স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাঁচ বন্ধু ঝালমুড়ি খেতে খেতে অপেক্ষা করছে মোতালেব স্যারের জন্য। শেষ পিরিয়ডে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মোতালেব স্যার, পূর্ব নির্ধারিত ক্লাসের বদলে ছাত্রদের নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বৃক্ষ রোপণ করবেন বলে ঠিক করেছেন। এই নিয়ে পাঁচ বন্ধু সুমিত, বন্যা, ইমরান, ক্রিস্টোফার আর পলাশের আনন্দের সীমা নেই। স্যারের বিরক্তিকর ক্লাসের চেয়ে এই বেশ ভালো, অন্তত পড়ালেখার ঝামেলা নেই। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে সংবাদটি এলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেও।
স্কুলের কোন এক কাজে মোতালেব স্যারকে বাইরে যেতে হচ্ছে, তার বদলে শ্রুতলিপির ক্লাস করাবেন রমা ম্যাডাম। একেতো এটি তাদের সবচেয়ে অপছন্দের ক্লাস তার উপর রমা ম্যাডাম, যিনি চুন থেকে পান খসলেই বেঞ্চের উপর দাড় করিয়ে দুই হাত দিয়ে পায়ের দুই বুড়ো আঙুল ধরিয়ে রেখে শাস্তি দেন। কোন রকম নড়াচড়া বা বাঁকা হলেই পশ্চাদ দেশে বেত দিয়ে দেন সজোরে ঘা। মানে গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিলো ইমরানের।
ম্যাডাম এর এমন কোন ক্লাস নেই, যে ওরা এই শাস্তি পায় না। তাই আজো তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু আজ তারা এই স্বাভাবিক নিয়মটিকে মেনে নিতে পারছে না কোনভাবেই। হঠাৎ বন্যার মাথায় ক্লাস ফাঁকির বুদ্ধি এলো, কিন্তু তাদের পলায়ন পর্বে ঝামেলা পাকাবে ওই বুড়ো দারোয়ান, যে সবসময় কাঁঠালের আঠার মত লেগে থাকে মূল গেইটের সাথে, আর তার চোখকে ফাঁকি দেয়, কার সাধ্যি? কিন্তু কিভাবে পালাবে? স্কুলের চারদিকে তো উচু পাচিল যেটা টপকানো এই মুহূর্তে অসম্ভব। অতঃপর সবাই মিলে ঠিক করলো, স্কুলের পেছনের যে অংশটিতে ঝোপঝাড় আর বাগানের মাঝে একটি ছোট গবেষণাগার আছে, সেখানেই গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে।
আর স্কুল ছুটির ঘণ্টা পড়লেই সবার সাথে বেড়িয়ে যাবে। সচরাচর ওই দিকটায় এই সময় কেও যায় না, তাই লুকিয়ে থাকার জন্য মোক্ষম জায়গা বটে। যেই ভাবনা সেই কাজ, ম্যাডাম আসার আগেই সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে পড়ল ওরা। গবেষণাগারের দরজাটি খোলাই ছিল, বুড়ো দারোয়ান এর একটি কক্ষ ব্যাবহার করেন। আর এই গবেষণাগারে এমন কিছু নেই যা চুরি হবার মত।
গবেষণাগারে ঢুকে কেও চুপচাপ বসে থাকল না। যে যার মত কিছু না কিছু করা শুরু করেছে। সুমিত বড়ুয়া, ডাকনাম দেশ। বন্ধুরা সবাই সবাইকে ডাকনামে ডাকে। স্বভাবে কিছুটা শান্ত ও উদাসীন হলেও নিজের শখের জিনিসের প্রতি তার খুঁতখুঁতে ও কঠোর মনোভাব সবার জানা।
দেশের বাবা সুইজারল্যান্ড থেকে তার জন্য একটি সুইস ঘড়ি পাঠান, যেটাকে সে মিনিটে মিনিটে পরিস্কার করে আর কেও তা দেখতে চাইলে অন্য হাতের মুঠির ভেতর দিয়ে এমন ভাবে দেখায় যেন ঘড়িটার দুটো পাখা আছে আর তা ছাড়া পেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে। তাই সবাই ওই ঘড়ির নাম দিয়েছে ‘সম্পদ’। ‘দেশের সম্পদ’। ইমরান হোসেন, ডাকনাম ভূমি। ঘরের ভেতর ঢুকে একটি হারিকেন খুঁজে পেলো সে।
হাতে করে হারিকেনটি নিয়ে এসে দেশকে বলল,
দেশ চল এটা দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলি।
তোর কি মাথা খারাপ? এটা দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ?
শোন, এটা দিয়ে যদি ক্যাচ প্র্যাকটিস করিস তাহলে দেখবি ক্রিকেট খেলায় আমরা আর ক্যাচ মিস করবো না।
ঠিক আছে, সাবধানে কিন্তু;
দেশ আর ভূমি ক্যাচ ক্যাচ খেলতে খেলতে হঠাৎ দেশের হাত ফসকে হারিকেনটি ঘড়িতে পড়ল আর অমনি ঘড়ি গেলো ভেঙ্গে। দেশকে অসহায় ভাবে মাথায় হাত দিয়ে ভাঙ্গা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে ভূমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করেই সেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।
বন্যা সেন, ডাকনাম বন্যা।
বাগানের ধারে টেপ থেকে বালতিতে পানি পড়তে দেখে সেই পানি ন্যাড়া বাগানে ঢালবে বলে ঠিক করলো। পানি ঢালতেই সে দেখল মাটির উপর কিছু দানা ছড়িয়ে আছে। বুঝল দারোয়ানের লাগানো সবজি বিচি! সব ভেসে গেছে।
এদিকে ভূমি অন্য একটি ঘরে গিয়ে দেখল, কিছু তাঁর পরিত্যক্ত অবস্থায় ঝুলছে, তাঁর গুলোর একটি অংশ বৈদ্যুতিক বোর্ডে লাগানো। যেই ভুমির হাত তাঁর স্পর্শ করলো অমনি বৈদ্যুতিক শকে সে হাত পা ছুড়ে কাঁপতে লাগলো।
ভূমি কম্পনরত অবস্থায় হাত ছুড়তেই তার হাতের ঝটকায় টেবিলের উপর রাখা মাটির কিছু ডেমো ঘরবাড়ি দালানকোঠা মাটিতেই পড়ে ভেঙ্গে গেলো। কোনোরকমে এই যাত্রায় বেঁচে গেলো সে।
ক্রিস্টোফার হালদার, ডাকনাম নেই। কিন্তু সে নিজেকে অনেক স্মার্ট ভাবে, নিজের সুনাম নিজেই করে বলে সবাই তার নাম দিয়েছে “সুনামি”। গবেষণাগারের এক কোণে যেখানে একটি বাথট্যাব আছে, আর সেই বাথট্যাব যেটি কোন এক সময় মাছ সংরক্ষনে ব্যাবহার হোতো তার পাশে দাঁড়িয়ে সুনামি ভাবতে লাগলো, এটাতে নেমে পানিতে কিছুক্ষন হাত পা ছুড়লে মন্দ হয় না।
দ্বিতীয়বার না ভেবেই সে তাতে নেমে পড়ে হাত পা ছুড়ে পুরো বাথট্যাবের পানিতে ঘর ভাসিয়ে দিলো। ভূমি এসব দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
কিরে, এসব কি করছিস?
কিছুনা, এটাকে বলে জলে উল্লাস, মানে এককথায় জলোচ্ছ্বাস।
পলাশ আহমেদ, অনেক মোটা কালো আর বিশাল শরীরের অধিকারি বলে সবাই তার নাম দিয়েছে “কালা পাহাড়”। এখন ওটাই ওর ডাকনাম। কালা পাহাড় একটি নড়বড়ে টুলের উপর দাঁড়িয়ে শেলফ থেকে বই দেখছে।
হঠাৎ সেই টুল ভেঙ্গে কালা পাহাড় পড়ে গেলো নিচে। মাটিতে রাখা ছন, বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কিছু ডেমো ঘর তার শরীরের নিচে চাপা পড়ে নিমিষেই চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। সেই ঘর গুলো হাতে তুলে নিয়ে কালা পাহাড় দেখতে পেলো তাতে লেখা, বস্তি ঘর। আর তার ভেতর একটি পুতুল যার গায়ে লেখা বস্তিবাসী।
অন্যদিকে রমা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই উপস্থিতি খাতায় আগের ক্লাসে ওই পাঁচজনের নাম দেখে সবাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন তারা এই ক্লাসে সবাই পালিয়েছে।
তাই তিনি আর দেরি না করেই তাদের খুঁজতে বেড়িয়ে পরেছিলেন। গরু খোঁজা খুঁজে অবশেষে তিনি গবেষণাগারে এসে গোপনে তাদের এই কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। পরিশেষে যখন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো তখন তিনি সবাইকে কান ধড়িয়ে প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রধান শিক্ষক সব কিছু শুনে, রমা ম্যাডামকেই প্রধান করে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। এবং তিনি ম্যাডামকে নির্দেশ দিলেন কাল সকালেই ‘এক কথায়’ মানে অতি সংক্ষেপে লিখে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
পরদিন প্রত্যুষে রমা ম্যাডাম প্রধান শিক্ষককে তার তদন্ত রিপোর্ট জমা দিলেন। আর তাতে লেখা আছে,
১। হ্যারিকেনের আঘাতে দেশের সম্পদ বিনষ্ট
২। বন্যার জলে ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
৩। ভূমি কম্পে দালান কোঠা বিধ্বস্ত
৪।
সুনামি সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেলো ঘরবাড়ি
৫। কালা পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে বস্তিবাসীর করুন মৃত্যু
প্রধান শিক্ষক রিপোর্ট পড়ে গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করলেন। প্রথম থেকে পুরো বিষয়টি নিয়ে তিনি পর্যালোচনা করতে লাগলেন। এই দেখে রমা ম্যাডাম বললেন,
অন্যায় তারা করেছে কথাটি সত্য প্রধান শিক্ষক মহোদয়,
যথার্থ হবে যদি শাস্তি তাদের দেয়া হয়।
কথাটি শুনে প্রধান শিক্ষক সুধাল,
এমন শাস্তি তাদের দিতে চাই,
যেন সময় আর সমাধান একসাথে পাই।
তখন রমা ম্যাডাম মুখ উজ্জল করে বললেন,
তবে কি শাস্তি আপনি দিতে চান?
প্রধান শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, সবাই মিলে গাছ লাগান, পরিবেশ বাচান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।