আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার শৈশবের কাজলাদিদি!

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমরা সরকারী কোয়ার্টারে থাকতাম বাবা-মা’র চাকুরীর সুবাদে। স্কুলে যেতাম হেটে হেটে। বাসা থেকে প্রায় এক কিলো হবে। ফেরার পথে নাজু আপুদের বাসা থেকে দুধ নিয়ে আসতে হত।

স্কুলে যাবার সময় পাত্র রেখে যেতাম। নাজু আপু তখন সবে কলেজে উঠেছে। আপুর মত ইঁচড়েপাকা মেয়ে ঐ তল্লাট তো বটেই আশে-পাশের কয়েক গ্রামেও ছিল কিনা সন্দেহ! দুধ আনার কাজটা আমার মোটেও পছন্দ হতনা। কারন টা নাজু আপু। এত জ্বালাতো! এই করে দে-সেই করে দে, এটা এনে দে-ওটা এনে দে, পেয়ারা পেড়ে দে, অমুক গাছ থেকে তেতুল এনে দে... শুধু কি তাই! স্কুল থেকে কি পড়া দিয়েছে, খাতায় নোট নিয়েছি কিনা, হোমওয়ার্ক ঠিকমত করেছি কিনা সব চেক করা চাই প্রতিদিন ই! আর পরীক্ষা হলে তো কথাই নেই, প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিয়েছি সব বলতে হত! রীতিমত অত্যাচার।

রাজি না হলে দুধ ফেলে দেবার হুমকী দিত। অবশ্য এমন ব্লাকমেইলের কারন আছে। দুধ নিয়ে ফেরার পথে ক্যাঙ্গারুর মত লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতাম বাসার দিকে। প্রায়ই দেখা যেত দুধ সব পড়ে গেছে কিংবা অল্প একটু অবশিষ্ট আছে। অল্প একটু থাকলে জানে পানি পেতাম।

পানি মিশিয়ে ভর্তি করে তারপর বাসায় ঢুকতাম। বাসায় প্রায়ই বকা খেতে হত। একদিন ওরকম ছুটতে গিয়ে দুধ সব ফেলে দিয়েছিলাম। খালি দুধের পাত্র নিয়ে বাসায় যাবার সাহস হচ্ছিল না। কি করবো ভেবে না পেয়ে চুপিচুপি নাজু আপুর কাছে গিয়ে কেঁদে ফেললাম।

আপু পাত্র ভর্তি করে দিয়ে বললো, যেভাবে এসেছিস ওভাবেই চুপিচুপি বের হয়ে যা, আম্মা যেন না দেখে। ব্যস! তারপর থেকে নাজু আপুর সাথে খাতির হয়ে গেল! ঈদের আগে স্কুল ছুটি দিয়ে দিল। শেষ ক্লাস করে দুধ নিতে গিয়েছি। নাজু আপুকে দেখলাম শীলের উপর মেহেদীপাতা বাটছে। জিজ্ঞাসা করলাম মেহেদী কি ঈদের জন্য আপু? বলল না, আমার বিয়ের জন্য! আমার তো মাথায় হাত! বললাম তাইলে এখন থেকে দুধ কার কাছ থেকে নিবো! -কেন আম্মার কাছ থেকে নিবি।

আম্মাকে ডরাস? হু করে মাথা নাড়লাম। উল্লেখ্য, নাজু আপুর আম্মা বেশ মোটাসোটা আর রাশভারী মহিলা ছিলেন। কথা খুব কম বলতেন। তাই পারতপক্ষে উনার সামনে খুব একটা স্বস্তিবোধ করতাম না। মেহেদীপাতা বাটা শেষ হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো মেহেদী লাগাবো কিনা।

বললাম আগে তুমি লাগাও, তারপর দিবো। আপু মেহেদীর বাটি আর একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে বললো তুই লাগিয়ে দে। আমতা-আমতা করে বললাম আমি তো মেহেদী লাগাতে পারিনা। -বলিস কি! তোর ঘরে তো বউ থাকবেনা! মেহেদীর বাটি আমার হাতে দিয়ে বললো নে ধর, তোর যেভাবে খুশি মেহেদী লাগা। আমার খুশি দেখে কে! চক দিয়ে স্লেটের উপরে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আঁকতাম, মেহেদী দিয়ে আপুর সুন্দর ফর্সা হাতেও তাই করলাম।

মেহেদী লাগানো শেষ হলে বললাম দুধ দাও চলে যাই। দাড়া! এখনো কাজ বাকি আছে। আমার হাতের মেহেদীটা শুকাক, তারপর তোর হাতে লাগিয়ে দিবো। ঘন্টাখানেক পরে আপু তেল দিয়ে মেহেদী উঠিয়ে ফেললো। টকটকে লাল হয়েছে! আপুর ফর্সা হাতে দারুন লাগছে! মেহেদীর বাটিটা নিয়ে আসতে খুশিমনে হাত বাড়িয়ে দিলাম।

আপু খুব সুন্দর করে লতা-পাতা একে মেহেদী লাগিয়ে দিল। ওদিকে টেনশনে পড়ে গেলাম বাসায় যেতে দেরি হচ্ছে। বাসা থেকে চিন্তা করবে। আপুকে বললাম দুধ দাও চলে যাবো। -চলে যাবি মানে! বউরে একা রেখে কই যাবি! বউ মানে! আমি অবাক হওয়ার সপ্তম স্কেলে! বউ মানে এখনো বুঝিস নি? এই যে আমার হাতে তুই মেহেদী লাগিয়ে দিলি, তোর হাতে আমি দিলাম।

এটা জামাই-বিবিতে করে। এখন থেকে তুই আমার বর, আর আমি তোর বউ, বুঝেছিস গাধা! আমি ভয় আর টেনশনে কেঁদে ফেললাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম তাইলে শোভার কি হবে! শোভার কি হবে মানে! এইবার আপু অবাক। বললাম পাশের বাসার শোভার সাথে বর-বৌ পাতিয়েছি। আমরা প্রতিদিন মাটির হাড়ি-কুড়ি দিয়ে বর-বৌ-বর-বৌ খেলি।

আর তাছাড়া আব্বু যদি শুনে আমি তোমার মত ধামড়ি মেয়েরে বিয়ে করেছি, আমার হাড্ডি-গুড্ডি একটাও আস্ত থাকবেনা! এবার আপুর হাঁসতে হাঁসতে হেঁচকি উঠে গেল! আপুর হাঁসি দেখে আমার কান্না আরো বেড়ে গেলো। শেষে অনেক কষ্টে আমারে বোঝালো এতক্ষন আমার সাথে ফাজলামি করেছে! ...নাজু আপু! তখন বুঝতাম না কি অসীম স্নেহ আর ভালবাসা লুকিয়ে ছিলো তোমার জ্বালাতনগুলির মাঝে.. আমার পিচ্চি বয়সের অবুঝ মনটা তখন না বুঝলেও এখন সবই বুঝে! প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে। এখনো তোমার কথা খুব মনে পড়ে। খুব-খুউব ইচ্ছে করে আবার সেই ছোট্ট টি হয়ে হাড়জ্বালানী তোমার কাছে ফিরে যেতে!  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।