প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় আমার ভাবনা গুলো, মাঝে মাঝে ওদের ছুঁতে পারি, মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি...
মীরা আর বন্যা ক্লাস শেষে শপিংমলে ঘুরতে এসেছে। বন্যা তার বোনের জন্যে শাড়ি কিনবে। মেট্রো শপিংমলের শো-রুম গুলো থেকে ওরা দেখা শুরু করেছে। অন্যমেলা, কে-ক্রাফট ছাড়াও এই রোডে বেশ কিছু শো-রুম রয়েছে। কে-ক্রাফটে মীরা একটি পুতুলের গায়ে বিয়ের শাড়ি দেখে বন্যাকে প্রায় খামচে ধরে।
ফিসফিস করে বলে, ‘দেখ,শাড়িটা কি সুন্দর’! বন্যা বন্ধুর অবস্থা দেখে মুচকি হাসে, ও জানে শাড়ি মীরার খুব পছন্দের পোশাক, অথচ বেচারী শাড়ি পরতে পারে না। মীরার মায়ের কি অদ্ভুত খেয়াল, ওকে শাড়ি পরতে দেয়না। তিনি মনে করেন শাড়ি বিবাহিত মেয়েদের পোশাক। তাই মীরা কোন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরতে চাইলে তিনি বরাবরই বিরক্তি বোধ করেন। মীরা ঠিক করে রেখেছে বিয়ের পর সে সবসময় শাড়ি পরবে।
এই পোশাকটিকে ঘিরে তার কিছু অদ্ভুত রোমান্টিক স্বপ্ন আছে।
ক’দিন আগে পারিবারিকভাবে মীরার এনগেজমেন্ট হয়েছে। মাসখানিক পর বিয়ে। এ কারনেই বিয়ের শাড়ি দেখে সে উত্তেজিত হয়ে পরেছে। শাড়িটা আনকমন, শাড়ির চেয়েও বেশি সুন্দর ওড়নাটা।
ঠিক যেন পুতুলের পোশাক, মীরার মনে হচ্ছে এই শাড়ি পরলে তাকেও পুতুলের মত দেখাবে। ও বারবার শাড়িটা ছুঁয়ে দেখছে আর বন্যার মতামত জানতে চাইছে। একপর্যায়ে বন্যা বলেই ফেলে, ‘তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে,এই শাড়ি তুই কিনবিই’। মীরা হাসি মুখে বলে, ‘সমস্যা কি? শাড়ি তো ওরা ২টা কিনবে, বিয়ের শাড়িটা না হয় আমার পছন্দমত কিনলো। তুই কি বলিস, এই শাড়িতে আমাকে ভাল লাগবে না?’ হাসতে হাসতে বন্যা উত্তর দেয়, ‘তোর বরকে বল তাড়াতাড়ি কিনে ফেলতে, শো-রুমের শাড়ি বেশিদিন থাকে না, বিক্রি হয়ে যায়’।
অনেকক্ষণ ওদেরকে শাড়িটা নিয়ে কথা বলতে দেখে একজন সেলসগার্ল এগিয়ে আসে, জানায় এই শাড়িটা ১পিচ-ই আছে। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাদের দু’জনের মাঝে কার বিয়ে’? প্রশ্ন শুনে মীরা লজ্জায় লাল নীল হতে থাকে।
রাতে তমালের সাথে কথা বলার সময় মীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, শাড়িটার কথা কি করে বলবে। সুযোগটা একসময় তমালই করে দেয়,বলে-
‘আপু ঠিক করেছে কাল পরশুর মধ্যে বিয়ে এবং বৌভাতের শাড়ি দুটো কিনে ফেলবে। তোমাকে ফোন করবে, তুমি শপিংমলে চলে এসো’।
‘আচ্ছা’- বলে সংকুচিত কণ্ঠে মীরা বলে, ‘ আজ কে-ক্রাফটে একটা বিয়ের শাড়ি দেখলাম। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমরা কি শাড়ি কেনার আগে ঐ শাড়িটা একবার দেখবে’?
‘ঠিক আছে দেখবো। প্রাইজ কত শাড়িটার’?- আগ্রহ ফুটে উঠে তমালের কণ্ঠে।
‘প্রাইজ মোটামুটি।
শাড়িটার ১২ হাজার টাকা আর ওড়নাটার ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১৭ হাজার টাকা। – কথাটা বলতে পেরে চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ে মীরা। খুশিতে ওর মনটা ভরে উঠে। যাক, অবশেষে কথাটা তো বলতে পেরেছে।
কিন্তু পরক্ষনেই ওর খুশি উধাও হয়ে যায় তমালের হো হো হাসির শব্দে। ও ঠিক বুঝতে পারে না তমাল এমন করে হাসছে কেন। কোনরকমে হাসি থামিয়ে তমাল বলে, ‘১২ হাজার টাকার শাড়ি’। আবার হাসি। ‘মীরা, তুমি কি করে ভাবলে এত সস্তা শাড়ি তোমার জন্যে কেনা হবে? শাড়ির জন্য বাজেট কমপক্ষে ৭০-৮০ হাজার টাকা।
সেখানে তুমি ১২ হাজার টাকা দামের শাড়ি কিনতে চাচ্ছো’।
মীরা চুপ হয়ে যায়। কখন যে চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করে ও নিজেও বলতে পারবে না। তমালের কণ্ঠে শাড়িটা নিয়ে এমন অবহেলা ছিল......। সারাটা রাত বুকের মাঝে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করে মীরা।
এ যেন ওর প্রথম স্বপ্নভঙ্গ। শাড়িটাকে ঘিরে একটু বেশিই স্বপ্ন হয়তো সে দেখে ফেলেছিল।
বিয়ের আর মাত্র ৭ দিন বাকী। ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তমাল খুব উচ্ছ্বসিত।
মীরার চাপা স্বভাবের কারনে ওর উচ্ছ্বাস তমাল দেখতে পায় না। মাঝে মাঝেই তমাল বলে, ‘আমার আশ্চর্য লাগে, তোমার মাঝে কোন উচ্ছ্বাস নেই কেন’? দেশি শাড়ির প্রতি মীরার খুব দুর্বলতা। ও কিছু টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনেছে। মাঝে মাঝে বাসায় পরবে। রাত হলেই সে তার নতুন জীবনকে নিয়ে স্বপ্নের দুয়ার খুলে বসে।
ও ঠিক করে রেখেছে মাঝে মাঝে এক প্যাঁচে গ্রাম্য মেয়েদের মত শাড়ি পরবে। চুলে কখনও করবে খোঁপা, কখনো বা থাকবে এলোচুলে। সবসময় চুলে ফুল গুঁজবে। শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে অনেক কাঁচের চুড়ি কিনেছে সে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ চুড়িগুলোর টুং টাং শব্দে ওর মনটা নেচে উঠে।
ফোনের রিংটোনের শব্দে মীরা বাস্তবে ফিরে আসে। ফোনের অন্যপ্রান্তে তমাল।
‘কি করছো’? –তমাল জানতে চায়।
‘কিছু না, এমনি বসে ছিলাম’। - মীরা মনে মনে ভাবে, ওর সব কল্পনার কথা বিয়ের পর তমালকে জানাবে।
তমাল নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে, খুশিও হবে।
‘হানিমুনে কোথায় যাওয়া যায়, বলতো’? –তমাল খুব উৎসুক।
‘শোন, বিয়ের পর আমি সবসময় শাড়ি পরবো’। -মীরা কথা ঘুরাতে চায়। এ বিষয়ে কথা বলতে কেন জানি লজ্জা লাগে।
‘শাড়ি কেন পরবে? আশ্চর্য! আমার আপু, ভাবী কেউ বাসায় শাড়ি পরে না। আর বিয়ের পর তো আমরা আমার অফিসের ফ্লাটে উঠবো, সেখানে তুমি স্কাট, টপস, ট্রাউজার যা খুশি পরতে পারো। শাড়ি পরতে হবে কেন? এসব গ্রাম্য মেন্টালিটি আমার বা আমার পরিবারের কারো নেই’। -একটানা কথা বলার পর থামে তমাল।
৩ বৎসর পর...
বাসায় কেউ নেই।
আলমিরা থেকে সব কাপড় বের করে মীরা গুছাতে বসেছে। তার অনেক দামী পোশাকের মাঝে সেই টাঙ্গাইল শাড়ি আর চুড়ির বাক্সটাও পড়ে আছে। শাড়িগুলো মীরা একদিনও পরেনি। সেই দিনের পর তমালের সাথে মীরা শাড়ি নিয়ে কোন কথা বলেনি। আলমিরার এককোনে সেই শাড়িগুলো থেকে ধূলো ঝেড়ে রেখে দেয়, রেখে দেয় চুড়িগুলোও – যে চুড়ি কোনদিন তার হাতের স্পর্শ পায়নি।
View this link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।