আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছন্দের ক্লাস: যারা কবিতার ছন্দ শিখতে চান তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য - ২

জোরে-সোরে মহব্বতের সাথে স্বপ্ন দেখুন। স্বপ্নই সম্ভাবনা। “A dream you dream alone is only a dream. A dream we dream together is reality”.

কলাবৃত্ত যারা আগের ক্লাসে গরহাজির ছিলেন। প্রথমে সেখান হাজিরা দিয়ে আসেন। বুঝতে সুবিধা হবে।

এই রীতির ছন্দে প্রতি মুক্তদলই হ্রস্বদল। অর্থাৎ এক কলা মাত্রা। অন্যদিকে প্রতি রুদ্ধদলই এই রীতিতে প্রসারিত হয়। সুতরাং প্রতি রুদ্ধদলই দীর্ঘদল, অর্থাৎ দুই কলা মাত্রা। সংক্ষেপে – মুক্তদল = ১ মাত্রা রুদ্ধদল = ২ মাত্রা।

উদাহরণঃ অন্যদিকে = অন্+ন+দি+কে = ২+১+১+১ = ৫ মাত্রা যুক্তাক্ষর = যুক্+তাক্+ক্ষর্ = ২+২+২ = ৬ মাত্রা কলাবৃত্ত ছন্দে আরেকভাবে আমরা মাত্রা হিসাব করতে পারি। প্রতি অক্ষর = ১ মাত্রা প্রতি যুক্তাক্ষর = ২ মাত্রা উদাহরণঃ অন্যদিকে = ১+২+১+১ = ৫ মাত্রা যুক্তাক্ষর = ১+২+২+১ = ৬ মাত্রা তবে শর্ত এই যুক্তাক্ষরটি শব্দের মধ্যে কিংবা শেষে থাকা চাই। এবং তার পূর্বের বর্ণটি হস্ বিহীন হওয়া চাই। শব্দের যুক্তাক্ষরটি শব্দের মধ্যে কিংবা শেষে থাকা সত্ত্বেও যুক্তাক্ষর দু’মাত্রার মূল্য পায় না যদি সেই যুক্তাক্ষরটির পূর্ববর্তী বর্ণটি হয় হস্ বর্ণ। যেমন – ট্রান্ স্লেশন।

এক্ষেত্রে স্ল যুক্তাক্ষরটি শব্দের মধ্যে – যেহেতু তার পূর্ববর্তী বর্ণটি হস্ বর্ণ তাই দু মাত্রার মূল্য পাচ্ছে না। সংশ্লেষ ও তাই; সংশ্লেষ= সঙ্ +শ্লে+ষ= ২+১+১= ৪ মাত্রা কিন্তু আশ্লেষ = আ+শ্লে+ষ =১+২+১= ৪ মাত্রা (অক্ষরের হিসাবে) আশ্ + লেষ্ = ২+২= ৪ মাত্রা (দলের হিসাবে) ** যুক্তস্বরঃ ঐ ঔ শব্দের যেখানেই থাকুক দু মাত্রা। ** ব্যাতিক্রমঃ শব্দের আদিতে যুক্তস্বর থাকলে এবং তার ঠিক পরেই যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তারা দুয়ে মিলে ২+২ = ৪ মাত্রার মূল্য পায় না। দৈন্যকে কেন আর সৈন্যে সাজাও চৈত্রে মৈত্রী চায় পাষণ্ডেরাও। (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) কলাবৃত্তের নিয়মানুযায়ী দৈন্য সৈন্যে চৈত্রে মৈত্রী শব্দগুলি চার মাত্রার হওয়া উচিত, কিন্তু কেউই তারা এখানে ৩ মাত্রার বেশি মূল্য পাচ্ছে না।

রৌদ্র, বৌদ্ধ, ঔদ্ধত্য ইত্যাদিতেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। এই নিয়মে চৈত্র আর চৈতী একই মাত্রামূল্য পায়। চৈত্র=চৈৎ+র=২+১= ৩ মাত্রা আর চৈতী=চৈ/চোই+তী= ২+১ = ৩ মাত্রা ** আসেন এবার একটু চিন্তার সুযোগ করে দেইঃ চৈত্র=চ+ইৎ+র=১+২+১= ৪ মাত্রা দৈন্য = দ+ইন্+ন= ১+২+১= ৪ মাত্রা। উচ্চারণের নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে আমরা কি এভাবে দল বিভাজন দেখিয়ে মাত্রা বিশ্লেষণ করতে পারি? উত্তরঃ কলাবৃত্তের ঝোঁক যেহেতু বিশ্লেষের দিকে, প্রসারণের দিকে, ভাঙার দিকে সেহেতু কবি তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়ে এভাবে বিশ্লেষণ করে যদি সুবিধা পান তবে তাই সই। দলবৃত্তে আমরা দেখেছি প্রতি পর্বে ৪-মাত্রার চাল।

কিন্তু কলাবৃত্তের চাল মোট চার রকমেরঃ- ৪-মাত্রার চাল, ৫-মাত্রার চাল, ৬-মাত্রার চাল, ৭-মাত্রার চাল। ৪-মাত্রা চালের উদাহরণঃ ১) কল্লোলে/ কোলাহলে/ জাগে এক/ ধ্বনি, অন্ধের/ কণ্ঠের/ গান আগ/মনী। (আগমনী # চিত্রবিচিত্র- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ২) সুন্দরী/ তুমি শুক/তারা সুদূর শৈল শিখ/রান্তে (শৈল-কে ভেঙে দেখানো গেল না, কারণ শৈ= শই্) শর্বরী/ যবে হবে/ সারা দর্শন/ দিয়ো দিগ/ভ্রান্তে। (রবীন্দ্রনাথ) ৩) পূর্ণিমা/ রাত্রের/ জ্যোৎস্না ধা/রায় সান্ধ্য ব/সুন্ধরা তন্দ্রা হা/রায়। *জ্যোত্+স্না = ২+১, স্না এর পূর্ববর্তী বর্ণটি হস্ বর্ণ তাই স্না দু মাত্রার মূল্য পাচ্ছে না।

তন্দ্রার বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। ৪) যেখানে সে বুড়ো বট নামায়ে দিয়াছে জট ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে, যেখানে বনের কাছে বনদেবতারা নাচে চাঁদনিতে রুনুঝুনু নূপুরে। (ঘুমচোর # শিশু - রবীন্দ্রনাথ) ৫-মাত্রার চালের উদাহরণঃ ১) কোথায় কবে আছিলে জাগি, বিরহ তব কাহার লাগি, কোন সে তব প্রিয়া ইন্দ্র তুমি, তোমার শচী, জানি তাহারে তুলেছ রচি আপন মায়া দিয়া। (পাঠিকা # বীথিকা - রবীন্দ্রনাথ) ২) আসতে-যেতে এখনো তুলি চোখ, রেলিঙে আর দেখি না নীল শাড়ি। কোথায় যেন জমেছে কিছু শোক, ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি।

এখন সব স্তব্ধ নিরালোক; অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি। (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) ৫ মাত্রা মূলত ৩+২ তবে একান্তই যদি দরকার হয় ২+৩ করতে পারেন। কিন্তু শর্ত একটাই - আপনার কান সায় দিচ্ছে কিনা। একটি দৃষ্টান্তঃ বাতাসে যেন/ চাপা বেদনা/ লাগে। উচ্চারণের সময় ৩+২ এর আবেদনেই চাপা বেদনা চাপাবে দনা হয়ে যাচ্ছে।

ফলে আমাদের ছন্দের চাল ঠিক থাকার সুযোগ পাচ্ছে। মনে রাখতে হবে সব হিসাবের বড় হিসাব হচ্ছে আপনার কানের হিসাব। তাই বলে আপনি যদি ভুল উচ্চারণ করেন তার দায় কিন্তু আমি নেব না। ৬-মাত্রার চালের উদাহরণঃ ১) চক্ষে তোমার কিছু বা করুণা ভাসে, ওষ্ঠে তোমার কিছু কৌতুক হাসে, মৌনে তোমার কিছু লাগে মৃদু সুর, আলো-আঁধারের বন্ধনে আমি বাঁধা, আশা-নিরাশায় হৃদয়ে নিত্য ধাঁধা, সঙ্গ যা পাই তারি মাঝে রহে দূর। (ঈষৎ দয়া # বীথিকা - রবীন্দ্রনাথ) ২) বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা, প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে কি মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা।

(রৌদ্রের গান # ঘুম নেই – সুকান্ত) ৭-মাত্রার চালের উদাহরণঃ ১) বন্ধু বুঝি নাই তুমি যে নিষ্ঠুর পাথর ভেঙে যায় যাক যতই কাছে থাক নাগাল বহুদূর সাত-সমুদ্রের ফাঁক। পাষাণ ভেঙে যায় পাহাড় টলে যায় পাথরাধিক তুমি স্থির ছুটছে মহাকাল সময় চলে যায় নিখোঁজ সাগরের তীর। স্বপ্ন বুকে নিয়ে আকুল ভেসে চলি কোথায় সৈকত-ভূমি ব্যাকুল ভালবাসা একাকী বেসে চলি এ আমার গোঁয়ার্তুমি। ২) কে যেন বারেবারে তার পুরনো নাম ধরে ডাকে, বেড়ায় পায়ে-পায়ে, আর কাঁধের পরে হাত রাখে। অথচ খাঁখাঁ চারিধার, ঠাণ্ডা চাঁদ চেয়ে থাকে; ও-হাতখানি তবে কার, কে তবে ডাক দিল তাকে? (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) কলাবৃত্তের পাঠ এখানেই শেষ।

তবে আবারও শিক্ষার্থীদেরকে মনে করিয়ে দেয়া কর্তব্য মনেকরছি যে ছন্দের বিচারে কানই সুপ্রিম কোর্ট।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.