আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাঁটতে হাঁটতে বুড়োর বাড়ি

.

আমি খুব হাঁটি। খুব বেশি। ব্যাপারটা হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত হই না। বরং আরো বেশি হাঁটার ইচ্ছে জেগে ওঠে আমার ভেতর।

হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছুই ভাবি। অথবা কিচ্ছু ভাবি না, একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে আসলে কী করি, আমি এখন বলতে পারি না। যখন হাঁটি তখন কী করি সেটা মনে রাখতে ভুলে যাই। অনেক ছোটবেলায় আমি আবিস্কার করলাম, সারাদিনে আমি আসলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি না! কেবল ঘুমাবার আগে, বিছানায় শুয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছি-নিচ্ছি আমি! সারাদিনে তো একদম টের পাই না ব্যাপারটা।

হাঁটতে হাঁটতে কী করি, এখন যে সেটা মনে করতে পারছি না, সেই ব্যাপারটাও প্রায় ওরকম। হাঁটার ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আসলে অভাব থেকে। রিক্সাভাড়া না থাকা থেকে। কিন্তু তারপর কেমন করে জানি অভ্যাস হয়ে গেল। এখন বাসা থেকে বেরোলে আমার মনেই থাকে না আমাকে যে রিক্সায় চড়ে কোথাও যেতে হবে।

ঠিক সময়ে পৌঁছুতে হবে, এমন কোন তাড়া না থাকলে তো আর কথাই নেই। আমি আস্তে হাঁটি না। খুব দ্রুত হাঁটি। রেসিং গেইম খেলার মতো মজা পাই আমি হাঁটতে হাঁটতে। জিন্দাবাজার আর বন্দর বাজার সিলেটের সবচেয়ে ব্যাস্ত এলাকা।

বিজ্ঞাপনের ভাষায় "শহরের প্রাণকেন্দ্র"। ডানে বায়ে সামনে পেছনে, এমন কি উপরের এবং নীচের ডান-বাম কোনায়ও মানুষ। মার্কেটের পর মার্কেট গড়ে উঠছে সিলেটে। জিন্দাবাজারে এখন আর রোদ পড়ে না। পুরোটা সকাল এবং দুপুর, জল্লারপাড় থেকে জিন্দাবাজার পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তাটা "ছায়াসুনিবিড়"! রাস্তার দুপাশে ডানে বায়ে কোমরে হাত দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে ইয়াব্বড় বিল্ডিংগুলো।

আরও নতুন নতুন পালোয়ান গড়ে উঠছে ওদের পাশে। খুব দ্রুত। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। জিন্দাবাজার পয়েন্ট থেকে ডানে গেলে (কোন দিক থেকে!) বন্দরবাজার। আমার সবচেয়ে প্রিয় রাস্তা।

সবচেয়ে প্রিয় ট্র্যাক। এই রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলি আমি সবাইকে পাশ কাটিয়ে। প্লাস্টিকের সাদা টুপিওয়ালা লোকটা মুখের মধ্যে কী একটা পুরে দেয়। ওটা থেকে শব্দ বের হয়। লোকটা হাত উপরে তুলে নাচায়।

ওর হাতে লম্বাটে কিছু একটা থাকে। কয়েকটা রিক্সা থেমে যায়। তার পেছনে হুমড়ি খেয়ে রিক্সাগুলো দলবেঁধে দাঁড়িয়ে যায়। ড্রাইভারগুলো পা চুলকায়। সর্দি ফেলে শব্দ করে।

লুঙ্গি তুলে নাক মোছে। কেউ কেউ প্যাসেঞ্জারের সাথে ভাব জমাবার চেষ্টা করে। অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেয়। ভাড়া বেশি পাওয়ার লোভে। অধিকার বাড়িয়ে নিতে।

প্যাসেঞ্জারের কেউ কেউ সে ফাঁদে পা দেয়। পোড় খাওয়া কেউ কেউ আবার খুব কৌশলে ফিরিয়ে দেয় সে বুমেরাং। ড্রাইভারের ভাড়া তাতে আরেকটু কমে যায়। কোন কোন যাত্রী রিক্সায় বসে আনমনে নাকের ময়লা পরিস্কার করে। নাকের ভেতর থেকে বের করে আঙুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে পিষে পিষে ছোট্ট একটা দলার মতো বানায়। টোকা মেরে ফেলে দেয়। ডানে বামে চোরের মতো তাকায় কেউ দেখল কি না নিশ্চিত হওয়ার জন্য। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছোট্ট একটা ছেলে সেটা দেখে হাত তুলে দেখায় ওর মাকে। মা ছেলেটাকে ঝাড়ি দিয়ে হাত নামায়।

ঠিক এরকম একটি জীবন্ত স্থিরচিত্রের মধ্যে আমি হাঁটতে থাকি। খুব দ্রুত। আমার পাশে সাই সাই করে দৌঁড়ে যায় অনেকগুলো ফুল শার্ট। কোনটার গায়ে বউয়ের অনেক যত্ন। কোনটার গায়ে ব্যাচেলার জীবনের অভিশাপ।

আমার পাশ দিয়ে খুব দ্রুত হাঁটতে থাকে অনেকগুলো লুঙ্গি। অনেকগুলো খোলা গা। অনেকগুলো চানাচুরওয়ালা। ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা ছোট ছোট ব্যাবসায়ী। হোটেলের উত্তপ্ত কড়াইয়ের নাকের উপর পাক খেয়ে খেয়ে উড়তে থাকা আলোর প্রতিসরণ।

কড়াইয়ের কোলে শুয়ে থাকা সকালের কিমাপুড়ি। আমার পাশ কেটে দ্রুত হেঁটে যায় অনেকগুলো আপেল। অনেকগুলো কূল বড়ই, কালোজাম, ঘড়ির দোকান, মধ্যবয়সী শাড়ি, সিঁথির সিঁদুর, ধূর্ত জোড়াচোখ। আমি একটার পর একটা ল্যাভেল ক্রস করতে থাকি। প্রচণ্ড উত্তেজনায়ও স্টিয়ারিংটাকে শক্ত করে ধরে থাকি।

হর্ন বাজাই না। হর্নের আওয়াজ শুনি। আসলে এই গেইমের টিউটোরিয়াল কমপ্লিট করেছি আমি স্কুলে থাকতে। টিফিন পিরিয়ডে। ক্লাসের বারান্দায় রেলস্টেশনের সিনেম্যাটিক কোন প্ল্যাটফর্মের মতো ভীড়ে।

আমি সেখানে দৌঁড়াতে থাকি। ডানে বামে সবাইকে পাশ কাটিয়ে দৌঁড়াতে থাকি। অনেকগুলো সাদা শার্ট। শার্টের বুকে বেইজ-নেইমপ্লেইট। কারো কোমরে বেল্ট, কারোটাতে নেই।

বেশিরভাগের হাতেই একটা করে ঠোঙা। হয় চানাচুর, কিংবা আচারের। আমি কোনটাকে পড়তে দেই না। কারো ঠোঙাই উল্টে যায় না আমার ধাক্কায়। আমি দৌঁড়াতে থাকি প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে।

আমি দৌঁড়াতে থাকি। প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে। এতদূর লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল, বুড়োটা এখনও কাঁদছে মলাটের ভেতর। মার্লিনটা ওর বড়শিতে আটকেছে। কিন্তু এরপর আর কিছুই হতে দিচ্ছি না! ডোন্ট ওয়োরি বুড়োভাই, আমি আসছি...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.