আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেবেলার লাটিম ঘুড়ি (আমার ঈদ)

https://www.facebook.com/tanvir.mh ২৯ রমজানের ইফতারের পর চারপাশের গ্রাম থেকে চিৎকার শুরু হয়ে যেতো। “ঐ ঈদের চাঁদ দেখা গেছেরে চাঁদ দেখা গেছে”। গ্রামে পিচ্চি বাচ্চাদের একটা চাঁদ দেখা কমিটি ছিল। তাদের কাজ ছিল ২৯ রমজানের ইফতারের পর চাঁদ দেখা গেলেও তারা চিল্লাবে না দেখা গেলেও। ইফতার খেয়েই দৌড়ে নদীর পার চলে যেতাম হাতে চপ অথবা জিলাপি নিয়ে।

কিন্তু সেই তখনকার ৩ ফুট উচ্চতা নিয়ে চোখে শুধু পাট ক্ষেতের উপরের অংশ দেখা যেতো, তার থেকে বহু উপরে পাশের গ্রামের বাশ বাগানের মাথার উপর উঠে থাকা চাঁদ দেখা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। বড় ভাইয়ারা আমাদের কোলে তুলে চাঁদ দেখাতো তবে কোলে বেশিক্ষন রাখতনা। তার কারণে চাঁদ ঠিক মত না দেখেই বলতাম হা দেখেছি। কাচির মত চিকন এক চাঁদ। তারপর চাঁদ দেখা কমিটিদের সাথে মিশে গিয়ে চিৎকার শুরু করতাম।

সেইদিন জোরে জোরে আওয়াজ করলেও এলাকার গুরুজনরা কিছু বলতো না। আর চাঁদ না উঠলে হতাশা ঘিরে ধরতো। আবার তারাবি নামাজ আবার আরও একটা দিন। বাসায় গিয়ে সবাইকে জানাতেও পারবোনা যে যে চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখা গেলে বাসায় গিয়ে আগে জানানোর বাধ ভাঙ্গা ইচ্ছা রেখে দৌড় দিতাম কিন্তু বাসায় এসে দেখি বেরসিক বিটিভি আগেই বাসার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।

সামান্য হতাশায় পড়ে যেতাম। কিন্তু বিটিভির “রমজানের ও রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটা বাজা মাত্রই ঈদের আনন্দ শরীরে ডুকা শুরু করতো। গান বাজনা সব শুরু হয়ে যেতো। মনে হতো এখনই ঘুমিয়ে যাই তাহলেই তো সকাল হয়ে যাবে। আব্বা সেমাই থেকে শুরু করে সব নিয়ে আসতো বাসায়।

ঘুমাতে ঘুমাতে কত চিন্তা। কখন পড়বো সেই কাঙ্ক্ষিত ঈদের জামা। রাতে ঘুম হোক আর না হোক ঈদের অস্থিরতায় সকাল ৬টায় ঘুম ভেঙ্গে যেতো। গোসলের সিরিয়ালে ঐদিন খুব দ্রুতই পাঠিয়ে দিতো আম্মা। ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রার গরম পানি দিয়ে গোসল করলেও ঠাণ্ডায় শরীর জড়িয়ে আসতো।

এখন মিষ্টি মুখের পালা। টেবিলে বসতেই যতদূর চোখ যায় শুধু পিঠা আর পিঠা। ময়মনসিংহ আর কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মহিলারা এত নিপুন কারুকাজে পিঠা বানাতে পারে তা এই অঞ্চলে না জন্মালে বুজতেই পারতাম না। সেমাই থেকে শুরু করে সব পিঠা একটা একটা করে খেতাম,যেটায় চিনি থাকতো বেশি সেটা বেশি ভালো লাগতো কারণ তখনও টক ঝালের মজা বুজিনি। আলমারি থেকে আমার শার্ট আর প্যান্ট বের করে দিলো আম্মা।

আব্বা আর ভাইয়া পাঞ্জাবী পড়লেও আমার কাছে তখন ওটা বুড়া মানুষের জামা মনে হতো। কাপড়ের গন্ধ শুকে আস্তে আস্তে পড়ে ফেললাম। নতুন কাপড়ের গন্ধ দুনিয়ার সব থেকে প্রিয় গন্ধ ছিল তখন। জাম্প কেটস আর শার্ট প্যান্ট পড়ে এখন নামাজের ঠিক আগ মুহূর্তে শোডাউন এর পালা। কোন ফ্যাশান শো থেকে কোন অংশে কম ছিলনা আমাদের কাজকর্ম।

সব বন্ধুরা বের হতাম যার যার বাসায়,এক উপলক্ষে নিজের কাপড়টাও দেখিয়ে আসতাম আর এক চামচ মিষ্টি খেতে খেতে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলতাম নিজের কাপড়ের ব্যাপারে। আবার বাসায় ফিরে নামাজে যাওয়ার তাড়া। আম্মা ইশারা করতো আব্বাকে সালাম করার জন্য। কিন্তু লজ্জায় না করে যেতাম। ভাইয়া যখন আব্বা আম্মা ২ জনকেই সালাম করতো তখন তার দেখাদেখি আমাকেও করে ফেলতে হতো।

পকেটে একশো টাকার চকচকে একটা নোট এসে পড়তো সালামের বদৌলতে। মনে হতো দুনিয়া কিনে ফেলার টাকা পেয়ে গেলাম। ৩ থেকে ৪ টা জায়নামাজ হাতে নিয়ে ঈদগাহ এর দিকে রওনা হই। ছোট থাকার কারনে মাঝখানে বসতে পারতাম না। লাইনের একদম কোনায় বসতে হতো।

কি এক আজব নিয়ম বয়স ভিত্তিক উচ্চতা ভিত্তিক বৈষম্য। হুজুর লেকচার দিয়ে যেতো রোজা না রেখে নামাজ পড়তে আসছেন যারা তাদের লজ্জা হওয়া উচিত। পাশের ফ্রেন্ড সেলিমকে কে বলতাম আমি ১৪ টা রাখছি তুই কয়টা? আমি একটাও না তবে ৩০ রমজান হলে একটা রাখতাম আর আমার মনডা কয় হুজুরেও রোজা রাখেনাই। যা ব্যাটা। নামাজ শুরু হয়ে গেলো।

আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে হাত নামানো উঠানো শুরু সবার। পাশের জন যা করতো তাই করতাম কারণ কখন হাত বাধতে হবে কখন ছেড়ে দিতে হবে তা জানতাম না। আজও জানিনা। বিশাল বড় দোয়া হতো,হুজুরের রাব্বির হাম হুমা ধ্বনিতে সবার চোখের জল বেরিয়ে যেতো। নামাজ শেষ এখন কোলাকুলির সময়।

বড় ভাইদের কোলেই উঠে যেতাম আর আমরা বন্ধুরা কেন যেন কোলাকুলি তখন করতাম না। দাদা দাদির কবর জিয়ারত হতো বছরে ২ দিন। আজ সেই ২দিনের প্রথম দিন। সেখানেও কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেতো। ভাবতাম ঈদের দিন এত আবেগ দেখানোর কি দরকার।

কবর জিয়ারত শেষে সব আত্মীয় দের বাসায় একবার হলেও চেহারা দেখাতে হবে। কিন্তু পরিবারের কাছ থেকে কোনও রকম ছুটে গিয়ে ঈদের মেলাতে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে। ৮টাকার হেলিকপ্টার ২টাকার বেলুন কিনতাম ৭টাকা দিয়ে সেভেন আপ খেতাম। । মনে মনে ভাবতাম শালা একশো টাকা শেষ করবো কিভাবে!! এলাকার রাস্তায় আজ মানুষ আর মানুষ।

সুন্দরী বড় বোনদের আজ উদ্ভট লাগছে। হাই হিল পড়ে রঙ বেরঙের জামা পড়ে নিজের আসল রুপ লুকিয়ে ফেলেছে। কিছুদূর হাটার পরই দেখতাম হিলের জুতাটা হাতে নিয়ে হাঁটছে। আমাদের ছোটবেলায় ঈদের দিন সিনেমা হলে সিনেমা দেখার নিয়ম ছিল। অনেক বন্ধুরাই যেতো কিন্তু বাসা থেকে অনুমতি ছিলনা বলে কখনই যেতে পারতাম না।

দুপুর বেলা মুরগীর রোষ্ট থেকে শুরু করে খাসি গরু ইলিশ পোলাও সহ সব খাবার খেতাম একসাথে অনেক মানুষ। ঈদের আনন্দে যেন পরিবারটা আজ যৌথ পরিবার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতাম কারণ আজ বিটিভিতে সিনেমা একটু আগে দিবে। টিভি খুলতেই গান বেজে উঠতো “তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই”সালমান শাহ্‌র মুভি দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। আস্তে আস্তে মন খারাপ হওয়া শুরু ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা মানে ঈদ শেষ হয়ে যাওয়া। তবু বিটিভির ৩দিনের অনুস্টান ঈদের আনন্দ জীবিত রাখতো। ক্রিকেট খেলা বন্ধ রেখে ৩ দিন টিভিই দেখতাম। একদিন সেই ৩দিন ও শেষ হয়ে যেতো। আমার ঈদের জামাটাও ধুয়ে ফেলা হতো।

ভাইয়া ঢাকা চলে যেতো আমারও স্কুল শুরু হয়ে যেতো। আবার অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু করতাম কবে আসবে ঈদ। তানভীর মাহমুদুল হাসান  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।