আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাঁটতে হাঁটতে একটা নুড়ি...

সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! ..... শ্লার জীবনটাই একটা কনপিটিশম! বটু অবশ্য সুন্দর করেই ভাবে। জীবন নিয়ে তার কত রকমের অনুভূতি। তীব্র সব আচ্ছন্নতা। এসব তো কাউকে বলার নয়। তাই বটু একা একাই ভাবে।

ভাবে আর ভাবে। খেতে বসলে ভাবে, ঘুমাতে গেলে ভাবে! এমন কি সারাদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও তার এই একটাই ভাবনা। অবশ্য বটু দেখেছে এই ভাবনা ভাবাটাই ভীষন আনন্দের। যেন একটা দ্বায়িত্ব পালন। সব খানেই শুধু কমটিপিশন আর কমপিটিশন! রাস্তার মোড়ে আট দশটা পোলাপান সব সময় থাকে।

তারা বটু কে খোঁচায়। কত কি বলে! ভাবনার মধ্যে বিরক্ত করে। কিন্তু বটু হাসিমুখেই সব মেনে নেয়। এটাও তো জীবনের অংশ। সবচেয়ে বড় কথা ওরা চা খায়! আর এরকম সময় বটু সামনে থাকলে বটুর জন্যও চা দিতে বলে।

বটু? জীবন মানে কি বল তো? কনপিটিশম শুনলেই ওরা দাঁত কেলিয়ে হাসে! বটুর চুল বড় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মাথার ভেতর বসত গড়া প্রানীর সাথে পাল্লা দিয়ে তার ভাবনারা বাড়ে। এই যে জীবন তার শেষ কোথায় ভাবলেই গা শিউরে ওঠে বটুর। সেদিন পায়ের তলায় একটা লাল পিঁপড়ে পিষে দিয়ে তার অনুশোচনার শেষ ছিলনা। কবে তার এই ক্ষুদ্র জীবনটাও কেউ পায়ের তলায় পিষে ফেলবে! ভাবে আর চমকে চমকে ওঠে।

শুয়ে শুয়ে নাকের ময়লা পরিষ্কার করাটাকে তার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। শরীরের একটা অংশ থেকে বাড়তি টুকু ফেলে দেয়ার ভেতর যে এত আনন্দ থাকতে পারে তা বটু ছাড়া কে ভেবেছিলো প্রথম? এই যে এত সব ভাবনা তার মাথায় উকুনের সাথে সাথে বাড়ে তাদের প্রতিপালন ভীষন ঝক্কি ঝামেলার। ঠিকমত খানাদানা না পেলে আবার ঝামেলা শুরু করে। ঐ যাকে বলে বিদ্রোহ। সরু রাস্তাটা চলতে চলতে একসময় বড় রাস্তায় মেশে।

কখনো আবার তার পথের সেখানেই শেষ। এসব বড় রহস্যময়। বটুর রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাল লাগে। পাড়ার ইয়াসিন ভাইকে যেদিন কাকডাকা ভোরে পিঠের উপর বস্তা নিয়ে চোরের মত পালাতে দেখেছিলো সেদিন কে জানতো একটা রহস্যের শুরু হয়েছিলো ভালমত রোদ ওঠার আগে! হিসেব মিলতে চায়না। বটুর শক্ত বাদামি নখের ভেতর দু একটা লিক উঠে এলে দু আঙ্গুলের নখে পুটুস শব্দ করে ।

উকুন মারার আনন্দ তাকে আরো রহস্যের গভীরে যেতে উৎসাহ দেয়। পুলিশ এসেছিলো। বাড়ি সার্চ করার পরে ইয়াসিন ভাইকে ধরে নিয়ে গেল। পুলিশের জেরায় নাকি বের হয়েছিলো ইয়াসিন ভাই তার তিলোত্তমা স্ত্রীকে মেরে পদ্মায় ফেলে এসেছেন। ইয়াসিন ভাই কোন কমপিটিশনে হেরে এই কাজটা করেছে এটা এখনো রহস্য বটে! আর সমাধান তো খুব ই সহজ।

বটু সারাদিন কত কাজে অকাজে তো এ কথায় বলে। শ্লার জীবনটাই একটা কনপিটিশম! মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াতে কত যে সুবিধা ভাবতেই বটুর চোখ চকচক করে উঠে। ভালবাসা টাসা নিয়ে আজকাল ভাবার তেমন সময় পায়না বটু। তবে এই সব ভাবাভাবির সময় তার মুখ এমনিতেই হাসি হাসি হয়ে যায়! ভেবে যে খুব কাজ হয় তা কিন্তু না কিন্তু ভাবনা ভাবাটাই তার দ্বায়িত্ব বলে ভাবে। বটু নিজে থেকেই কত কি করে! গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোলের দ্বায়িত্বটা তার।

নিজ থেকেই মানুষের জন্য এটুক করাকে সে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাবে। এ সময়টায় তার মাথার ভেতরের আলো আঁধারি ভাবটা কেটে যায়। স্পষ্ট জীবন দেখতে পারার আনন্দে তার লাফাতে ইচ্ছে করে। রাস্তার মাঝখানে লাফালে যদি তাকে কেউ পাগোল ভাবে? বটু এ ব্যাপারে খুব সচেতন। তার একটা মান ইজ্জত তো আছে! দোষ গুন মিলিয়েই মানুষ।

গুন গুলো মানুষকে টানে আর দোষ গুলো যদি দূরে সরিয়ে দেয় হিসাবের সহজ সমীকরনে কি দাঁড়ায়! মানুষ যে একা সে একায় থেকে যায়। বাস্তবিকই তাই হয়। বটু ভাবে জীবনের এই কমপিটিশনে সে কিছুতেই জিতেনি কখনো। সেই কবেকার কথা। তখন তো তার সবে দাড়ি গজাচ্ছে।

বড় ভাইয়ের বউ এর সাথে তার সম্পর্ক হয়ে গেল অন্যরকম! সেখানেও কমপিটিশন! তবে জেতেনি বটু। একটা চওড়া মেঘালো রাস্তাকে প্রায় ভাবতে পারে সে। চারদিক ছায়া ছায়া! আর বড় বড় বাড়ি দালান। ঠিক স্বপ্নের মত একটা মায়াময় ঝকঝকে শহর। পোড়া মাটির দালানে অসংখ্য জানালা।

বালুর ঘাটের মত পাশ দিয়ে দীর্ঘ রাস্তা। আর রাস্তার শেষে শহুরে নদী। তখন নদীটা ছিল এক ভরা যৌবনের ডাক পাওয়া দুরন্ত কিশোরী। একদিন বৌদি কে নিয়ে সারাদিনের জন্য পালিয়ে গেল নৌকায় করে। বর্ষায় সে কি দুরন্ত তার মেজাজ।

কোথাকার কোন মাছ ভরা পুকুরের পানা ছিঁড়ে এনেছে। নদী ভরে গেছে কচুরিপানায়। দূর্বার পাকে সেই কচুরিপানা ঘোরে আর ঘোরে। তারপর কিছু তলিয়ে যায় স্রোতের টানে। কি সাহসীই না ছিলো তখন বটু।

বৌদির নরম পুঁই ডাঁটার মত আঙ্গুল ধরে বটু স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো। দাদা ছিলো ব্যকগ্রাউন্ডে অপ্রয়োজনীয় জড়ের মত। স্টোর রুমে ফেলে রাখা ভাঙা প্লাস্টিক। তখন তো তার স্বপ্ন দেখার ই বয়স। শ্যামলা মেয়েটার কপাল ভরে লাল সিঁদুর তার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

দাদার সন্দেহের অবকাশ ই ছিলনা। বৌদির ছিল অল্প বয়সের চপলতা। যা হয় আর যা হবার কথা ছিলো তার কিছুটা হল বাকিটা রয়েই গেল বাকির খাতায়। বৌদি সারাদিন নদীর সৌন্দর্যেই কিনা কে জানে মাথা রেখে কাটালো বটুর বুকে। আর তারপর ফিরে এসে হয়ত ভেবেছিলো ভুল হয়ে গেছে।

দাদা ডাকলো বটেশ্বর? হাজারীপাড়ার জমি নিয়ে বিরোধ বাড়ছে। তুমি গিয়ে একবার দেখে এসো। বটুর কি তখন বিরোধ দেখার বয়স? খুব অভিমান বাড়ে। বৌদির কামরাঙা হাসি ফেলে বিরোধী জমির নিষ্পত্তি দেখার শখ তো বটুর হবার কথা নয়। পালিয়ে যাবার কথা বলতেই বৌদি হেসেই খুন।

কুশারের লাঠি থেকে রস বের করে মুখে চাবাতে চাবাতে বলেছিলো এমন কাঁচা কথা তোর মত ছোটকুই বলতে পারে। বটু তখন ছোট ই ছিলো। আদর করে বৌদি ছোটকু বলে তাই কখনো বড় হবার স্বাধ হয়নি বুঝি! নিশ্চিন্ত সাংসারিক জীবন ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে পা বাড়াতে বৌদি চায়নি। কষ্টের ডালপালা বাড়ে। আর রাতের স্বপ্ন গুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়।

সব স্বপ্নই হয় ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায়। ঝকঝকে রোদ কখনো দেখেনি বটু। দিনের আলোর ভেতর যে স্বপ্ন দেখা যায় তাতে হয়ত বাল্বের পাওয়ার বাড়ে উজ্জ্বলতা সেই তুলনায় খুবই কম। বটুর খুব ইচ্ছে করে জীবনটাকে রোদের আলোয় দেখে। স্বপ্নের তুলনায় যার ওজন আহামরী ভারী কিছু নয়।

অথচ ভুল করে স্বপ্ন দেখে ফেলে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাড়তে দেয়া বোকামি নয়তো কি! বটু বোকার মত স্বপ্ন দেখলো কেন?স্বপ্নেরও কি কমপিটিশন হয়?বৌদি তাকে দাদার সাথে এক দিনের জন্য কমপিটিশনে ফেলে দিয়েছিলো। অবশ্য বটু জিততে পারেনি। এ নিয়ে তার ক্ষোভ থাকলেও মাঝে মাঝে নিজেকে শুনিয়ে তার বলতে ভালই লাগে, শালার জীবন মানেই কমপিটিশন! এই যে বটুর জীবনে গিট্টু লেগে গেছে। কিছুতেই গিট্টু খোলেনা। যাকে বলে তেরো গিরের প্যাঁচ।

দু একটা খোলেতো আর দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসে গলায়। সুভদ্রার প্যাঁচটা সে খুলতে চাইলেও পারেনা। সুভদ্রা ছোটপিসিমার কোলমুছা মেয়ে। মানুষ তার নিজের জীবনের চাইতে বেশি আর কি ভালবাসতে পারে? বটুর মাথায় ঢোকেনা। সুভদ্রার নির্জিব দেহটা দড়ি থেকে খুলে নিজের কাঁধে করেই মেঝেতে নামিয়েছিলো বটু।

পরীক্ষায় পাশ করেনি। নাকি নিতাই বিয়ে করেছিলো মায়ের পছন্দে? কি জানি কোন কারনে মরে গেল! কার সাথে যে কার কমপিটিশন! ভাবতেই ছাতুর মত গুঁড়ো হয়ে যায় ভাবনারা মাথার ভেতর। আরে বাবা জীবনের পরীক্ষায় কজন মানুষ পাশ করে। এই যে বটু সেও কি পাশ করেছিলো। বৌদি তার বুকে ভালবাসার আগুন জ্বালিয়ে দিলো।

এটাও তো পরীক্ষায় নাকি? অবশ্য বটু খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছে। যেদিন পদ্মার মাঝনদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলো। শুধু টুপ করে শব্দ হয়েছিলো একবার। শালার মাঝি চেঁচিয়ে উঠেছিলো। মরতে মরতে ঢক ঢক করে নদীর পানি খেয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছিলো অন্তর।

এরপর যে বেঁচে আছে এটাও বড্ড অবাক লাগে বটুর। সে সব কত দিনকার কথা! মরার কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে ধ্বকধ্বক করে! সবুজ নীল জলের ঘূর্ণন মাথায় বোঁ বোঁ করে পাক খেতে থাকে। এরকম সময় ধাঁ ধাঁ করে গায়ে জ্বর উঠতে থাকে। সেই থেকেই তো জীবন কে ভালবাসতে শিখে গেল বটু। কিন্তু সেই যে কমপিটিশন! সেতো ছাড়েনা পিছু।

দিনরাত রাতদিন সে এক অদ্ভুত কমপিটিশন। গ্রীষ্মের সাথে বর্ষার, বর্ষার সাথে শীতের। এ পাড়ার সাথে ও পাড়া। খাদ্যের সাথে জীবনের,জীবনের সাথে মৃত্যুর। মৃত্যুর সাথে দেবতার! শ্লার জীবনটাই একটা কনপিটিশম! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.