আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি মাল্টিফাংশনাল ডিভাইস!

আপডেট। আপগ্রেড। লাভ হোয়াট ইউ ডু। ডু হোয়াট ইউ লাভ। এখনকার ছেলেপুলেরা ঘরে বসেবসেই গোলের পর গোল মারে সেঞ্চুরি-হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দেয় এবং সেটি ঘটে কম্পিউটারের সামনে বসে ভিডিওগেম খেলার মধ্য দিয়ে, মাঠে তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল; মাঠ কি জিনিস সেইখানে ঘাসের আকার কয় ইঞ্চি সেই গুলির রং সবুজ না বেগুনি এই বিষয়গুলি তাদের জানা আছে কি নাই কে বলতে পারে; কিন্তু একটা সময় ছিল যখন মাঠে গরু এবং ছাগলের চাইতে ছেলেপুলেদের বেশি দেখা যেত এবং সেইসময়টিতেও আমি ঘরে বসে আত্মীয়দের ভিতর যারা মেয়ে-শ্রেণীর তাদের সাথে টুকটুক লুডু এবং সাপ-লুডু খেলতাম।

লুডু এবং সাপ লুডু ছাড়াও এদের ভিতর আরও যে কয়টা খেলা চলতো তার একটি “বল তো আমি কে?”। এই বিচিত্র খেলাটিতে দলের ভিতর একেকজন একেকধরন মানুষের কাজটুকু মুখে কিছু না বলে কেবল অভিনয় করে দেখাতো: চাষী কাস্তে নিয়ে ধান কাঁটছে এই রকম-দেখেদেখে আন্দাজ করে ফেলা লাগত মানুষটি কি! দুনিয়ার আব্বাদের কাজ এই খেলাটিতে অভিনয় করে দেখানো লাগলে বেশ একটু মুশকিলে পড়ে যাওয়া লাগত: আব্বাদের একই সাথে অনেককয়টা কাজ করে অভ্যাস-তারা আমাদের জন্যে একসাথে ডিকশনারী এবং সাধারন জ্ঞান বইয়ের কাজ করেন: আমরা যে মুরগির মত দুনিয়ায় ডিম হয়ে আসি নাই হাত পা নিয়ে সরাসরি চলে এসেছি এইধরন নিগূঢ় তথ্যগুলি আমরা আব্বার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পাই; একটাকিছু মুশকিল দাঁড়া হলেই আমরা আব্বার এগারো ডিজিটে মোবাইল নাম্বারে কল দিই: সাথেসাথে সবকিছু ম্যাজিকের মত ঠিক হয়ে যায়; আবার এই আব্বারাই আম্মা যখন বাসায় নাই তখন রান্না বিষয়টুকু কোন ব্যাপারই না ইত্যাদি বলে বলে বিরাট উৎসাহ নিয়ে আয়োজন করে নানাকিছু রান্না করতে নেমে যান এবং বাসার ভিতর একটা দুইটা দূর্ঘটনা দাঁড়া করিয়ে ফেলেন! আব্বাদের মাথায় পানির ফিল্টারে পানি যেমন কয়েক স্তর হয়ে বাহির হয়ে আসে সেইরকম কোন কথাগুলি বলা লাগবে সেইগুলি থেকে গিয়ে কোনগুলি লাগবে না সেইগুলি ছাঁটাই হয়ে যায়; আব্বারা সেই কমান্ডসেন্টার যার নির্দেশনার ভিতর থেকেই আমাদের স্বপ্নগুলি রকেটের মত আকাশে উৎক্ষেপিত হয়; জীবন যদি একটা ট্রেনযাত্রার মত কিছু হয় তাহলে “হাইস্কুল” “কলেজ” “বিয়ে” সবকয়টা স্টপেজে মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকালে যে মানুষটিকে আমরা সাথে দেখতে পাই সেটি আমাদের আব্বা। মাস শেষে বাসাবাড়ির ইলেকট্রিক বিল চারকোণা জমকালো একটি বাক্সমতো মিটারে দেখে নেয়া যায়-আব্বাদের নিজের নিজের সন্তানের কাছে বিল কত জমা পড়ে আছে সেটি দেখার জন্যে কোন মিটার নাই-থাকলে সংখ্যাটি নিশ্চয়ই অনেক একটা বড় কিছু হতো-এবং সেটি শুধু সেই সংখ্যার ভেতরেই আটকে থাকতো না! জীবনের প্রতিটা ক্যালেন্ডারে যাদের জন্যে বড় একটা জায়গা করা থাকে তাদের জন্যে ক্যালেন্ডারে একটা কিছু নির্দিষ্ট দিন থাকবে না সেটি হতে পারে না-বাবাদের জন্যে একটি দিবস আছে যেটি প্রতি বৎসর জুন মাসের তিন নাম্বার রোববার পালন করা হয়; এইবারে সেটি পড়েছিল ১৭ই জুন। “আব্বা” শব্দটিকে অল্প কথার ভিতর সবচাইতে ভাল কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেটি বন্ধুদের ভিতর একজনকে জিজ্ঞেস করি, তার চোখে নব্বুই কেজি বা কাছাকাছি ওজনের চশমা এবং সে সেটি নাড়াচাড়া করেকরে একটুসময় চিন্তা করে বলে, আব্বা এমন একটা গ্যাজেট নাহয় যন্ত্র যেইটা দিয়ে একসাথে একটার জায়গায় অনেক কয়টা কাজ করে ফেলা যায়! আমি আরও মানবিক একটা কিছু উত্তর তার কাছে আশা করেছিলাম কিন্তু এটি শুনেও বেশি হতাশ হই না-তার নিজের আব্বাকে আগে একবার প্রশ্ন করেছি-প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি যেটি সেটি ঠিক কীরকম, তার আব্বা পদার্থবিদ্যার প্রফেসর, একটু সময় চিন্তা করে বলেন-একটা নূতন আইপ্যাড কেনার মত অনুভূতি: একটা জিনিস নূতন হাতে চলে এসেছে সেইটা তুমি জান তোমার নিজের, তুমি সেইটা হাতে নিয়ে ওলটপালট করে দেখছো কিন্তু সেইটা নিয়ে কিভাবে কি করা লাগবে সেটি যে কাগজপত্রে লিখা সেইগুলি এখনও পড়ে দেখনাই তাই সেইটা কিভাবে ব্যবহার করা লাগবে এখনও বুঝে উঠতে পারছোনা! আমি কি করব, চোখ গোল করে মানুষটার দিকে একটু সময় তাকিয়ে থাকি; সেই হিসাবে তার ছেলে বক্তব্যের জন্যে তাকে বেশি কিছু দোষ দেয়া যায় না! কিন্তু বন্ধুটির জবাবটুকু বেশ অনেকখানি সত্যি: একটা রেডিও নিয়ে শুধু গান শোনা যায়, একটি টিভি সেইটা নিয়ে গান শোনা এবং ছবি দেখা যায়, একটা ফ্রিজ সেটি খুলেখুলে খাবার বাহির করে নেয়া যায়, একটা আলমিরা সেটিতে পোশাক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা যায়; সেই খানে আব্বা একাই আমাদের দুনিয়াটাকে দেখিয়ে শুনিয়ে দেন, আমাদের খাওয়া এবং পোশাকের ব্যবস্থা করেন; আব্বা মানুষটি যদি একটি যন্ত্র হতেন-তাহলে সেই যন্ত্রের সমান কাজ করে অভ্যাস এইরকম একটা কিছু যন্ত্র দুনিয়ায় খুঁজে বাহির করা যে খুব একটা মুশকিল কাজ হয়ে যেত-সেটি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই! চোখ বন্ধ করুন। নিজেরনিজের আব্বার সাথে আপনার সবচাইতে যেটি পছন্দের ঘটনা সেটি কি? পছন্দের স্কেলে এক-দুই-তিন ক্রম দাঁড়া করালে এক নাম্বারে যেটি আসবে সেটি কোনটি? ছোট থাকতে আব্বা শখ করে কোলে বসিয়ে অফিস নিয়ে গেছেন-আপনার দুই ইঞ্চি বয়স, আব্বার বন্ধু আপনাকে কোলে নিয়েছে আপনি থাবা দিয়েদিয়ে তার নাক কান এবং চুল টেনেটেনে দেখছেন-সেটি? নাকি প্রথম বেতন পেয়েছেন, সেই টাকায় প্রথম যেই কাজটি করেছেন সেটি হলো আব্বার জন্যে নূতন পাঞ্জাবী কেনা-আব্বার প্রিয় রং লাল সেইজন্যে এটিও লাল, আনার তিন মিনিটের ভিতর ছোট ভাই সেইটাতে লাগিয়ে দিল টাকি মাছের ঝোল- আব্বা সেই টাকি মাছের ঝোল লাগা পাঞ্জাবী পড়েপড়েই সারাদিন পার করলেন-পারলে এটি পড়েই ঘুম যান এইরকম একটা অবস্থা-সেটি? কিসমিস ছিটিয়ে দিলে সেটি সেমাই-পায়েসের সব জায়গায় পড়ে না-হতেই পারে আপনি সমাজের খুব একজন নিচের অংশের মানুষ, ডাল-ভাত খেয়ে দুই বেলা পার করা লাগে, রুই মাছ খাওয়ার সুযোগ বেশি হয়না-আব্বা কোথা থেকে কীকরে রুই মাছ এনে দেন আপনি স্বাদ করে ফেললেন খেয়ে-সেটি? সমাজের যে অংশের লোকই আপনি হোন না কেন জীবন বিষয়টি যদি সিনেমা হত-সিনেমার শেষে সিনেমা দাঁড়া করানোর পিছনে যেই মানুষগুলি কাজ করেছেন সেটির যে লম্বা লিস্টি ভাসার কথা সেটিতে সবচাইতে মোটা অক্ষরে যে দু’টি নাম থাকার কথা তার একটি বাবার।

একটি ছোট্ট কাল্পনিক দৃশ্য দিয়ে শেষ করছি। এক ঘর থেকে আরেক ঘর অবধি যেতে নিশ্চয়ই পাসপোর্ট -ভিসা করে টিকিট কাঁটানো লাগে না, ছোট্ট সুজন গুটগুট করে ড্রয়িং-রুমে চলে যায়; সেইখানে আব্বা বসে টিভিতে একটা কি দেখছে, সেটি নিশ্চয়ই তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কারন মুখের কাছে বাটিতে খাবার জিনিস ধরা সেটি চামচ নাকে নাকি মুখে ঢুকোচ্ছেন সেটি তার বেশি হদিস নাই; সুজন চার-পাঁচবার চেষ্টা করে আব্বার কোলে উঠে বসে তারপর আব্বার থুতনি ধরে একটু টান দিয়ে বলে, আব্বা আজকে বিশ্ব বাবা দিবস সেইটা কি ভালমতো জানা নাই কিন্তু টিচার বলেছে এই দিনে আব্বাকে যেন একটা কিছু গিফট দিই-এই যে তোমার গিফট। আব্বা দেখেন ছেলে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়েছেন সেটিতে জমকালো একটা কি ছবি আঁকা: তিনি বেশ একটুসময় সেটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন এটি কিসের ছবি-দেখে মনে হচ্ছে একটা হাতি নাক উঁচা করে আওয়াজ করছে বা এইরকম একটাকিছু। সুজন একটু গরম হয়ে বলল, আব্বা এইটা তোমার ছবি। আব্বা বোকার মত হাসার একটু চেষ্টা করে বলেন, খুবই সুন্দর হয়েছে আমি তো দেখেই অবাক হয়ে গেছি-পুরা আমার মুখ।

সুজন একটু চুপ থেকে তারপর বলল, আব্বা জান-কালকে টিচার আমাদের সবাইকে যার যার আব্বাকে নিয়ে একটাকিছু লিখে দিতে বলেছিলেন, যার আব্বা যেইটা ভাল পারেন সেইটা নিয়ে লিখা। কেউ লিখেছে আমার আব্বা ভাল গান পারে কেউ লিখেছে আমার আব্বা ভাল ছবি আঁকতে পারে, একজন তার আব্বার চুল বড় সেইগুলির যত করতে কি কি কন্ডিশনার দেয়া লাগে সেইটা নিয়ে দুই পাতা লিখে ফেলল! আমি তোমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছুই খুঁজে পাই নাই! তুমি গান পারনা নাচ জানো না তোমার অনেক অনেক টাকা নাই, তুমি দেখতেও ভাল না-একটু আগেআগে ধোলাই খেয়ে এসছো-এইরকম চেহারা! আব্বা একটু হাসার চেষ্টা করে বলেন, আমার ভূড়ি নিয়ে লিখতে পারতি: দেখিস না কত বড় ভূড়ি দেখলে মনে হয় ইতালি মালয়েশিয়া আরও নানান দেশ এইটার ভিতর ঢুকিয়ে রেখেছি কিছু বাকি রাখি নাই! দুইজনেই একটু একটু হেসে ওঠে, সেটি হয়ে গেলে বেশ একটু সময় কোন কথা নাই তারপর সুজন বলে, তার ঠিক পরেপরে আমার মনে পড়ল তোমার কিছু থাকার দরকার নাই-তোমার জন্যে আমি আছি! দুনিয়ার আব্বারা: তোমাদের কোন চিন্তা নাই-তোমাদের জন্যে, তোমাদের দেখে যাওয়া স্বপ্নগুলি সত্যি করার জন্যে আমরা আছি! ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.