‘দিনগুলো ছিল খুব কষ্টের। কোনো মতো দুবেলা খাবার জুটত। কাপড়ের গাঁট (বোঝা) কাঁধে নিয়ে হাটে হাটে যেতাম বিক্রি করতে। আজ আমি তাঁতের মালিক। ’ কথাগুলো শাড়ি ব্যবসায়ী রঘুনাথ বসাকের।
যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির এই স্বত্বাধিকারী কথা বলছিলেন নিজের বাসা কাম শোরুমে বসে। বেশ বড়সড় দোতলা দালানের নিচতলায় তাঁর পাইকারি দোকান। নিজের গাড়ি আছে, যদিও ৬২ বছর বয়সী রঘুনাথের মোটরসাইকেলেই স্বাচ্ছন্দ্য বেশি।
রঘুনাথের দোতলা বাড়ির পাশেই নীলকমল বসাকের তিনতলা দালান। এটারও নিচতলায় দোকান, ওপরের তলা বাসা।
আশপাশে চকচকে দালানকোঠা চোখে পড়ে অনেক। শুনে মনে হতে পারে, এটা কোনো শহর বা শহরতলির বর্ণনা। আসলে এ জায়গাটা দেশের প্রশাসনিক পরিচিতি অনুযায়ী একটি গ্রাম।
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার এই গ্রামের নাম পাথরাইল, ইউনিয়নের নামও পাথরাইল। জেলা শহর থেকে দূরত্ব সাত কিলোমিটার।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে মির্জাপুরের পাকুল্যা থেকে দেলদুয়ার সদর হয়ে পাথরাইলে যাওয়া যায়, আবার পথ আছে টাঙ্গাইল শহর থেকেও। যেদিক দিয়েই যান না কেন, বিস্তীর্ণ সবুজের চাদর আর ধানখেত—বাইরে থেকে সাধারণ একটা গ্রামের চেহারাই যেন। কিন্তু ধাক্কাটা লাগে পাথরাইলের একটু ভেতরে ঢুকলেই। চকচকে দালানকোঠা যেমন চোখে পড়ে, তেমনি চোখে পড়ে ব্যাংকের এটিএম বুথ, তিনটি ব্যাংকের শাখা, জীবনবিমা প্রতিষ্ঠানের অফিস। আর কানে ভেসে আসবে মাকুর শব্দ।
টাঙ্গাইল শাড়ি পরিবর্তন এনেছে পাথরাইল গ্রামে, তাঁতশিল্পীদের জীবনযাত্রায়। এ গ্রামে জীবিত তাঁতশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক হলেন মনমোহন বসাক, ভাষা বসাক নামেও পরিচিত তিনি। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল টাঙ্গাইলের শাড়ি, তাঁতশিল্পের বৃত্তান্ত, ‘১২ বছর বয়সে এ কাজে ঢুকে যাই। গ্রাফ কাগজে নকশা আঁকতাম। ’ ভারতের বেঙ্গালুরু, আহমেদাবাদ, বেনারস ঘুরে ঘুরে নকশা করা শিখেছেন।
আর প্রয়োগ করেছেন এই পাথরাইলে বসে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে তাঁতিদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ‘স্বাধীনতার পর থেকে অবস্থা একটু ভালো হতে থাকে। তখন এখানে ১২টা গ্রামে তাঁতশিল্পের উন্নয়নে একটা প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু পাথরাইলে ছিল দক্ষ লোক।
’ বললেন মনমোহন বসাক। তাই পাথরাইল তখন হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কেন্দ্র।
তবে পাশে বসা রঘুনাথ বসাক যোগ করলেন, ‘সেই ভালো মানে তেমন ভালো না। তিন বেলা খাবারের সংস্থান হতো। একেবারে খারাপ অবস্থা হয় ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের শাসনামলে।
ভারতীয় শাড়ি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে আসতে থাকে তখন। সে সময় আমাদের অবস্থা ছিল না খেয়ে থাকার মতো। ’
এই অবস্থার সঙ্গে আজকের পাথরাইলের চিত্র পুরোটাই উল্টো। টাঙ্গাইল শাড়ির রমরমা এখন। ঢাকাসহ দেশের বাজার তো বটেই, ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি।
টাঙ্গাইল তাঁতি পুনর্বাসন সংস্থার (টাইলস) তথ্যমতে, গত বছর প্রায় ১০ লাখ শাড়ি রপ্তানি হয়েছে ভারতে। দেশের বাজারে এ সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। আজকের অবস্থান তৈরি হওয়ার পেছনে একবাক্যে সবাই স্বীকার করলেন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের উদ্যোক্তা মুনিরা ইমদাদের নাম।
রঘুনাথ বসাক বললেন, ১৯৮২ সালে মুনিরা ইমদাদ পাথরাইলে বেড়াতে এসে পাঁচ-ছয়টি শাড়ি কিনে নিয়ে যান। সেগুলো ঢাকায় তাঁর আশপাশের মানুষ পছন্দ করেন।
এরপর তিনি আবার এসে অর্ডার দেন। টাঙ্গাইল শাড়ির পুনরুত্থানের শুরুটা এখান থেকে। মুনিরা ইমদাদ ঢাকায় গড়ে তোলেন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির নামে একটি শোরুম। এরপর অনেক ডিজাইনার, অনেক উদ্যোক্তা পাথরাইল থেকে শাড়ি তৈরি করিয়ে নিতে থাকেন। শাড়ির দৈর্ঘ্যেও আসে পরিবর্তন।
মনমোহন বসাক বলেন, ‘কলকাতার শাড়ি তখন ছিল ১১ হাত। আমরা টাঙ্গাইলে শুরু করি ১২ হাত আর ব্লাউজ পিস সমেত ১৩-১৪ হাতের শাড়ি। ’
বংশপরম্পরায় বোনা হতে থাকলেও পাথরাইলের অনেক তাঁতি বা ব্যবসায়ীর বর্তমান প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা নিয়ে চলে গেছে অন্য পেশায়। আবার রাজীব বসাক বস্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে হাল ধরেছেন বাবার নিউ যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির। তিনি বললেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে অন্যের চাকরি না করে নিজেদের ব্যবসা দেখা অনেক ভালো।
আমি চেষ্টা করছি হাতে চালিত পিটলুমের (গর্তে বসানো তাঁত) আধুনিকায়ন করতে। ’
টাঙ্গাইলের এই শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষ-শিশু সবাই কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করে। পাথরাইল থেকেই শাড়ি তৈরির বিষয়টি এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো টাঙ্গাইল জেলায়। তাঁতিদের সুনিপুণ বুননের সুতি, হাফসিল্ক, চায়না সিল্ক, তসর, সিনথেটিক উপাদানের এসব শাড়ি এখানে তৈরি হয় ৩৫০ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। পাথরাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হানিফুজ্জামান বললেন, ‘ব্যক্তি উন্নত হলে তাঁর পরিবার উন্নত হয়।
আর পরিবার থেকে সমাজ উন্নত হয়। এই ইউনিয়নের আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। ’
পাথরাইলে এখন চলে তিন ধরনের তাঁত—পিটলুম, সেমি অটো (চিত্তরঞ্জন তাঁত) আর বিদ্যুৎ-চালিত তাঁত (পাওয়ার লুম)। রঘুনাথ জানালেন, এখন পিটলুম কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে চিত্তরঞ্জন তাঁত ও পাওয়ার লুম।
সেই সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা বাড়ায় পাথরাইল দিন দিন হয়ে উঠছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর এক গ্রামের উদাহরণ।
মনমোহন বসাক
বয়স ৮৩ বছর ছুঁইছুঁই। তার পরও বসেন গ্রাফ কাগজ নিয়ে। নিত্যনতুন নকশা এঁকে যান। এই মনমোহন বসাকের হাত ধরেই টাঙ্গাইল শাড়ির বালুচরি ডিজাইনের প্রচলন।
ভারতের নানা জায়গা ঘুরে নানা নকশা দেখে একটার সঙ্গে আরেকটা যোগ-বিয়োগ করে তিনি টাঙ্গাইল বালুচরি ধারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর টাঙ্গাইল শাড়িতে ব্লাউজ পিসের সংযুক্তিও তাঁর হাত ধরেই।
রুপালি গ্রাম
পাথরাইল যেমন টাঙ্গাইল শাড়ির গ্রাম, রুপার গয়না তৈরির গ্রাম হিসেবেও এর খ্যাতি এখন ছড়িয়ে গেছে। ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ের জন্য রুপার গয়না মূলত এখানেই তৈরি হয়। বাবা প্রহ্লাদ কর্মকারের মৃত্যুর পর নিজেদের রুপার গয়নার ব্যবসায় আসেন সঞ্জয় কর্মকার।
বললেন, ‘এখন শুধুই আড়ংয়ের জন্য গয়না তৈরি করি। আগে স্থানীয় মানুষের গয়না তৈরি করে টিকে থাকতে হতো। ’ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আড়ং এখানে এসেছিল শাড়ির ব্যাপারে। তখন দেখা প্রহ্লাদের সঙ্গে। সেই থেকে শুরু।
আড়ং থেকে গয়নার নকশা দেওয়া হয়। সেই নকশার ওপর কাজ করে নমুনা তৈরি করেন কর্মকাররা। তারপর আসে মূল কাজের অর্ডার। পাথরাইলে এখন ১৮-১৯ ঘর কর্মকার আড়ংয়ের গয়না তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সবারই ব্যবসা রমরমা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।