ্ঞতা বা পারদর্শিতার বদৌলতে হয়তো প্রথম সারির কর্মী হওয়া যায়, কিন্তু নেতৃত্ব হাসিলের জন্য আরও ‘বড়’ কাজ করতে হয়। এই বড় কাজটি তাঁরা বহু লোকের সামনে টিভি-পত্রিকার সব ধরনের ক্যামেরার সামনে সম্পূর্ণ সার্থকভাবে করেছেন। তাঁদের ‘সাফল্যের’ সংবাদ-চিত্র টিভি চ্যানেলগুলো দেখিয়েছে। পত্রিকাগুলো প্রথম পাতায়। প্রায় সব পথেই চড়াই-উতরাই থাকে।

আগামী দুই-চার দিন হয়তো দলই তাঁদের অবদান কিছুটা ছোট করে দেখবে। তবে অচিরেই তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন হবে। নেতৃত্বে তাঁরা আসবেনই। তাঁদের তাই আগেভাগেই অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। এখন মাপকাঠি বা মূল্যায়নের মাধ্যম হয়ে উঠেছে একটাই—যে যতই বেশি আইন ভেঙে অপরাধমূলক কাজ করে, সে তত বড় নেতা।

২. দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় ব্যক্তি বা নেতা। যেমন সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু গেল, দেশের ভাবমূর্তির কিছুই নেই প্রায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কত কোটি টাকা ঘুষ দেবেন, সে হিসাব মেলাতে না পেরে অচিরে ঢাকার জন্য বিমানের টিকিট আর কাটবেন না। এত সব কিছুতে কারও কিছু যায় আসে না। মূল কথা হলো মহান দেশপ্রেমিক সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবের যাতে কোনো তকলিফ না হয়।

অবশ্য দুদক তাঁকে দু-একবার একটু বিরক্ত করেছে বৈকি। তাঁকে দুদক অফিসে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এর বেশি অসদাচরণ তাঁর সঙ্গে করা যাবে? পদ্মা সেতু চুলায় যাক! সব দিকে কমবেশি অবস্থা একই। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। কম হলে তো চলবে না।

সবাই তো রাজনীতি করে। এ ধরনের, সিঙ্গাপুরের ব্যাংক থেকে ২০ কোটির মতো টাকা দুদকের অ্যাকাউন্টে এল। সঙ্গে সঙ্গে হইহই রইরই—এটা ছোট কুমারের টাকা নয়। এটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। টাকা কার, সেটা মুখ্য ব্যাপার নয়।

মুখ্য ব্যাপার হলো অপরাধকর্মের সঙ্গে ছোট কুমারের সংশ্লিষ্টতা এখন সন্দেহাতীত। আর যেহেতু অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন, সেহেতু তাঁর নেতৃত্বের আসন বুকিং হয়ে গেছে পাকাপোক্তভাবেই। অতীতের রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন বোকাসোকা ধরনের। কি-না-কি আদর্শ-টাদর্শ নিয়ে নাকি ব্যস্ত থাকতেন। দিনকাল এখন বদলেছে।

এখন মূল যোগ্যতা হলো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। দু-চারজন পুরোনো কালের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী যে একেবারে নেই, তা নয়। দু-চারজন এখনো আছেন। কিন্তু নতুন মডেল হলেন: বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা, সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা আর ছোট কুমারের মতো রক্তের সম্পর্কের যোগ্যতাসম্পন্ন নেতৃত্ব। ৩. দেশটা যে অবস্থায় গেছে সেখান থেকে আমি ধরেই নিচ্ছি বিশ্বজিৎ দাসের হত্যার বিচার হবে না।

বড়জোর পুলিশ চিহ্নিত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করবে। তারা মাস দুই হয়তো জেলে থাকবে। তারপর ফুলের মালা পরে জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আসবে। তারপর ক্রমান্বয়ে বড় নেতা বনে যাবে। বড় দুটি রাজনৈতিক দল গত ২০ বছরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আর বড় বড় কলেজে ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন হতে না দিয়ে নেতা হওয়ার ভালো রাস্তাটা বন্ধ করে রেখেছে।

ছাত্রসংগঠনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে নেতা হওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বিকল্প রাস্তা হয়েছে দুটো: প্রথমটি চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস-হত্যাকাণ্ড আর দ্বিতীয়টি ব্যবসা। আর যাঁরা ব্যবসার সঙ্গে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি একসঙ্গে করতে পেরেছেন, রাজনীতিতে তাঁদের সাফল্য ঠেকানো যায়নি। অবশ্য এই সাফল্যের দায়ভার আমাদের সবার। ভাবতে অবাক লাগে, দেশের প্রায় তিন ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনও উপাচার্য নেই যার বলার সাহস আছে, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন হবে। ’ প্রায় সবাই যেহেতু তৈল মর্দন ও লেজুড়বৃত্তির সুবাদে উপাচার্যের পদ পেয়েছেন, সেহেতু পদ হারানোর ভয়ে এ কাজ কেউই করেননি।

গত ২০ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে একজন উপাচার্যও পাওয়া গেল না। সবকিছুই একই সূত্রে গাঁথা। তবে পুনরাবৃত্তি করছি—দায়ী শুধু এই ছাত্রলীগের ছেলেরা নয়, দায়ী আমরা সবাই। নেতারা তো নেতা হয়েছেন আমাদেরই ভোটে। আমরাই যদি বারবার চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী-হত্যাকারীদের ভোট দিই, তাহলে নেতা হওয়ার জন্য, ভোট পাওয়ার জন্য উৎসাহী ব্যক্তিরা তো আগে চাঁদাবাজ হবে, তারপর ভোট চাইবে।

সামনের সপ্তাহে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ভোটাররা যদি আগপাছ বিবেচনা না করে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন, তাহলে এ অবস্থা চলতেই থাকবে। টিআইর দুর্নীতি সূচকের মতো প্রার্থীদেরও দুর্নীতি সূচক দরকার। অন্তত সহায়-সম্পত্তির হিসাব। কিন্তু আমরা, ভোটাররা যত দিন ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের বাছবিচার না করব, তত দিন উঠতি নেতাদের হাতে বিশ্বজিৎ দাসের মতো নিরীহ পথচারী খুন হবে আর রাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না।

আমরা দানব তৈরি করব কিন্তু দানবের কাছ থেকে আশা করব মানবিক আচরণ—এটা তো হয় না। বিশ্বজিৎ শুনতে না-পাওয়ার দেশে চলে গেছেন। তা-ও তাঁকেই বলব, চেষ্টা করতেই থাকব যাতে রাষ্ট্র আর এই রাষ্ট্রের রাজনীতি দানব না হয়ে মানুষের জন্য হয়। আমাদের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করে দিয়ো, ক্ষমা চাইছি। পরকালে ভালো থেকো।

শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। মূল লেখার লিংক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.