মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! মরণের ওপারে - ১
------------------------ডঃ রমিত আজাদ
মৃত্যু একটি সমাপ্তি। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভয়, কান্না আর দুঃখ। কেউ কেউ মানসিক প্রশান্তির কথাও বলে থাকে। জানিনা। তবে এটুকু বুঝতে পারি, মৃত্যু রহস্যে ভরা।
মৃত্যু কি? দেহের মৃত্যু হয় জানি, তারপর? আত্মা বলে কি কিছু আছে? দেহহীন সেই আত্মা কিভাবে টিকে থাকে? আমাদের এই অপার রহস্যময় জগতে খুব সামান্যই আলোর সন্ধান দিয়েছে বিজ্ঞান।
আমার দেখা প্রথম মৃত্যু ১৯৭৪ সালে। দেশ তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে। কাফনের কাপড়ও পাওয়া যায়না। সেই কাফনের কাপড়ের জন্য মিছিল হতে আমি নিজে দেখেছি।
একবার তেমনি একটি মিছিলের পিছনে পিছনে গেলাম। ঐটুকু ছোট শিশু, মৃত্যু, কাফন, মৃতদেহের কিছুই বুঝিনা। শুধু দেখলাম, মাটিতে একটা গর্ত খোঁড়া ছিল, সেই গর্তে একজন মানুষের নিথর দেহটি রাখা হলো। আমি উৎসুক্য নিয়ে উঁকি-ঝুকি দিয়ে দেখতে লাগলাম, কি হয় ওখানে। প্রাণহীন দেহটির মুখ ঢাকা ছিল।
একজন কাপড় সরিয়ে মুখটি দেখালো। কি কারণে জানিনা তার চোখটি খোলা ছিল। সেই নিথর খোলা চোখের তীব্র দৃষ্টি আমার এখনো মনে পড়ে।
এর কয়েক বছর পরে, শুনতে পেলাম, আমাদের কাছাকাছি এলাকার নোমান ভাই নামে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি বড় বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, "ঘুমের বড়ি খেলে কি হয়?" আপা বললেন, "ঘুমের বড়ি খেলে মানুষের ঘুম হয়, কিন্তু কেউ যদি খুব বেশী ওষুধ খেয়ে ফেলে, তবে সেই ঘুম আর ভাঙেনা।
" ঐটুকুই বুঝলাম, এর বেশী কিছু বুঝলাম না।
তার কয়েক মাস পরে শুনতে পেলাম আরেকটি মৃত্যু সংবাদ। কাছাকাছি বাসার এক তরুণ, কলেজে পড়ত। বাসে করে কলেজে যাতায়াত ছিল। একদিন চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে, পা পিছলে বাসের চাকার নীচে পড়ে যায়।
দুঃখজনক একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, একজন সম্ভাবনাময় তরুণের। ছ্বেলেটির মৃতদেহ যখন ঘর থেকে দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আমাদের বাড়ী থেকে তখন স্পস্ট শুনতে পাচ্ছিলাম কান্নার শব্দ। আমি তখনও ছোট, মৃত্যুর প্রকৃত রূপ সম্পর্কে ধারণা নেই। এই কান্না যে তার প্রিয়জনদের কান্না তা বুঝতে পারিনি। ধরে নিয়েছিলাম মৃত মানুষই কাঁদে।
তারপর এক সময় বুঝতে শুরু করলাম, মৃত মানুষ কাঁদেনা, বরং যারা এখনো জীবিত আছে তাদেরকে কাঁদায়। মৃত্যুর স্বরূপটিই এমন যে, যিনি চলে যান কান্না তো দূরের কথা, কোন কিছু করারই তার আর কোন ক্ষমতা থাকেনা। আর যে জগতে তিনি চলে যান, সেখান থেকে তিনি আর কখনোই ফিরে আসেন না।
সত্যিই কি তাই? তারা কি চিরকালের জন্য, আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, নাকি কোন না কোন ভাবে কোন না কোন সময়ে আমাদের কাছে ফিরে আসেন? জীবিত আর মৃত মানুষদের জগতের মধ্যে কি কোন অদৃশ্য যোগসুত্র রয়েছে?
'অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে' - দেহের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয়না। এটি গীতার বাণী হলেও, এমন কথা সব ধর্মগ্রন্থেই বলা আছে।
আমার পিতা ছিলেন আমার দাদার শেষ বয়সের সন্তান। ফলে আমি বাবার বড় সন্তান হলেও দাদার অনেক ছোট নাতি। দাদা ছিলেন নামজাদা আইনজীবি ও রাজনীতিবিদ। বৃটিশ ও পাকিস্তান দুটো বিরোধী রাজনীতিই তিনি করেছেন। তার মেধা ও সামাজিক অবস্থানের কারণে বংশের সকলেই তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সমীহ করত।
খুব কড়া মেজাজের ছিলেন বলে অনেকে ভয়ও করত। আমি খুব ছোট বয়সে ওনাকে দেখেছি। আমরা থাকতাম ঢাকায় আর তিনি থাকতেন অন্য শহরে। তাই দাদা বাড়ী না গেলে উনার সাথে দেখাও হতোনা। সেই সময় উনার সাথে কথাবার্তা কিছু হয়েছিল কিনা, আমার মনে পড়ে না।
কিন্তু আমার যখন সাত বছর বয়স দাদা ঢাকায় এলেন, চিকিৎসার জন্য। সেই সময় উনার সাথে আমার সামান্য ইন্টারএ্যকশন হয়েছিল। মেধাবী ব্যক্তি তাই আমার সাথে শিশুসুলভ দু'একটি কথার পরই আমার মেধার পরীক্ষা নিতে শুরু করলেন। স্কুলে পড়ালেখা কেমন চলছে, ইংরেজী কেমন জানি, গরু ইংরেজী কি? গাড়ী ইংরেজী কি? ইত্যাদি। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম, কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না।
ভয় হলো, মেজাজী ব্যক্তি, আবার না ধমক দিয়ে বসেন। কিন্তু না, তেমন কিছুই না। মোলায়েম স্বরে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় উনাকে দেখতে গেলাম। উনার জন্য রাখা হুইল চেয়ারটার প্রতি আগ্রহ হলো।
তিনি শিশুর মনের কথা বুঝতে পারলেন। ভৃত্যকে বললেন, "ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে, পুরো করিডোর ঘুরিয়ে নিয়ে আয়"। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। এর সম্ভবতঃ মাস ছয়েক পরে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
যেহেতু আমি খুব ছোট ছিলাম এবং দাদার সাথে ইন্টারএ্যকশনও কম হয়েছিল, তাই উনার মৃত্যু সংবাদ আমার শিশু মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
কিন্ত ঘটনা তারপরেও ঘটল। একদিন রাতে দাদাকে স্বপ্নে দেখলাম। দোতলায় যাবার সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি স্বভাবসুলভ কঠোর ভঙ্গিতে আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন। আর আমি সুবোধ শিশু তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অপলক সব শুনলাম। ঘুম ভেঙে গেল।
স্বপ্নের মাহাত্ম কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু স্বপ্নের স্মৃতিটি অম্লান হয়ে রইল। তারপর বড় হয়ে মনে হলো। এমন কি হতে পারে? দাদা তার শেষ বয়েসের নাতি, বংশের প্রদীপটির জন্য উপদেশ জমিয়ে রেখেছিলেন, সময়মতো দেবেন বলে। কিন্তু তার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন বলে, তার অতৃপ্ত আত্মা আসেন আমার কাছে, জমিয়ে রাখা উপদেশগুলো শুনিয়ে যেতে।
আরেকটি ঘটনা আমি নিজে দেখিনি, কিন্তু শুনেছি। আমার এক ফুপু ডাক্তার। তিনি মেডিক্যাল কলেজে যখন প্রথম দিন এ্যনাটমি করেন, একটি মৃতদেহের পায়ের একটা অংশ কাটতে হয়েছিল। তখন তরুণ বয়স, কিছুটা হলেও ভীতি ছিল মনে। শংকিত মনে রাতে ঘুমাতে গেলেন।
যেরকম আশংকা করেছিলেন, সেরকমই হলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন। সেই লোকটি ফুপুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, "কিরে আমার পা কেটেছিলি না? এই দেখ আমার পা কাটা"। ফুপু তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সত্যিই পায়ের ঐ যায়গাটা কাটা।
ভয়ে তার আত্মা কেপে উঠল। তিনি চাদর মুরি দিয়ে মুখ ঢাকলেন। এরপর সেই লোকটি ফুপুর গায়ের চাদর ধরে টানতে লাগল। ফুপু প্রচন্ড শক্ত করে চাদর ধরে রাখলেন। লোকটিও তার সর্বশক্তি দিয়ে টানতে লাগল।
এ পর্যায়ে ফুপু চিৎকার দিয়ে ঘুম ভেঙে উঠলেন। হৃদস্পন্দন ভীষণ বেড়ে গিয়েছে, সমস্ত শরীর ঘামে ভেজা। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। এ নিছক স্বপ্ন। তারপর ফ্লোরের দিকে চোখ গেল।
উনার গায়ের চাদরটি ফ্লোরে পড়ে আছে, মুহুর্তে ভয়ার্ত চিন্তা ঘিরে ধরল, তবে কি...? শীতল স্রোত বয়ে গেল ফুপুর মেরুদন্ড দিয়ে।
অপর ঘটনাটি ঘটেছে, কয়েক বছর আগে। আমার শ্বাশুড়ী ইন্তেকাল করেছেন দেশের বাইরে। আমার শোকার্ত স্ত্রী তখন মানসিক কষ্টে আছেন। আমরা তখন ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার একটি ছয়তলা দালানের টপ ফ্লোরে থাকতাম।
বিশাল এপার্টমেন্টে আমরা থাকতাম মাত্র তিনটি প্রাণী। বাড়ীটির বৈশিষ্ট ছিল এই যে, তার তিনদিকই খোলা ছিল। পিছনের দিকে আছে সেনানিবাসের একটা অংশ। সৈন্যদের একটি ইউনিট সেখানে বসবাস করে। গাছপালা বাগান ঘেরা জায়গাটি বিশাল।
আমার স্ত্রী কবরস্থান ভয় পান। তাই কবরস্থানের পাশে বাড়ী নিতে বরাবরই নারাজ। তাই আমার স্ত্রীকে আমি কখনই জানাইনি যে, সেনানিবাসের ঐ জায়গাটি পেরোলেই ছোটখাট একটি কবরস্থান আছে। ছমছমে অন্ধকার রাত্রিতে মাঝে মাঝে কুকুরগুলো অদ্ভুত শব্দ করে ডেকে উঠত। আমার স্ত্রী বলতেন পশুরা মানুষের আত্মা দেখতে পায়।
আর তখন এরকম শব্দ করে। এই কথা শুনে আমার ভয় ভয় লাগত। স্ত্রী জানতেন না, কিন্তু আমি তো জানতাম, যে কাছাকাছি কবরস্থান আছে। শ্বাশুড়ী ইন্তেকালের কয়েকদিন পরের এক গভীর রাত্রিতে (রাত আনুমানিক দুইটা হবে), কান্নার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কন্ঠস্বরটির সাথে আমার স্ত্রীর কন্ঠস্বরের মিল আছে।
আমি ভাবলাম মন খারাপ তাই উনি হয়তো কাঁদছেন। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি তিনি পাশে নেই। ঘুম ঘুম অবস্থায় আমি আরেকবার কান খাড়া করলাম। কান্নার শব্দটি মশারীর পাশ থেকে আসছে, অর্থাৎ রূমের ভিতরেই। মশারীর বাইরে বেরিয়ে এলাম।
নাঃ, উনি রূমেই নেই। বেলকুনির দরজাটা খোলা দেখলাম। সেই দিকে গিয়ে দেখলাম, উনি বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম, "কাঁদছো কেন?"। "আমি কাঁদছি না", উনি উত্তর দিলেন।
:তবে যে আমি কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম?
:সেটাই তো কথা।
:বুঝলাম না।
: আমিও কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছি।
: স্ট্রেন্জ!
:কন্ঠস্বরটা আমার মায়ের কন্ঠস্বরের মত।
শীড়দারা দিয়ে শীতল স্রোত চলে গেল।
আমার কাছে কন্ঠস্বরটা আমার স্ত্রীর কন্ঠস্বর মনে হয়েছিল। মা মেয়ের কন্ঠস্বরে মিল থাকারই কথা।
আমার স্ত্রী বললেন,
:আমি ভাবলাম বাইরে থেকেও কান্নার শব্দ আসতে পারে, তাই বেলকুনিতে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আমি শব্দ রূমের ভিতরে শুনলাম।
: আমিওতো রূমের ভিতরেই শব্দ শুনতে পেয়েছি।
সেই রাতে আর ভালো ঘুমাতে পারলাম না। স্ত্রী পরদিন দোয়া-কালামের ব্যবস্থা করলেন। আমি বিজ্ঞানের মানুষ। অযৌক্তিকতায় বিশ্বাস না করতে পারলে খুশী হই। কিন্তু এ যে একেবারেই আমার নিজের অভিজ্ঞতা! নিজের ইন্দ্রিয়কে অবিশ্বাস করি কি করে।
আমার স্ত্রী বলছিলেন, "হয়তো মৃত মানুষদের আত্মার একটা ভিন্ন জগত আছে। সেই জগতে দূরত্ব কোন ব্যপার না। চাইলেই হাজার মাইলের দূরত্ব সহজেই পার হতে পারেন। "
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।