সূর্যের লাল
সাইফ ইসমাইল
এক.
ভাদ্রের কাঠফাটা দুপুর। শুক্রবার, ছুটির দিন। গত ক'দিনের দৌঁড়ঝাঁপের পর ক্লান্তি আর স্বস্তিতে ঘরে বসে আছে সবাই। দীর্ঘ ছয় মাসের অপেক্ষা শেষ করে গতকালই ডায়ালাইসিস ইউনিটে সিটটা পাওয়া গেল। আটমাস আগে আবীরের অসুখটা ধরা পড়েছে।
কিডনীর অসুখ।
লীনার মন ভালো নেই। টেলিফোনে খবরটা শোনার পর অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে বুক। তাড়াতাড়ি মা-বাবাকে জানাতে ছুটে যায়। মাকে খুলে বলে সব।
মায়ের অন্ধকার মুখটা নজর এড়ায়না। বলে, আম্মু, এখন কী হবে? মেয়ের কথায় ঘোর ভাঙে রীতার। বলেন, তৈরী হয়ে নাও, বেরুতে হবে। নিজের ঘরে ফিরে এসে প্রস্তুতি নেয় বেরুবার। কাপড় বদলাতে বদলাতে আনমনা হয়ে যায়।
মুনাফাখোর অসৎ কারবারীদের দখলে পুরো দেশ। কোথাও যেন কেউ নেই দেখার। ক্যান্সার কিংবা কিডনী রোগে আক্রান্ত একজন রোগীও নেই এমন গ্রাম বা মহল্লা সম্ভবতঃ এখন আর পাওয়া যাবে না। শেষবার চেক-আপের সময় ডাক্তার মজা করে লীনাকে বলছিল, 'দেখুন, আমাকে-আপনাকে-সবাইকে হয় কিডনীর অসুখে নয়তো ক্যান্সারে মরতে হবে। এখন কোনটি নিয়ে মরবো তা শুধু বেছে নিতে পারি আমরা।
' ডাক্তারের রসিকতার আড়ালে বেদনা ভারাক্রানত্দ চোখ দু'টোতে হতাশা ঝরে পড়েছে। ডাক্তারের কথায় নতুনভাবে উপলদ্ধিতে আসে অসহায়ত্ব আর লোভের নগ্নরূপ। লীনাও পাল্টা রসিকতার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বরং দলা পাকিয়ে সব কান্না ছাপিয়ে দিতে চায় তাকে। সামলে নিয়ে কোন রকম চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে।
দু'ভাই-বোনের মধ্যে লীনা বড়। বয়সের পার্থক্য ছয় বৎসর। লীনা দেখতে মন্দ নয়। লম্বা নাক, সুন্দর চিবুক। বাড়ন্ত যৌবন যেন লতিয়ে উঠা লাউয়ের ডগা।
ডাগর কালো চোখ দু'টো নীলাভ সরোবরের কথা মনে করিয়ে দেবে উপমায়। বিগত দিনগুলোর টানা খাটুনিতে চেহারা মলিন হয়েছে_ আভিজাত্য কমেনি একটুও। মা-বাবা দু'জনই সরকারী অফিসের গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। স্বাভাবিক নিয়মে লীনার কাঁধে উঠেছে আবীরের দেখাশোনার দায়িত্ব। একদম ছোটবেলায় আবীরের সাথে খুনসুটি, খামচা-খামচি থাকলেও ধীরে ধীরে দু'জন আত্মার পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছে।
কিছুদিন ধরে বিষয়টি লীনাকে বেশ ভোগাচ্ছে। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রতিরাতে। কাউকে বলে না। বলার যে মানুষটি অবশিষ্ট ছিল সে-ই তো এর কারণ। গভীর রাতে সেজদায় পড়ে কাঁদে আর চায়_ 'হে প্রভু, আমার ভাইটিকে তুমি সারিয়ে দাও'।
'আবীর' মানে সূর্যের লাল; তোমাকে সূর্যের মতো আলোকিত করতে হবে জগত, রাঙা হাসিতে ভরিয়ে দিতে হবে সবাইকে_ টিচারের কথাগুলো আজো কানে ঝংকার তুলে লীনার। এইতো সেদিন! নামের সাথে মিল রেখে গায়ের রঙটাও হয়েছে দুধে-আলতায়। বন্ধুরা দুষ্টুমী করে তাকে 'লাল আবীর' বলে ডাকে। পাড়ায় আবীর নামের আরেকজন আছে_ তাই এই উপনাম। গেলবার এসএসসি পাশ করেছে।
গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে। আনন্দের দিনগুলোতে হঠাৎ একদিন অসুস্থ বোধ করলে হাসপাতালে ভর্তি হয়। অসুখটা ধরা পড়ে তখনই। কিডনীর অসুখ। 'অবস্থা ভাল নয়।
কিডনী নব্বইভাগই অকেজো। ' ডাক্তারের কথায় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সবার। আনন্দ রূপ নেয় শোক আর নিস্ত্ব্ধতায়।
কর্মঠ আর সজীব আবীরের তনুমন ভেঙ্গে গেলেও মা-বাবা আর বোনটিকে আঁচ করতে দিতে চায় না। চেষ্টা করে প্রাঞ্জল থাকার।
সজীবতা আরো বেড়ে গেলেও এর পেছনের লৌকিকতা লীনা বেশ বুঝতে পারে। বুঝতে দেয়না আবীরকে। দু'ভাই-বোনের এ বোঝাপড়া বেশ আগের। এ বোঝাপড়া পরিপক্কতা লাভ করেছে এই কঠিন সময়ে।
দুই.
অনেক চেষ্টা তদবির করেও দু'মাসের বেশী ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেননি রীতা কিংবা শ্যামল।
মাঝে রীতা পণ করেছিল সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বাচ্চা দু'টোর পেছনে সময় দেবে। পারেন নি। সবকিছু জীবনের সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে যে, আর ফেরা সম্ভব হয়নি। শ্যামল রীতার সিদ্ধানত্দে বাধ সাধে না। শুরম্নর দিনগুলোতে এ নিয়ে যথেষ্ট টানাপোড়েন, ঝগড়াঝাটি হয়েছে।
ৰানত্দ দিয়েছে। এখন আর কিছু বলেনা। বাসত্দবতা মেনে নিয়েছে। ডায়ালাইসিস করতে অনেক টাকা কড়ি থাকা লাগে। প্রতিমাসে এত্তো এত্তো বিল।
প্রাইভেট ক্লিনিকের পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য এর পরিমান আরো বেশী। মা চাকরী ছেড়ে ভাইয়ের দেখাশোনার জন্য চলে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাসত্দবতার নীরিখে সে চিনত্দা বাদ দিতে হয়েছে। সংসারের নিত্যখরচাদি চালানোর পর আবীরের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা আৰরিক অর্থেই সম্ভব নয় বাবা সাদেকুর রহমান শ্যামল সাহেবের। একদিকে সরকারী কর্মকর্তা, তার উপর সৎ।
ডায়ালাইসিসের টাকার যোগান মা-ই দিচ্ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। চলে যাচ্ছিল বেশ। মাসে চারবার ডায়ালাইসিস করলেই আবীর সুস্থ। এ সুস্থতা পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে না দিলেও নতুন ছন্দে পথচলা শুরম্ন করেছিল ওরা।
বাধ সাধলো 'জটিলতা'।
ক'দিন ধরে শ্যামলের কিছু একটা হয়েছে। বিষয়টা ঠিক ধরতে পারছেনা। হঠাৎ হঠাৎ-ই আনমনা হয়ে পড়ছে। বুকটা খালি খালি লাগছে।
বছর খানেক হলো ছেলেটার কিডনীর অসুখ ধরা পড়েছে। প্রায়ই নাকি নষ্ট! অবাক লাগে লাগে তার। কতোইবা বয়েস ছেলেটার! এইতো সেদিনের কথা_ সবেমাত্র সরকারী চাকুরীতে জয়েন করেছে। অল্প বেতন। চাকুরীর সুবাদে এই হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছে।
হাসপাতালের নার্স লাল টুকটুকে বাচ্চাটাকে তার কোলে দিয়ে মিষ্টি খেতে চাইলো। সে-ও কোন কিছু চিন্তা না করে পকেটের সবগুলো টাকা নার্সটিকে দিয়ে দিল। উচ্ছ্বাস আর আনন্দে। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের ধাক্কাটা খেল কিছুক্ষণ পর। যখন ডাক্তার লম্বা একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'যদিও হাসপাতাল থেকে ঔষধগুলো আপনাদের দেবার কথা কিন্তু এখন স্টোরে নেই বলে আপনাদেরই যোগাড় করে নিতে হবে।
' কথাগুলো মনে পড়লে এখনও হাসি পায়, মনের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই ছেলেটারই কী-না কিডনী নষ্ট!। যতটুকু জেনেছে অনেকের জন্মের পর থেকেই সমস্যাটা থাকে; ধীরে ধীরে বাড়ে_ এমনটা হলেও মনকে মানানো যেত। কিন্তু তা তো নয়! ছেলেটারও কপাল। ফল খেতে খুব পছন্দ করে।
শাকও পছন্দের। অন্য বাচ্চাদের মতো মাছ-মাংসের বায়না নেই। শিশু বয়েস থেকেই তার পছন্দ মোসাম্বী, ডালিম, পেয়ারা আর আম। আম-পেয়ারাতো আর ফিবছর পাওয়া যায়না। জুটতো মোসাম্বীটাই বেশীর ভাগ সময়।
দামও তুলনামূলকভাবে কম। খুব একটা অসুবিধা হতো না শ্যামলের। ছেলেটার বায়না ছিল এতটুকুই। শ্যামল যদি জানতো আদর করে ছেলেটাকে বিষ খাওয়াচ্ছে! দেখতে দেখতেই লাল টুকটুকে ছেলেটা কোনদিকে বড় হয়ে গেল, গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে এসএসসি পাস করলো। বেতনের টাকাগুলো দিয়ে সংসারের সব খরচের পর ছেলেটার ঔষধগুলো কিনতে পারে, ডায়ালাইসিসের টাকা হয় না।
মাসে দশ হাজার টাকা অনেক টাকা। মূলবেতনের অর্ধেক। চিকিৎসার প্রথম ধাক্কায় পিএফ থেকে টাকা তুলে স্বাচ্ছন্দে খরচাপাতি মেটানো গেছে। কিন্তু মাসে মাসে দশ/বারো হাজার টাকা যখন ডায়ালাইসিসের জন্য দরকার পড়ছে তখনি টানাটানি শুরু হলো। গিন্নির চাকুরীটা আশির্বাদ হয়ে দেখা দিল এখন।
যদিও মনে খচখচ করে তার। নিজের কাছে নিজে লজ্জা পায়। চাকুরীটা ধরে রাখার জন্য সংসারের সাথে কী যুদ্ধই না করতে হয়েছে রীতাকে!
তিন.
ইদানিং রাতে ঘুমোতে পারছে না। দাদুর কাছ থেকে কাহিনী শোনার পর আউয়াল কী করবে ভেবে পায়না। অজানা এক ভাললাগা আর বিষন্নতায় সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
মেয়েটির বাবার কথা শোনার পর আরও খারাপ লাগছে। ভদ্রলোক ডিসি অফিসের সিনিয়র সহকারী কমিশনার। তিনি বললে মুহুর্তের মধ্যে কাজ হয়ে যায়_ কিন্তু তিনি বলছেন না অন্যের অধিকার নষ্ট হবার ভয়ে, বদ্ দোয়ার ভয়ে। যদি সবাই এমন হতো!_ আউয়াল ভাবে।
আউয়াল মেডিকেলের ফোর্থ ইয়ারে পড়ে।
বেশ ভদ্র। সিগারেটের মত বদ অভ্যাস নেই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শখের বসেও সুখটান দিতে ইচ্ছে হয়নি তার। লম্বা-চওড়া একহারা গড়ন। কিঞ্চিত কালো গাত্রবর্ণের কারণে বন্ধুরা কালোমানিক বলে ডাকে।
মানিকই বটে! এ পর্যন্ত সবগুলো ক্লাশের প্রথম স্থানটি যে তারই দখলে! এজন্য অবশ্য নাওয়া-খাওয়া কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা কোনটাই ছাড়তে হয়নি তাকে। যা হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে হয়েছে। সে শুধু মনোযোগ আর ইচ্ছেটা ধরে রেখেছে। যা করেছে মনোযোগ দিয়ে করেছে; যা চেয়েছে আনন্দের সাথে চেয়েছে_ সাফল্যটা স্বাভাবিক নিয়মে এসেছে। সবচে' অবাক করার বিষয় হলো সেই ছোটবেলা থেকে তার অনেক বন্ধু।
আর সব বন্ধুরই সে এক নম্বর বন্ধু। এমনটাও সম্ভব?! আউয়ালের বেলাতে যদিও তা বাস্তব। তার আন্তরিকতা অভিনয়হীন। যা করে অন্তর দিয়েই করে_ না করলে করে না। মানবসেবা তার ভাল লাগার বিষয়।
ডাক্তারী পড়তে আসার পেছনের কারণও তা-ই। বুয়েটে এক নম্বর সাবজেক্টে চান্স পেলেও ভর্তি হয়নি। চার বছরে ক্লাশের প্রয়োজনের বাইরেও কমপক্ষে একটা ঘন্টা সে হাসপাতালের ওয়ার্ডে কাটিয়েছে প্রতিদিন। অন্য দশজনের মতো বান্ধবীর পেছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়না। তেমন কেউ জীবনে আসেনি এখনও।
আজ কোন রোগীর রক্ত জোগাড় করে দেয়া তো কাল সীটের ব্যবস্থা করে দেয়া_ এসবের মাঝেই বাড়তি সময়টুকু বেশ কেটে যায় তার। অবশ্য ইদানিং রুটিনটা পাল্টেছে বেশ কিছুটা।
লীনার সাথে পরিচয়টা নাটকীয়। সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল হাসপাতালের নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে। যখন তার ওয়ার্ড ডিউটি ছিল।
প্রায় প্রতিদিনই দেখতো একটা মেয়ে ওয়ার্ডের অফিসে ঘোরাঘুরি করছে। ওয়ার্ডের দাদুদের এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে আবার চলে যাচ্ছে। মেয়েটা বেশ সুন্দরী। মার্জিত। রুচিশীল পোশাক পরেই চলাফেরা করে।
প্রথম দেখাতেই যে কোরো নজর কাড়ার মতো সবগুন তার আছে। সুন্দরী মেয়ে দেখে আউয়াল অভ্যস্ত। কিন্তু এ মেয়েটার মধ্য, এমন কিছু একটা আছে যা অন্যদের নেই। মেয়েটার বয়েসও বেশী হয়নি, দু'এক বছরের ছোট হবে বলেই মনে হয়। মেকাপের অত্যাচারে ইদানিং বয়েস বোঝা মুশকিল।
অবশ্য মেয়েটি মেকাপ লাগায় বলে মনে হয়নি তার। একদিন কৌতুহল বশতঃ আউয়াল ওয়ার্ড মাস্টার সুভাষ দাদুকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার? সুভাষ দাদু জানায়, মেয়েটির ছোটভাই কিডনী রোগী। গত আটমাস ধরে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস করায়। শুনেছে মেডিকেলের ডায়ালাইসিস ইউনিটে ভাল চিকিৎসা হয় আবার খরচও কম। প্রাইভেট ক্লিনিকে যেখানে দশ/বারো হাজার টাকা মাসে লাগে সেখানে মেডিকেলে লাগবে মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
মেয়েটির বাবা একজন সরকারী কর্মকতা। কিন্তু তিনি তদ্বির করবেন না। স্যার কিংবা ম্যাডামকেও বলবেন না। অন্যের অধিকার নষ্ট করবেন না। তাই মেয়েটি একদিন পর পর আমার কাছে এসে জেনে যায় কোন সীট খালি আছে কী-না।
কিন্তু আপনি তো জানেন সীটের কী আকাল। তার উপর বেশীর ভাগ সীটই তো স্যার আর ম্যাডামদের চয়েস লিস্ট থেকে নেয়া হয়। _ আমি কী বা করতে পারি। রোগী মারা না গেলে তো আর সীট খালি হয় না!
পনের বিশ দিন পর আউয়াল মেয়েটির সাথে সরাসরি কথা বলে। জানায় সীট না পাওয়ার রহস্য।
মেয়েটির গভীর সরল চোখ তা বিশ্বাসই করতে চায় না। _ 'কী বলেন?!' আউয়াল আবিস্কার করে অন্য সুন্দরীদের মাঝে না পাওয়া গুনটি কী। নিষ্পাপ সরলতা। এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে! তা-ও পরমা সুন্দরী কোন মেয়ে! তিন সপ্তাহের পরিচয়ে আউয়াল পরিবারটাকে আপন করে নিয়েছে। গত দু'টি ডায়ালইসিসের সময় সে ক্লিনিকে আবীরের পাশে ছিল।
আবীরের সাথে কথাবার্তা বলার পর তার আরও ভাল লাগতে শুরু করেছে। সত্যিই এঁরা খুব ভালো। সাহস করে লীনাকে নিয়ে রেজিস্টার স্যারের সাথে দেখা করে সব জানিয়েছে। রেজিস্টার স্যার কিছুটা বিরক্ত হলেও সবকথা শুনেছেন। স্টুডেন্টদের রিকোয়েস্ট তার পছন্দ না।
আউয়াল ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেন। ছেলেটা ভাল, পড়াশোনা করে। ওয়ার্ডের রোগীদের বিশেষ যত্ন নেয়। ওয়ার্ডে সময় দেয়। নিজের গড়া নিয়ম ভেঙ্গে আউয়ালের কথায় আবীর নামে ছেলেটাকে গতকালই একটা সীট দিয়েছেন।
ছেলেটা সীটে ভর্তিও হয়েছে। আগামী রোববার নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে ছেলেটির প্রথম ডায়ালাইসিস। প্রিপারেশন দরকার। কিছু ঔষধ দেয়া হয়েছে। ফুসফুসে পানি জমেছে।
জটিল অবস্থা। যদিও পানি বের করে ফেলার পর আর সমস্যা হবে না।
সকালে মায়ের সাথে লীনা হাসপাতালে গিয়েছিল। বাবাকে বাসায় পাঠিয়ে ওরা বসেছিল দুপুর পর্যনত্দ। আউয়ালও ছিল।
গতরাতে শ্যামল সাহেব ছেলেকে এটেন্ড করেছেন। আজও করবেন। দিনে লীনা থাকে। আজ আউয়াল তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছে রেষ্ট করার জন্য। সে আছে।
আজ কলেজ ছুটি, ওয়ার্ড ডিউটিও নেই।
চার.
ঠিক বারটায় আবীরকে খাইয়ে দিয়ে মা আর লীনা আপু বাসায় গেছে। আউয়াল ভাইয়া বেরিয়েছেন অল্প কিছুৰণ হলো। জু'মার নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে চলে আসবেন। বুকে একটু একটু ব্যথা করছে।
তেমন কিছু না। সম্ভবতঃ গ্যাস।
নামাজ-খাওয়া শেষ করে আউয়াল তাড়াতাড়িই ফিরে আসে। আবীরের সীটে বসে গল্প করার জন্য। আবীরের চেহারার অস্বস্তি ধরা পড়ে।
জিজ্ঞেস করে, : সব ঠিক আছে? ভাল লাগছে?
: বুকে সামান্য ব্যথা লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে একটু।
কপাল কুঁচকে যায় আউয়ালের। জিজ্ঞেস করে, কতক্ষণ?
: আপনি বেরুনোর কিছুক্ষণ পর থেকে।
: ডাক্তারকে বলেছো?
: কাউকে পাচ্ছি না।
পাশের সীটের ভদ্রলোক দেখে এসেছেন, কেউ নেই।
আউয়াল উঠে বসে। ডিউটি রুমে গিয়ে দেখে, বন বন করে পাখাটা ঘুরছে, কেউ নেই। নার্স রুমে গিয়ে দেখে ওখানেও কেউ নেই। পুরো ওয়ার্ডে দায়িত্বশীল একজন লোকও নেই! নিজেই অক্সিজেন সিলিন্ডারটা টেনে নিয়ে আসে আবীরের সীটের পাশে।
পাশের সীটের সবাই ঘিরে ধরেছে এরই মধ্যে।
একটু বাতাসের জন্য ছট্ফট করে আবীর। ধবধবে ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। দেহের সব রক্ত যেন চেহারায় চলে এসেছে। তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার।
সীটের উপরের পাখাটা কী বন্ধ করে দিল কেউ? ঘেমে একাকার। একটু বাতাস করবেন_ ইশারায় আউয়ালকে বলে। আওয়াজ বেরোয় না। তার এতো গরম লাগছে কেন? হঠাৎ-ই সবকিছু অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন সে?
একজন নার্স ওয়ার্ডে ঢুকতেই জটলার মাঝে আউয়ালের দিকে চোখ যায়।
পড়িমড়ি করে ছুটে আসে। সবাইকে সরে যাবার জন্যে চিৎকার করে তাড়াতাড়ি রোগীকে অক্সিজেন মাস্ক লাগায়। পাল্স ধরে রাখে বাম হাতে, ডান হাতে অক্সিজেনের নব এডজাস্ট করতে থাকে।
আউয়ালের কৌতুহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কথা হারিয়ে ফেলে। নার্সের চেহারায় মেঘের আনাগোনা লক্ষ করে আউয়াল।
নার্স চোখের ইশারায় তাকে জানায়, 'হি ইজ নো মোর'। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।