I am Bangladesh supporter বিশ্ব ব্যাংক সংস্কারের সহজ উপায় …
শফিক রেহমান
তারিখ: ২ অক্টোবর, ২০১২
স্থান : হোটেল গ্র্যান্ড হায়াট নিউ ইয়র্কের ভিআইপি সুইট।
সম্প্রতি মডার্নাইজ করা ১০০০ স্কয়ার ফুট বিশিষ্ট এই ভিআইপি সুইটে আছে : বেডরুমে ডাবল বেডে শাদা চাদর, পাখির পালকের শাদা লেপ ও বালিশ, বাথরুমে মার্বল শাওয়ার স্টল ও জুন জেকবস (জুন Jacobs) বাথ প্রডাক্টস, ডাইনিং এরিয়াতে ডাইনিং টেবিল ও ফৃজ এবং সিটিং এরিয়াতে ডিজাইনার সোফা, আর্মচেয়ার ও কাচের ফ্রেমে বাধানো আধুনিক আর্টওয়ার্ক, জেনিভা সাউন্ড সিসটেমসহ একটি ৩৭ ইঞ্চি ফ্ল্যাট টিভি স্কৃন, নরম কার্পেট।
কাল : সেপ্টেম্বর ২০১২-এর শেষ সপ্তাহের কোনো এক সকালবেলা।
পাত্র : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি বা পিএস, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থমন্ত্রী এবং হোটেলের ম্যানেজার।
সতর্কীকরণ : সকল চরিত্র, ঘটনা ও সংলাপ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
প্রাইভেট সেক্রেটারি (ঘরে ঢুকে) : গুড মর্নিং নেত্রী।
সোফায় বসা প্রধানমন্ত্রী (আর্মচেয়ার দেখিয়ে) : গুড মর্নিং। বসুন। আজ সকালের সব ইমেইল চেক করেছেন? ঢাকা থেকে কোনো ফোন?
পিএস (আর্মচেয়ারে বসে) : হ্যা। সব কিছুই আন্ডার কনট্রোল, নেত্রী।
শুধু …
প্রধানমন্ত্রী : শুধু কি?
পিএস : শুধু বুঝতে পারছি না বাংলাদেশ থেকে হাজী কামেল মিয়া কেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। তিনি তিনবার ফোন করেছেন। ইমেইলেও রিকোয়েস্ট করেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে।
প্রধানমন্ত্রী (ভুরু কুচকে) : হাজী কামেল মিয়া? কে তিনি?
পিএস : গোপালগঞ্জে তিনি হাজী কামেল মিয়া নামেই বিখ্যাত। ২০০৮-এর ইলেকশনে তার এলাকাতে বস্তাভর্তি ইনডিয়ান টাকার দরকার হয়নি।
সুপ্রতিষ্ঠিত ধনবান এই ব্যবসায়ী আমাদের পার্টির পেছনে অকাতরে অনেক খরচ করেছিলেন। তার তিন ছেলে, পাভেল, রুবেল ও নোবেল-ও আমাদের পার্টির জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিল। ইলেকশনের পর আপনার সদয় নির্দেশে ওই তিন ছেলেকে, যথাক্রমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগে ভালো পদ দেয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী : ও হ্যা। এখন মনে পড়েছে।
তা তিনি কি বলতে চাইছেন?
পিএস : সেটা তিনি আমাকে বলতে চাইছেন না। তিনি সরাসরি আপনাকে বলতে চান।
প্রধানমন্ত্রী : ওনাকে বলে দিন আমি এখানে হাজার রকম কাজে ব্যস্ত। জয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলুন।
পিএস : বলেছিলাম।
হাজী কামেল রাজি হননি। তিনি শুধু আপনার সঙ্গেই বলতে চান।
প্রধানমন্ত্রী : তাহলে ওনাকে অপেক্ষা করতে বলুন। আমি ঢাকায় ফিরে ওনার কথা শুনবো।
পিএস : তাই হবে নেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী : গতকাল জাতিসংঘে আমার ভাষণে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর সংস্কারের দাবি জানানোর পর আপনাকে বলেছিলাম অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাকে এ বিষয়ে একটা একজিকিউটিভ সামারি পেপার বানাতে। আপনি তাকে বলেছেন?
পিএস : হ্যা। বলেছি। তিনিও তো এই হোটেলেই আছেন।
প্রধানমন্ত্রী : আমি জানি। সরকারি সফর দলের মেম্বার না হলেও তিনি এমিরেটসের একই ফ্লাইটে নিউ ইয়র্কে এসেছেন। সস্ত্রীক। তারপর এই একই হোটেলে চেক ইন করেছেন। খুব এক্সপেন্সিভ হোটেল এটা।
তিনি সেটা জানেন। আমাদের এমবাসি তার নামে আগে কোনো রিজার্ভেশন না দেওয়ায় রুম রেট তাকেই বহন করতে হতো। এই রুম রেট তিনি দিতে পারবেন না। তার নামে দুর্নীতির অভিযোগ আরো জোরালো হতো। সেটা তিনি বোঝেন।
তিনি খুব অসুবিধায় আছেন। এখানে আসার আগে ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে তার হার্ট অ্যাটাক অথবা ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে। তিনি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। তিনি বলেন, গুলাগ-এ থাকার মতো যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বেচারা।
তার এই অবস্থায় আমি খুবই বিব্রত হয়েছি। তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগত। আমি তাকে বিশ্বাস করি। সবচেয়ে বড় কথা তার ইনডিয়ান কনটাক্ট খুবই ভালো এবং ইনডিয়াও তাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। আপনার বোধ হয় মনে আছে, ইনডিয়াকে ট্রানজিট না দিলে বাংলাদেশের মানুষ যে অসভ্য সেটা প্রমাণিত হবে, এটা বলার পর তিনি ইনডিয়ানদের আরো বড় প্রিয়পাত্র হন।
তার সেই যোগ্যতাটাকেই আমি এখন কাজে লাগাব। তাই এমবাসিকে বলে দিয়েছি এই হোটেলে ওনার সব খরচ বহন করতে।
পিএস : আপনি সঠিকভাবে মানুষের মূল্যায়ন করেন, তাদের পুরস্কৃত করেন। এজন্যই তো আপনাকে সবাই বলে মহান নেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী : থাক।
থাক। পাম্প দিতে হবে না। এখন বলুন, তিনি কাজটা করেছেন কি না।
পিএস : হ্যা। তিনি একটানা কাজ করে একটা একজিকিউটিভ সামারি পৃপেয়ার করেছেন।
তিনি এখন তার রুমেই অপেক্ষা করছেন। আপনি বললে তাকে আসতে বলতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী : নিশ্চয়ই। আসতে বলুন। রুম সার্ভিসে ফোন করে ওনার জন্য চা-কফি আনতে বলুন।
যে বাজে টৃটমেন্ট তিনি বাংলাদেশে পেয়েছেন সেটা আমি ভুলতে পারি না। তাকে নিউ ইয়র্কে আমি একটা ভালো টৃট দিতে চাই। ঢাকায় ফেরার আগে আমি যখন মেসিজ (Macy’s) -এ শপিংয়ে যাবো তখন তাকে সস্ত্রীক আমার সঙ্গে রাখবেন।
পিএস পর পর দুটি ফোন কল করলেন। প্রথম কলে তিনি অর্থ উপদেষ্টাকে প্রধানমন্ত্রীর সুইটে আসতে বললেন।
দ্বিতীয় কলে রুম সার্ভিসকে চা-কফি ও কুকিজ পাঠাতে বললেন।
কিছুক্ষণ পর একটা ফাইল হাতে অর্থ উপদেষ্টা সুইটে ঢুকে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী (একটি আর্মচেয়ার দেখিয়ে) : বসুন। আপনার রুম রিজার্ভেশন-সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হয়েছে তো?
অর্থ উপদেষ্টা (চেয়ারে বসে বিগলিত হাসি মুখে) : থ্যাংক ইউ নেত্রী। থ্যাংক ইউ।
থ্যাংক ইউ। আমি জানতাম আপনি কখনোই আমাকে লেট ডাউন করবেন না।
প্রধানমন্ত্রী : ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকারের সময়ে ইনডিয়ান লবির সঙ্গে আপনার তৎপরতা আমি ভুলিনি। ২০০৮-এর ইলেকশনে আপনার কন্টৃবিউশন আমি ভুলবো না। আমার আবার ক্ষমতাসীন হবার পেছনে আপনার অনেক অবদান আছে।
এ সবই আমি বিবেচনায় রেখেছি। তাই পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে আপনার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওরা উঠালেও আমি সেটা আমলে আনিনি। আমি আপনাকে সাপোর্ট করে গেছি।
অর্থ উপদেষ্টা : এজন্য আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আই শ্যাল বি এভার গ্রেটফুল।
প্রধানমন্ত্রী : এখন কাজের কথায় আসুন। বিশ্ব ব্যাংক সংস্কার প্রস্তাবের পেপারটা রেডি করেছেন?
অর্থ উপদেষ্টা (ফাইল দেখিয়ে) : হ্যা, নেত্রী, তবে …
প্রধানমন্ত্রী : তবে? তবে কি?
অর্থ উপদেষ্টা : তবে আগে একটা কথা বলতে চাই। যদি অনুমতি দেন।
প্রধানমন্ত্রী : বলুন কি বলবেন?
অর্থ উপদেষ্টা : আপনি কিন্তু এই সংস্কার প্রস্তাবের আগের দিনই বলেছিলেন, ব্যাংক ও পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো কথা আর বলা যাবে না। কোনো বক্তব্যেও এই প্রসঙ্গ টানা যাবে না।
নিউ ইয়র্কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আপনাকে যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দেয়া হয়েছিল, সেখানে শুরুতেই আপনি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে সেই অনুষ্ঠানে বক্তারা বিশ্ব ব্যাংক বা পদ্মা সেতু সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেননি। আপনি নিজেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। আপনার এই নির্দেশ মন্ত্রী, আমলা ও দেশে-বিদেশে দলীয় নেতাদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। তাই দেশে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যিনি আগে বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হবে না, তিনিও এই নির্দেশটির উল্লেখ করে বিশ্ব ব্যাংক বা পদ্মা সেতু সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী উভয়েই বলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও পদ্মা সেতু নিয়ে অপ্রয়োজনে কথা বলা অনুচিত। (চিন্তিত মুখে) কিন্তু মাত্র এক দিন পরেই আপনি জাতিসংঘের ভাষণে বিশ্ব ব্যাংক সংস্কারের কথা বললেন। এটাকে সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে? আর বিশ্ব ব্যাংকই বা কিভাবে নেবে? পদ্মা সেতু প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে জনগণ আপনাকেই দায়ী করতে পারে। হয়তো পহেলা অক্টোবরে প্রত্যাশিত ঢাকা সফরে বিশ্ব ব্যাংক টিম যাবে না। বিশ্ব ব্যাংক তো এখন ক্ষেপে গিয়ে পদ্মা সেতু ঋণ দেয়ার বিষয়টির পুনর্বিবেচনা বন্ধ করে দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী (আত্মবিশ্বাসী হাসি মুখে) : সেই মুরোদ বিশ্ব ব্যাংকের নেই। থাকলে কি আর আমি এমন প্রস্তাব দিতাম? আমার এই প্রস্তাবের পেছনে উন্নয়নশীল দেশের সমর্থন আছে। আর সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সাধারণ মানুষ জানে আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী।
১৯৮৬-তে আমি বলেছিলাম জেনারেল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যারা অংশ নেবে তারা হবে বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু পরদিনই আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম আমার দল সেই নির্বাচনে অংশ নেবে। জনগণ তো সেটা মেনে নিয়েছিল। একবার আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম সাতান্ন বছর বয়সে আমি রিটায়ার করবো। কই? আমি কি রিটায়ার করেছি? প্রধানমন্ত্রী আছি এবং আমার ছেষট্টিতম জন্মদিন উৎসব এই হোটেলেই পালন করছি।
জনগণ চায় আমি যেন ২০২১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকি। ইনশাআল্লাহ প্রধানমন্ত্রী থেকেই আমি এই হোটেলেই ওই বছরে আমার পঁচাত্তরতম জন্মদিনের উৎসব পালন করবো। ১৯৯৫-৯৬-এ আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। তখন বলেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জনগণের দাবি এবং তার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। তখন বলেছিলাম জনগণের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক।
আর এখন আমি বলছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে। ২০০৭-এ আমি ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলাম ওই সরকার আমাদেরই আন্দোলনের ফসল এবং আমি ক্ষমতায় এসে ওই সরকারের সব কাজকে বৈধতা দেব। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই আমার সরকার ফখরু-মইনুর বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেছে। ফখরুর দ্বৈত নাগরিকত্ব বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মইনুর বিচার করবেন বলেছেন এবং মইনু যেন ঢাকায় তার বাড়ি বিক্রি করে আমেরিকায় টাকা পাচার না করতে পারে সেটাও বলেছেন।
আপনি বুরোক্র্যাট। পলিটিশিয়ান নন। সুতরাং রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই সেটা আপনি বুঝবেন না। কোনো কথা দিয়ে সেই কথা রাখা রাজনীতিতে হতে পারে চরম বোকামি। আমি যে কথা দিয়ে কথা রাখি না সেজন্য কেউ কি কখনো আমাকে বেইমান বলেছে? মোনাফেক বলেছে? বরং জনগণ বলে, আমি বাপের বেটিÑ দিনকে রাত, রাতকে দিন বলতে পারি।
মনে রাখবেন রাজনীতিতে নীতি রক্ষার দুর্বলতায় আমি ভুগি না। রাজনীতিতে সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও চারিত্রিক শুদ্ধতা বিলাসিতা মাত্র। রাজনীতির দুটো অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে বস্তাভর্তি টাকা এবং অবারিত ঘুষ।
রুম সার্ভিসের ওয়েটার ট্রলিতে করে চা-কফি কুকিজ দিয়ে গেল। সেদিকে নির্দেশ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী : নিন। চা খান।
অর্থ উপদেষ্টা : নেত্রী। প্রথমে একটা সুসংবাদ দিতে চাই। এ বছর ৫ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ব ব্যাংকের চিফ ইকনমিস্ট পদে নিযুক্ত হয়েছেন ড. কৌশিক বসু।
তার বয়স ষাট। জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। সেখানে সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনার পর দিল্লিতে সেইন্ট স্টিফেন্স কলেজে ইকনমিক্স আর ম্যাথমেটিক্সে পড়াশোনা করেন। তারপর লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে পিএইচডি করেন। তিনি তার পিতার আইন পেশায় না গিয়ে নোবেলজয়ী ইকনমিস্ট ড. অমর্ত্য সেন দ্বারা প্রভাবিত হন।
দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল-এর দর্শন তাকে বাম ঘেষা করে। তিনি ইংল্যান্ডে রেডিং ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকায় এমআইটিতে ইকনমিক্স পড়ান। তারপর আমেরিকায় কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ইকনমিক্স প্রফেসর পদে ছিলেন। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে তিনি ইনডিয়ান সরকারের চিফ ইকনমিক এডভাইজার পদে কাজ করছিলেন। এখন এলেন বিশ্ব ব্যাংকে।
প্রধানমন্ত্রী (আনন্দিত) : দারুণ খবর দিলেন। দারুণ। বিশ্ব ব্যাংকের চিফ ইকনমিস্ট একজন ইনডিয়ান। পশ্চিম বাংলার বাঙালি। দারুণ।
দারুণ। তাহলে তো পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে আর কোনো প্রবলেমই থাকবে না।
অর্থ উপদেষ্টা (গম্ভীর মুখে) : এটা নিঃসন্দেহে আপনার জন্য ভালো সংবাদ। কিন্তু ড. বসুর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ দুঃসংবাদ হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী : তার মানে?
অর্থ উপদেষ্টা : কৌশিক বসু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন একটা দেশের ইকনমির উন্নতি ও প্রসারের জন্য ভালো আদর্শিক গুণগুলো খুবই দরকার।
তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তির মধ্যে সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং চারিত্রিক শুদ্ধতা থাকতেই হবে। কৌশিক আরো মনে করেন, সরকারের মধ্যে এবং জনগণের আলোচনার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। ঘুষ দেয়া-নেয়া সম্পর্কে কৌশিকের হ্যারাসমেন্ট ব্রাইবস (Harassment Bribes) বা হয়রানিমূলক ঘুষ থিওরি এখন বেশ আলোচিত।
প্রধানমন্ত্রী : হয়রানিমূলক ঘুষটা কি?
অর্থ উপদেষ্টা : এই যেমন পাসপোর্ট পাওয়া, রেশন কার্ড পাওয়া, এসব হলো নাগরিকদের বৈধ অধিকার। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট, রেশন কার্ড দেয়ার জন্য ঘুষ নেয়াটা হবে হয়রানিমূলক এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য।
প্রধানমন্ত্রী : হুম। ইকনমিক্সের লোক তো। পলিটিক্স বোঝেন না। এখন তিনি বিশ্ব ব্যাংকে ঢুকেছেন। পলিটিক্স যে কি সেটা তিনি বুঝবেন।
বিশ্ব ব্যাংকে যে কি পরিমাণ দুর্নীতি আছে সে বিষয়ে আমার মন্ত্রীদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। তার আদর্শবাদিতা নিয়ে আপনি মোটেও দুশ্চিন্তা করবেন না। সময় এলে দুর্নীতির কাছে তিনিও নতি স্বীকার করবেন। আপনি তাকে পকেটে ভরার চেষ্টা শুরু করে দিন। ওনাকে লুক আফটার করার জন্য আমি দেশপ্রেমিক আবুল হোসেন, গাছমালিক ডেসটিনি আর ভূমিমালিক হলমার্ককে বলে দেব।
অর্থ উপদেষ্টা (ফাইল দেখে) : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৪-এ ব্রেটন উডস কনফারেন্সে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংকের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণ। এই ব্যাংকের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং পুজি বিনিয়োগে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে এই ব্যাংকের সকল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এখন বিশ্ব ব্যাংকে ১৮৬ দেশের প্রতিনিধি আছে। প্রেসিডেন্ট পদে আছেন সাউথ কোরিয়ার জিম ইয়ং কিম।
বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা পরিচালনা পর্ষদে তার সঙ্গে আছেন পচিশজন একজিকিউটিভ ডিরেক্টর যারা পাচ বছরের মেয়াদে নিযুক্ত হন। তাদের সহায়তা করেন দুজন একজিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। চব্বিশজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এদের সহযোগিতা করেন চিফ ইকনমিস্ট যার কথা একটু আগেই বললাম।
বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাসকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায় ১৯৪৪ থেকে ১৯৬৮-তে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনের কাছে বিশ্ব ব্যাংক নিযুক্ত থাকে। এই লক্ষ্যে ১৯৪৭-এর মার্শাল প্ল্যানে বিশ্ব ব্যাংক সাহায্য দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০-তে রবার্ট ম্যাকনামারা যখন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে ব্যাংক নজর দেয়।
তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ বিশ্ব ব্যাংক তাদের কাঠামোগত নীতি পরিবর্তনের আওতায় সচেষ্ট থাকে এশিয়া, আফৃকা ও ল্যাটিন আমেরিকাতে কোটি কোটি শিশুর স্বাস্থ্য উন্নতি, পুষ্টি বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে।
চতুর্থ পর্যায় ১৯৮৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক সচেষ্ট থেকেছে চূড়ান্ত দারিদ্র্য ও খিদে দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, নারী-পুরুষ সমতা আনয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মাতার স্বাস্থ্য উন্নয়ন, এইডস ও ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, পরিবেশ রক্ষা এবং বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ব পার্টনারশিপ বা সহযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে।
বিশ্ব ব্যাংকের ওপর আমেরিকার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংকের বারো প্রেসিডেন্টের সবাই আমেরিকান নাগরিক। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ম কিম কোরিয়ান হলেও তার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। বিশ্ব ব্যাংকের ভোটাধিকারেও আমেরিকার প্রাধান্য আছে।
প্রধানমন্ত্রী : ভোটাধিকার পরিবর্তনের কথা আমি বলেছি। এটা বদলাতে হবে।
অর্থ উপদেষ্টা : আপনি ঠিকই বলেছেন। বর্তমান ভোটাধিকারের লিস্ট হচ্ছে :
আমেরিকা ১৬%
জাপান ৭%
চায়না ৪%
জার্মানি ৪%
ইউকে ৪%
ফ্রান্স ৪%
ইনডিয়া ৩%
রাশিয়া ৩%
সউদি আরব ৩%
ইতালি ৩%
অন্যান্য ৪৯%
আমি রাউন্ড ফিগারে বললাম। ২০১০-এ ভোটিং পাওয়ার পরিবর্তিত হবার পর বর্তমান অবস্থা এটাই।
তখন অধিকাংশ উন্নত দেশের ভোটিং পাওয়ার কমিয়ে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের ভোটিং পাওয়ার বাড়ানো হয়। এই দেশগুলো হলোÑ সাউথ কোরিয়া, টার্কি, মেক্সিকো, সিঙ্গাপুর, গৃস, ব্রাজিল, ইনডিয়া ও স্পেন। গরিব দেশ নাইজেরিয়ার ভোটিং পাওয়ার কমানো হয়। আমেরিকা, রাশিয়া ও সউদি আরবের ভোটিং পাওয়ার অপরিবর্তিত থাকে। ইউরোপিয়ান দেশগুলো ভোটিং পাওয়ার পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করেছিল।
তারা চেয়েছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরো ক্ষমতা দিতে। সে যা-ই হোক। এই পরিবর্তনের মাত্র দুই বছর পরেই আপনি আবার একটি সংস্কারের দাবি তুলেছেন। সেটা কি গ্রাহ্য হবে?
প্রধানমন্ত্রী : আলবৎ হবে। ভোটাধিকার ও তার প্রয়োগ বিষয়ে আমার চাইতে বেশি দুনিয়ার আর কেউ জানে না।
আমি সেটা জানি বলেই ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছি। যা-ই হোক। এতক্ষণ তো আপনি বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাস বয়ান করলেন। বিশ্ব ব্যাংকের কি সংস্কারের প্রস্তাব আমরা করবো সেটা তো বললেন না।
অর্থ উপদেষ্টা : বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে একটা বড় সমালোচনা হচ্ছে যদিও এটি ১৮৬টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, তবুও এটি পরিচালিত হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী গুটিকয়েক দেশ দ্বারা।
অবশ্য এরাই বিশ্ব ব্যাংকের অধিকাংশ টাকার যোগান দিয়ে থাকে। এই গুটিকয়েক দেশই বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্ব এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে কারা থাকবেন সেটা স্থির করে দেয়। তাই সেসব দেশের স্বার্থই রক্ষা করে বিশ্ব ব্যাংক। ছোট এবং গরিব দেশগুলোর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। এই সিসটেম বদলাতে হবে।
ছোট এবং গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দানের যে স্ট্র্যাটেজি বিশ্ব ব্যাংক অনুসরণ করে সেটাও বদলাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী (একটু অসহিষ্ণু স্বরে) : কিন্তু সেজন্য কি পদক্ষেপ নিতে হবে তা তো বললেন না। (প্রাইভেট সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে) আপনি দেশে মুহিত সাহেবকে ফোন করুন। তাকে বলুন বিশ্ব ব্যাংক সংস্কার বিষয়ে তার কিছু প্রস্তাব আমি জানতে চাই।
পিএস তার মোবাইল ফোন থেকে অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিষয়টি জানালেন।
তারপর মোবাইল ফোনটা প্রধানমন্ত্রীকে দিলেন।
অর্থমন্ত্রী : আমি সম্প্রতি সিলেট গিয়ে বলে এসেছি দুর্নীতি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। দ্রুত সেটা রোধ করা সম্ভব নয়। সব রাবিশ হয়ে গিয়েছে। টোটালি রাবিশ।
কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতি দ্রুত রোধ করতে হবে। নইলে আমাদের পদ্মা সেতু প্রকল্প বিলম্বিত হবে। আমার সাজেশন, বিশ্ব ব্যাংককে শুধু অর্থনীতিমুখী নয়-রাজনীতিমুখীও করতে হবে। তাই দেশে যেমন আপনার নির্দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় আমরা সম্প্রতি আরো নয়টি ব্যাংক খোলার অনুমতি দিয়েছি ঠিক তেমনি বিশ্ব ব্যাংকের বহু ব্রাঞ্চ সদস্য দেশগুলোতে খুলতে হবে। এখন সদস্য দেশগুলোতে বিশ্ব ব্যাংকের শুধু অফিস থাকে।
আপনি প্রস্তাব দিতে পারেন, ভবিষ্যতে সদস্য দেশগুলোতে শুধু অফিসই নয়, ব্রাঞ্চও যেন থাকে। যেমন, বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা ব্রাঞ্চ, বিশ্ব ব্যাংক চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চ, বিশ্ব ব্যাংক সিলেট ব্রাঞ্চ, বিশ্ব ব্যাংক খুলনা ব্রাঞ্চ ইত্যাদি। এসব ব্রাঞ্চে পাবলিক টাকা-পয়সার লেনদেন করতে পারবে। আমাদের সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ব ব্যাংককে কমার্শিয়াল অপারেশনে যাবার অনুমতি দেবে।
প্রধানমন্ত্রী : ভালো প্রস্তাব।
ধন্যবাদ। (কানেকশন কেটে দিয়ে পিএসকে) এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর সাহেবকে ফোন করুন।
গভর্নরকে কল দিয়ে পিএস মোবাইল ফোনটা আবার প্রধানমন্ত্রীকে দিলেন।
প্রধানমন্ত্রী : আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন আমি বিশ্ব ব্যাংক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি। এ বিষয়ে আপনার সাজেশন কি?
গভর্নর : প্রথম কথা আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের তুলনায় বিশ্ব ব্যাংক তো ব্যাংকই না।
ওদের কারেন্সি নোট কোথায়? আপনি প্রস্তাব দেবেন বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন নোট ছাপায় ঠিক তেমনি বিশ্ব ব্যাংককেও নোট ছাপাতে হবে এবং প্রতিটি নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী : কোন যুক্তিতে আমি ওদের নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপতে বলব?
গভর্নর : কারণ বর্তমান সময়ে বিশ্ব ব্যাংক সংস্কারের সাহসী প্রস্তাবটা দিয়েছেন একমাত্র আপনিইÑ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং বিশ্ব ব্যাংকের নোটে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির ছবি ছাপানোর প্রস্তাব অতি সঙ্গত।
প্রধানমন্ত্রী : খুবই ভালো যুক্তি। আর কোনো প্রস্তাব?
গভর্নর : হ্যা।
সম্প্রতি হলমার্ক যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সোনালী ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করেছে বলে দেশের সব মিডিয়া হাউকাউ করছে, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু প্রস্তাব করতে চাই। দি এশিয়ান ব্যাংকার নামে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন বলেছে, সোনালি ব্যাংকই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ব্যাংক। তাই আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একমত, চার হাজার কোটি টাকা কোনো ব্যাপারই না। বিশ্ব ব্যাংকের শাখা ব্যাংকগুলোকে সীমাহীন পরিমাণে ঋণ দেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। এসব ঋণের কোনো ক্লাসিফিশেন হবে না।
কোনো অডিট করা যাবে না। এসব ঋণের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দায়ী থাকবে না। এসব ঋণ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের স্থানীয় শাখা প্রধানদের ইমিউনিটি দিতে হবেÑ অর্থাৎ তাদের কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না। এসব শাখা প্রধান যাকে খুশি তাকে ঋণ দিতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী : এটা বলবো কোন যুক্তিতে?
গভর্নর : আপনি সবসময়ই জনগণের কথা ভাবেন।
জনগণের কল্যাণের কথা বলেন। জনগণ কারা? জনগণ হচ্ছে অখ্যাত গরিব মানুষেরা। যেমন ধরুন, আমার বাবার মতো চাষি, মুটে-মজুর, ফেরিওয়ালা অথবা হলমার্কের কর্ণধার তানভিরের বাবার মতো ছোট ব্যবসায়ীরা। আমাদের সোনালী ব্যাংক তানভীরকে বিনা প্রশ্নে ঋণ দিয়েছে বলেই তো হলমার্ক গ্রুপের এত দ্রুত এত উন্নতি হয়েছে। সুতরাং বিশ্ব ব্যাংক সত্যিই যদি কোনো গরিব দেশের দ্রুত উন্নতি চায় তাহলে তাদের স্থানীয় শাখা থেকে অখ্যাত গরিবদের অকাতরে ঋণ দিয়ে যেতে হবে।
এটা বিশ্ব ব্যাংকের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী : মানলাম। হ্যা। ব্যাংক হবে জনগণের জন্য। আর কোনো প্রস্তাব?
গভর্নর : বিশ্ব ব্যাংকের স্থানীয় শাখার স্টাফসহ সবারই ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে পাজেরো ও প্রাডো গিফট নেয়ার অধিকার থাকবে।
এর ফলে তারা খুশি মনে কাজ করতে পারবেন। হলমার্ক গ্রুপ বাংলাদেশে এই কালচার প্রতিষ্ঠা করে সুফল দেখিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সিভিল সার্ভিস পুলের গাড়িগুলো, এমনকি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-উপদেষ্টার গাড়িগুলোও এভাবে আসতে পারে। এর ফলে সরকারের অনেক সাশ্রয় হবে।
প্রধানমন্ত্রী : ভালো যুক্তি দিয়েছেন।
বিশ্ব ব্যাংক তো সবসময়ই পরামর্শ দেয় সরকারি খরচ কমাতে। ভর্তুকি কমাতে। আর কোনো প্রস্তাব?
গর্ভনর : সিকিউরিটি বা বন্ধক হিসাবে ঋণ গ্রহীতারা যদি সরকারি খাস জমির ভুয়া দলিল জমা দেয় এবং তার ভুয়া দাম যদি বলে, তা বিনা প্রশ্নে বিশ্ব ব্যাংকের শাখা গ্রহণ করবে। এই পদ্ধতিতে হলমার্ক গ্রুপ তাদের ব্যবসার প্রসার দ্রুত বাড়িয়েছে। জনগণ উপকৃত হয়েছে।
মনে রাখবেন, আপনি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত।
প্রধানমন্ত্রী : হ্যা। হ্যা। জনগণ। জনগণ।
আমি জনগণের প্রধানমন্ত্রী। আমাকে তো জনগণের মঙ্গলের কথা ভাবতেই হবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ গর্ভনর সাহেব। আপনি চালিয়ে যান। আপনি মুহিত সাহেবের মতো পালিয়ে যাবার কথা ভাববেন না।
আমি আপনার পদে এক্সটেনশন দেব। (লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা পিএসকে ফেরত দিলেন। তারপর অর্থ উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে) আপনারা সবাই তো অনেক সাজেশন দিলেন। কিন্তু আসল সাজেশনটাই কেউ দেননি।
অর্থ উপদেষ্টা ও পিএস (যুগ্ম স্বরে) : সেটা কি?
প্রধানমন্ত্রী : বিশ্ব ব্যাংকের সর্বস্তরে আমাদের দলের লোকজনকে বসাতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান পদে একজন বাংলাদেশিকে বসানোর প্রস্তাব আমিই দিয়েছিলাম। এ বছর ২২ ফেব্রুয়ারিতে জিন ল্যামবার্ট-এর নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যে ডেলিগেশন ঢাকায় এসেছিলেন, তাদের আমি বলেছিলাম ড. ইউনূসকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে নমিনেশন দিতে। তখন তারা ভেবেছিলেন আমি ব্যঙ্গ করে ড. ইউনূসের কথা বলেছি। না। তারা ভুল করেছিলেন।
আমি সিরিয়াসলিই বলেছিলাম। ড. ইউনূস অবশ্য পাচ দিন পরেই বিবৃতি দিয়ে আমার এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমিও হয়তো একটা ভুল করেছিলাম। ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব না করে আমাদের দলীয় মানুষ মুহিত সাহেবের নামটা প্রস্তাব করা উচিত ছিল। অথবা (অর্থ উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে) আপনার নাম।
আপনাদের দুজনারই বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। যাক, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন বিশ্ব ব্যাংক সংস্কারের প্রস্তাবনামালায় আমি জুড়ে দেব, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ড অব ডিরেক্টরস, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা প্রভৃতি ব্রাঞ্চে আওয়ামী লীগের অনুমোদিত মানুষজনকে নিয়োগ দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে আমরা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিসটেমে গতিশীলতা ও উন্নতি আনতে পেরেছি। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী-জনতা-রূপালীসহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ গোটা ব্যাংকিং সিসটেমের প্রতি জনগণের আস্থা বিশালভাবে বাড়াতে পেরেছি।
বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর সাফল্য এখন বিশ্ব ব্যাংককে অনুকরণ করতেই হবে।
অর্থ উপদেষ্টা ও পিএস (যুগ্ম স্বরে) : অসাধারণ! অসাধারণ! অসাধারণ!
অর্থ উপদেষ্টা : নেত্রী, আপনার প্রায় একশো রঙিন ছবিসহ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন শিরোনামে একটি সুভেনির বই আজ যুগপৎ নিউ ইয়র্ক ও ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছে। আপনার এসব প্রস্তাব মোতাবেক বিশ্ব ব্যাংকে সংস্কার হলে আগামী বছর আমরা বিশ্বনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন শিরোনামে বই প্রকাশ করবো। ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রী (স্বগতোক্তি) : ইনশাআল্লাহ।
এমন সময় সুইটের দরজায় টোকা পড়ল।
পিএস দরজা খুলে দিলেন।
অনেক ফুলের একটা বিরাট তোড়া হাতে ঘরে ঢুকলেন গ্র্যান্ড হায়াট হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার।
জেনারেল ম্যানেজার (প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ছোট কুর্নিশ করে) : আপনাকে একটা বিরাট সুসংবাদ জানাতে আমি নিজেই এসেছি। ইটস রিয়ালি এ গ্রেট নিউজ!
প্রধানমন্ত্রী (কৌতূহলী স্বরে) : গ্রেট নিউজ? কি সেটা?
জেনারেল ম্যানেজার (ফুলের তোড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে) : আমরা এই মাত্র খবর পেয়েছি এ বছর আপনি নোবেল প্রাইজ পাবেন!
প্রধানমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, পিএস (সমস্বরে) : আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!
জেনারেল ম্যানেজার : কোনো নোবেল বিজয়ীকে সরাসরি এভাবে খবর দেয়াটা আমার জীবনে এই প্রথম অভিজ্ঞতা।
এই দিনটি আমার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। (একটা ছোট কাগজ পিএসের হাতে দিয়ে) ঢাকা থেকে খবরটি এসেছে, এই নাম্বার থেকে। তিনি আপনাদের সরাসরি কনটাক্ট করতে পারছিলেন না। তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কংগ্রাচুলেশন্স এক্সেলেন্সি।
আবার কুর্নিশ করে জেনারেল ম্যানেজার চলে গেলেন।
কয়েক মুহূর্তে ওই সুইটের তিনজনই হতবিহ্বল থাকলেন।
পিনপতন নীরবতা ভেঙে পিএস ওই কাগজে লেখা নাম্বারে ফোন করলেন।
উৎসুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থ উপদেষ্টা।
ঢাকায় মোবাইল ফোনে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুত পিএসের চেহারা বদলে যেতে থাকলো।
কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকলো তার চেহারা।
তিনি শুধু শুনে যাচ্ছিলেন।
এক পর্যায়ে তিনি লাইনটা কেটে দিলেন।
পিএস (বিমর্ষ মুখে) : এটা সেই হাজী কামেল মিয়ার কাণ্ড। আগামী ইলেকশনে তার ছোট ছেলে নোবেল আমাদের দল থেকে প্রার্থী হতে চায়।
নোবেলকে দল ও দেশের মধ্যে সুপরিচিত করার লক্ষ্যে হাজী কামেল বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সূচনা নোবেল পুরস্কারটি তিনি আপনাকেই দিয়েছেন। এই পুরস্কার দেয়ার অনুমতির জন্যই তিনি গত কয়েক দিন যাবৎ আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইছিলেন। (একটু চুপ থেকে বিচলিতভাবে) এত বড় দুই নাম্বারি? এত বড় দুই নাম্বারি? এখন আমরা কি করবো?
প্রধানমন্ত্রী (হাসি মুখে) : কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। সারা বিশ্বে দুই নাম্বারি এখন এক নাম্বার হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে তো একটা দুই নাম্বারি তাজমহলও হয়েছে। সুতরাং দুই নাম্বার নোবেল প্রাইজও হতে পারে। আর দুই নাম্বার হলেই যে সেটা খারাপ হবে তার কোনো মানে নেই। দুই নাম্বার তাজমহল দেখতে তো প্রতিদিন মানুষ ভিড় করছে। আমাদের সরকারের প্রচেষ্টায় আমরা এই দুই নাম্বার নোবেল প্রাইজকে এক নাম্বার করতে পারবো।
(চোখ নাচিয়ে) তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আমি ক্ষমতায় থেকে যে ইলেকশন করতে যাচ্ছি, তাকে বিরোধী দলগুলো দুই নাম্বার বলবে। কিন্তু আমি ওই ইলেকশনকেও এক নাম্বার Ÿলে সারা বিশ্বে চালিয়ে দিতে পারবো। আত্মবিশ্বাস রাখুন। সাহস রাখুন। আমরা বলেছিলাম টিফিনের পয়সা বাচিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারবো।
তার দরকার হয়নি। আমার ছেলে জয় বলেছে, দুর্নীতি হয়নি বলেই পদ্মা সেতুতে ফিরতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। ঠিক তেমনই বিশ্ব ব্যাংক সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হলে এবং তার ফলে আজকের দুই নাম্বার বিশ্ব ব্যাংক এক নাম্বার হলে, নোবেল প্রাইজ কমিটিও বাধ্য হবে আমাকে ইকনমিক্সে নোবেল প্রাইজ দিতে।
অর্থ উপদেষ্টা ও পিএস (যুগ্ম স্বরে) : ইনশাআল্লাহ!
১ অক্টোবর ২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।