আমি শিক্ষানবীশ এবং কর্মী । সবার কাছ থেকেই শিখছি । সারা জীবনই হয়ত শিখে যাব। ছোটবেলা থেকে রাফাত খুব মিশুক ছিল। এত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে আপণ করে নেয়ার ক্ষমতা দেখে অবাকই হতো রাফাতের বন্ধুরা।
মাঝে তো এমন দিন আসল যে রাফাতকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে সিগারেটেই খেতে পারত না ওর বন্ধুরা। যখনই সিগারেট ধরায় তখনই কোন পরিচিত চাচা-মামা বের হয়ে যায় রাফাতের। বাধ্য হয়ে প্রায়ই বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত ওরা। আর ছোট বাচ্চারা কেমন রাফাতকে দেখলেই মন খারাপ ভুলে যায়। এ এক অসাধারণ গুণ রাফাতের।
স্কুলজীবনের একটা ঘটনা নিয়ে অনেকদিন আড্ডায় হাসাহাসি হয়েছে ওদের। বাংলার শামিমা ম্যাডাম একদিন স্কুলে তার পাচ বছর বয়সী মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। ওরা তখন ক্লাস এইটে। ম্যাডাম কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন। এমন সময় মেয়েটা হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি শুরু করল।
ম্যাডাম যতই চেষ্টা করছেন, কিছুতেই থামে না। এমন সময় পেছনের বেঞ্চ থেকে রাফাত হাত তুলে বলে উঠল
-ম্যাডাম, আমি ওকে নিয়ে দু’মিনিট বাইরে থেকে বেরিয়ে আসি?
শামিমা ম্যাডাম তখন প্রাণপণে ক্লাসের মাঝে মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। নিরুপায় হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি।
-যাও। নিয়ে যাও।
কয়েকমিনিট পর যখন রাফাতের আঙ্গুল ধরে ম্যাডামের মেয়েটা ক্লাসরুমে ঢুকল তখন খিলখিল করে হাসছিল। সবার কি হাততালি! ম্যাডাম খুশি হয়ে সেদিনের পড়াটাও ধরেননি।
ইদানিং রাফাত অনেক বদলে গেছে। কলেজ পাশ করে ওর প্রায় সব বন্ধুই এখন শহর ছেড়ে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে। স্কুল-কলেজ কোনটাতেই রাফাত পড়াশোনাটা ভাল করে করতে পারেনি।
রেজাল্টও তেমন ভাল হয়নি। তাই ওর মা’র ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দেখার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল।
অবশ্য রাফাতের চেয়ে খারাপ রেজাল্ট করেও ওর অনেক বন্ধু প্রাইভেটে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। একসময় রাফাতেরও লোভ হত প্রাইভেটে পড়ার। একবার ভেবেছিল বাবাকে বলবে।
বন্ধুদের কাছে শুনেছে চারলাখ টাকা হলেই একটা সাবজেক্ট পাওয়া যাবে। কিন্তু মাসের শেষের কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখে তার সরকারি কেরানী বাবা আর গৃহিনী মা’র ঝগড়া লেগেছে সকালের বাজার নেই দেখে, তখন বাস্তবতার চিন্তায় তার স্বপ্ন বাসিমুখেই থেকে যায়।
আজ রাফাতের দুইজন বন্ধু সাব্বির আর আশিক ঢাকায় যাচ্ছে। রাত সাড়ে এগারোটায় বাস। এখন সাড়ে দশটা বাজে।
রাফাত ওদেরকে বাসে তুলে দিতে যাবে। প্রথমে আশিকের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে সাব্বিরের বাড়ি হয়ে বাসস্ট্যান্ডে যাবে।
আশিক আর সাব্বিরই দু’জনই সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চান্স পেয়েছে। কাল থেকে ক্লাস শুরু।
রনি, সুজন, নিবিড় মেডিকেলে ক্লাস করতে যাওয়ার পর আশিক আর সাব্বিরের সাথেই বিকেলের আড্ডাটা জমত রাফাতের।
যদিও আগের মত মজা হতনা আড্ডায়। নিজে না চাইলেও ওদের দুইজনের মাঝে রাফাতের নিজেকে ছোট মনে হত। ও জানে বন্ধুদের মাঝে ছোট বড় বলতে কিছু নেই। কেউ ওকে সেভাবে দেখেও না। কিন্তু বেলাশেষে বাড়ি ফেরার পথে বুকের কোণায় কেন যেন হাহাকার করে উঠত রাফাতের।
দু’বার বাসায় কলিংবেল চাপতেই সাব্বির বের হয়ে আসল। পেছন পেছন সাব্বিরের বাবা আর মা ওর ব্যাগ নিয়ে। বিদায় দেয়ার সময় সাব্বিরের বাবা-মা ওকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেক। সাব্বিরও কাঁদল।
রাফাতের হঠাৎ মনে হলো এমন করে ওর বাবা-মা ওকে জড়িয়ে ধরে কখনও কাঁদেননি।
জীবনে বাবা-মাকে গর্বিত করার করার জন্য কোন কাজ করতে পারল না রাফাত।
-দোস্ত, চল। দেরি হয়ে যাবে। আশিকের ওখানেও যেতে হবে।
রাফাত তাড়া দিল সাব্বিরকে।
দুইবন্ধু আশিককে নিয়ে ঠিক সাড়ে এগারোটায় বাসস্ট্যান্ডে হাজির হলো। আশিকের বাসাতেও একই অবস্থা দেখতে হলো রাফাতকে। রাফাতের মনে হলো এই বিদায়ের মাঝেও এক ধরণের স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। আশিক আর সাব্বির যাচ্ছে ওদের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে।
বাস ছাড়ার সময় হয়ে আসল।
রাফাত বুঝল এই বিদায়ের ভার সে বইতে পারবে না।
-দোস্ত, তোরা বাসে ওঠ। আমি আসছি একটু।
আশিক আর সাব্বিরকে বাসে উঠিয়ে দিল রাফাত।
-কোথায় যাস? এখুনি ছাড়বে তো বাস।
দরজা থেকে সাব্বির হাত টেনে ধরল রাফাতের।
-এক্ষুণি আসছি, বলে রাফাত মোটামুটি দৌড়েই চোখ থেকে আড়াল করল সাব্বিরদের বাসটা। ঊকি মেরে দেখল বাসটা চলে যাচ্ছে। আশিক আর সাব্বিরের মুখটা দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। ওরা খুঁজছে রাফাতকে।
দু’জনই কাঁদছে।
রাফাত কাঁদতে পারল না।
সিগারেট ধরিয়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকে পরল রাফাত। আজ রাতে আর বাসায় ফিরবে সে। আজ রাতে নিজের সকল না পাওয়ার হিসেবের খাতা খুলে চাদের আলোয় হিসেব-নিকেশে বসবে রাফাত।
গলির অন্ধকারে রাফাত মিলিয়ে গেল দ্রুত।
৬/৬/১৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।