আমি অতি সাধারণ মানুষ
[১]
অফিস থেকে বের হব একটু পর। হাতে কাজ নেই। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছে না। নিতুকে ফোন দিলাম।
-হ্যালো।
-কি করছ নিতু?
-কিছু না। এমনি বসে ছিলাম। তুমি কোথায়? অফিসে?
-হ্যাঁ। অফিস থেকে বের হব একটু পর। তারপর একটু বসুন্ধরা সিটিতে যাব।
-কি কিনবে?
-একটা পেনড্রাইভ কিনব। আগেরটা হারিয়ে গেছে।
-এ নিয়ে কয়টা পেনড্রাইভ হারালে?
-চারটা।
-হুমম। আচ্ছা তুমি আজকে চিটাগাং আসলে কি হত? কালতো সরকারী ছুটি।
-বৃহস্পতিবারতো আসবোই। আজকে এসে আবার কালকে চলে যেতে হবে। খুব খাটনি হয়ে যাবে।
-ধুর ধুর। মানুষ নতুন বৌয়ের কাছে আসার জন্য খালি ছুটিছাটা খোঁজে আর তুমি ছুটি পেলেও আসনা।
আমি ওকে রাগিয়ে দেয়ার জন্য বললাম- নতুন আর রইলা কই! ছয় মাস হয়ে গেল।
ওষুধে কাজ হল। নিতু রেগে গেছে। -ও আচ্ছা! ছ’মাসেই আমি পুরানো হয়ে গেছি। যাও তোমার আর আসা লাগবে না।
বৃহস্পতিবারেও আর আসা লাগবে না।
আমার খুব হাসি পাচ্ছে। আমি হাসি চেপে আছি অনেক কষ্টে। ওকে আরো একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম- ওকে। আসব না।
কিন্তু তুমিতো নিজেই চলে আসবা। মনে আছে দু’মাস আগে যখন অফিসের কাজের জন্য দু’সাপ্তাহ চিটাগাং যেতে পারিনি তখন তুমি নিজেই এসে হাজির হয়েছিলা ঢাকায়? আমারতো মনে হয় এবারো তাই হবে।
নিতু আরো রেগে গেল। -ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার তখন ভার্সিটি বন্ধ ছিল। তাই ঢাকা গিয়েছিলাম।
এখন ক্লাস চলছে। তাছাড়া সামনের সাপ্তাহে আমার পরীক্ষাও আছে। সুতরাং আমি ঢাকা আসছি না।
আমি আর হাসি চেপে রাখলাম না। হাসতে হাসতেই বললাম- সে দেখা যাবে।
আজকে তোমার সিরিয়াল আছে নাকি? কি জানি একটা দেখো?
-ভাল কথা মনে করেছ। আজকে সিরিয়াল আছে। এখন কয়টা বাজে?
-পৌনে ছয়টা। সিরিয়াল কয়টায়?
-রাত সাড়ে আটটায়।
-কি যে মজা পাও এগুলা দেখে।
হাবিজাবি ফালতু জিনিস।
-দেখো আমি মোটেও ফালতু জিনিস দেখি না।
আমি নিতুর কথা নকল করে বললাম- না তুমি মোটেও ফালতু জিনিস দেখ না। খালি একটু পরপর খসবস সাউন্ড হয়, আর এর মুখে ক্লোজ-আপ শর্ট নিয়ে দেখায়, ওর মুখে ক্লোজ-আপ শর্ট নেয়। কোনো মানে হয়!
-দেখ যেটা বুঝনা সেটা নিয়ে তর্ক করবা না।
-শোন, এই খসবস সাউন্ডওলা জিনিস না দেখে বিটিভি দেখ, কাজে দিবে।
-একদম ফালতু কথা বলবা না। ধুর, তোমার ফোন ধরাই ঠিক হয় নাই। মেজাজটাই খারাপ করে গেছে তোমার সাথে কথা বলে।
-শোন বিটিভি দেখ, তোমার উপকারের জন্যই বলছি।
-কি উপকার হবে আমার বিটিভি দেখলে?
-এই পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান হয়। গর্ভবতি মহিলাদের সাস্থ্য বিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান দেখায়। এসব তোমার উপকারে আসবে। আফটার অল তোমার ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষাতো দু’মাস পরেই শুরু হবে। পরীক্ষার পরেই না হয়…………………..
-তুমি একটা……………………..
নিতুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম- আমি একটা কি সেটা পরে শুনব।
এখন রাখি। বাথরুমে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
[২]
ক্রিং ক্রিং। ক্রিং ক্রিং।
আমি পকেট থেকে ফোন বের করলাম।
নিতু ফোন করেছে। -বল নিতু।
-তুমি কি বসুন্ধরা সিটি?
-হুমম।
-আমার জন্য একটা হেডফোন কিনো। আমার হেডফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
-কিনে লাভ কি? তোমাকে এটা দিবো কিভাবে?
-দিবো কিভাবে মানে? তুমি বৃহস্পতিবার আসবা না, তখন নিয়া আসবা।
-তুমি না আমাকে বল্লা যে আমি যেন আর চিটাগাং না আসি!
-উফফ তুমি…………………….। শোন, কথা পেচাবা না। যা বললাম তাই কর।
-আমি কথা পেচালাম কই? তুমি না আমায় মানা করলা যেন আর চিটাগাং না আসি!
-ওকে।
কথা উইথড্র করলাম। হেডফোন কিনে এনে দিয়ে যাও। তারপর আর আসা লাগবে না।
আমি হাসতে হাসতে বললাম- আমি বললাম না তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবা না। এখন হেডফোন নিয়ে বাহানা করছ।
তারপর আরেক বাহানা ধরবা। আমার চিটাগাং আসতেই হবে।
-ধুর ধুর। তোমার সাথে কথা বলাই ঠিক হয় নাই। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।
………………….ও শিট। কারেন্ট চলে গিয়েছে। আজকের সিরিয়ালটাও মিস। ধুর ধুর।
আমি ঘড়ি দেখলাম।
সোয়া আটটা বাজে। আজকে আর ওর সিরিয়াল দেখা হবে না। -“ধুর ধুর” বলাটা তোমার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে।
-শোন, মানুষের এত দোষ ধরবা না। নিজের চরকায় তেল দাও।
-আমিতো মানুষের দোষ ধরছি না। আমি আমার বউয়ের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছি।
-ওরে আমার ভুল ধরা বাবুরে, চুক চুক চুক…………………………….। বাসায় যাবা কখন?
-দশটা বাজবে মনে হয়।
-বাসায় রান্না করা আছে কিছু? খাবা কি?
-কিছুই রান্না করা নাই।
বাসায় গিয়ে রাঁধতে হবে।
-আজকে কি আবার রাত জাগবা নাকি? কোন খেলা আছে?
-দুঃখের বিষয় আজকে কোন খেলা নেই। সোমবার ইউরোপের লীগগুলাতে সাধারণত খেলা থাকে না। মাঝে মধ্যে সোমবার খেলা হয়। কিন্তু আজকে কোন খেলা নেই।
খেলা থাকলে ভাল হত। শান্তিতে খেলা দেখে সারা সকাল ঘুমিয়ে কাটানো যেত।
-কি যে মজা পাও এই খেলা দেখে। রেজাল্ট দেখলেইতো হয়।
-স্রষ্টা খেলা বুঝার সামর্থ তোমাদের মত নারীদের দেন নাই।
তোমাদের মাথায় আছে শুধু সিরিয়াল আর সিরিয়াল। সিরিয়ালে মাথা গিজগিজ করে।
-আমার অতো খেলা বুঝে কাজ নাই। শোন খেলা যেহেতু নাই তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরবা। কালকে সকালে উঠে বাসাটা একটু পরিস্কার কোরো।
আমি ঢাকা থেকে আসার পর বাসাটা আর পরিস্কার করেছ?
-না, আর করা হয় নাই।
-আমিও তাই ভাবছিলাম। তুমি যেই খবিস। তুমি যেই বিছানায় ঘুমাও…….ওয়াক থুঃ। আমার দেখে পুরা বমি এসে গিয়েছিল।
আমি আসার পরে আর ধুয়েছিলে?
-না। আর ধোয়া হয় নাই।
-আচ্ছা তোমার কি আর কোনো বিছানার চাদর নাই? দু’মাস ধরে একই চাদরে ঘুমাচ্ছ!
-চাদর আছে আরো দুইটা। ওগুলা রেখে দিয়েছি। তুমি আসলে বিছাব।
তাহলে আর তোমার বমি আসবে না। আব্বা-আম্মা কই?
-বাবা-মা একটা বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছে।
-এই সোমবার বিয়ের দাওয়াত?
-মনে হয় কমিউনিটি সেন্টার খালি পায় নাই।
-তুমিতো আমার বাপ-মাকে কি জাদু করেছ কে জানে! আগে আম্মা প্রতিদিন ফোন করে খোঁজখবর নিত। বিয়ের পর আর ঠিকমত ফোন করে না।
পুত্রবধু পেয়ে পুত্রের কথা ভুলেই গেছে।
-শোন, আমি একটা লক্ষী মেয়ে। এরকম লক্ষী মেয়ে বউ হিসেবে পেলে শাশুড়ি নিশ্চিন্ত হয়। উনি জানে তার ছেলে ভাল থাকবে। বউ নিয়মিত তার ছেলের খোঁজখবর নিবে।
তাই উনি আর ছেলের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকেন না।
-তাই হবে হয়ত। আচ্ছা এখন রাখি। পরে কথা হবে।
-বাই।
তাড়াতাড়ি বাসায় যেও। বাইরে বেশি ঘুরাঘুরি কোরো না।
[৩]
-হ্যালো নিতু, কি করছ?
-ভাত চুলায় বসিয়ে বসে আছি।
-রাতে কি খাবা?
-বাবা ইলিশ মাছ এনেছেন আজকে। ইলিশ মাছ ভাজব।
এখন ভাত চুলায়। ভাত রান্না হলেই ইলিশ মাছ ভাজব।
-শুনেইতো আমার জিভে জল এসে গেল।
-জল আসলে সুড়ুত করে আবার গিলে ফেল। চিটাগাংতো আর আসলে না!
-শামিম কোথায়?
-ও বাসায় নাই।
সন্ধ্যায় বেড়িয়েছে।
-ওকি রেগুলার রাত করে বাসায় ফিরে নাকি? এখনতো দশটা বাজে!
-দশটা আর এমনকি রাত! ও চলে আসবে। তুমি কি এখনও বাইরে?
-হুঁ। বাসায় যাচ্ছি।
-আর কতক্ষণ লাগবে?
-এই আর পাঁচ মিনিট।
-বাসায় গিয়ে খাবা কি?
-আলুভর্তা, ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খাব।
-ধুর, আমি ইলিশ ভাজি খাব। আর তুমি খাবে ডিমভাজি। আমার ভাললাগছে না।
-সমস্যা নাই।
ঢাকায় আসলে তোমাকে তিনবেলা ডিমভাজি খাওয়াব।
-তুমি হেডফোন কিনেছ?
-না আজকে কিনি নাই। সময় পাই নাই। পরে কিনে দিব।
-আচ্ছা।
শোন, আমার না আসলেই ভাল লাগছেনা। ধুর আজকে আর ইলিশ মাছ ভাজব না। আমিও ডিমভাজি খাব। তুমি চিটাগাং আস। তারপর ইলিশ ভাজব।
তুমিতো ইলিশ ভাজি খুব পছন্দ কর।
-আরে ইলিশ ভাজ। খামোখা ডিমভাজি খাবা কেন! আমার আসা না আসতে কি সমস্যা?
-আমার খেতে ইচ্ছা করছে না……………………….একটু ধর। কলিং বেল বাজল। মনে হয় শামিম এসেছে।
নিতু দরজা খুলে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। আমি হাসিমুখে বাইরে দাড়িয়ে আছি। নিতু কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত দাড়িয়ে আছে দরজায়। কি করবে বুঝতে পারছে না।
-আমাকে ঢুকতে দিবে, নাকি দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে?
[শেষকথা]
আমি আর নিতু বারান্দায় বসে আছি।
রাত একটা বাজে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বর্ষার আকাশ মেঘে ঢাকা। চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
খুব সুন্দর একটা পরিবেশ।
-আচ্ছা তুমি প্লেনে করে আসছ এটা আগে জানাওনি কেন?
-এমনি জানাইনি। জানালে দরজা খোলার পর তোমার ঐ হতভম্ব হওয়া মুখটা আর দেখা হত না।
-তুমি আজ আসলে কেন?
-কারণ তুমি হচ্ছ আমার নতুন বউ। ছ’মাস কেন, ছ’যুগেও পরেও তুমি নতুনই থাকবে।
[উৎসর্গঃ আমার সব নব্য বিবাহিত বন্ধুদের]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।