আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যযুগের বাংলার ভাববিপ্লবের স্বরূপ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগের চিন্তাশীল বাঙালির জীবনে সে এক দারুণ সুসময় এসেছিল বটে। অত্যন্ত উজ্জ্বল সেই সময়টায় বাঙালি চিন্তার ক্ষেত্রে ভোগ করেছিল এক অফুরান স্বাধীনতা । বাংলার ইতিহাসে যে সময়টা পাল আমল বলে চিহ্নিত হয়ে আছে- বাঙালি সেই গৌরবের যুগে চিন্তার জগতে এক অবিস্মরণীয় র্কীতি রচনা করেছিল।

আমরা অবগত আছি যে পাল রাজারা প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলা শাসন করেছিল। বাঙালি তার ভাববিপ্লব ঘটিয়েছিল সেই সময়টায় । সে কি এ দুর্দান্ত সময়! ঐতিহাসিকগণ আজ নির্দ্ধিধায় স্বাক্ষ্য দেন, পালরাজাগণের শাসননীতিও ছিল প্রজা-বৎসল। (দেখুন: আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি। পৃষ্ঠা ১১৩) পাশাপাশি পাল রাজাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অত্যন্ত উদার এবং অসাম্প্রদায়িক।

ধর্মপালের একটি ঘোষনায় তারই প্রমাণ রয়েছে। ধর্মপাল ঘোষনা করেছিলেন, তিনি সকল শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞাত এবং যাতে সব ধর্ম-বর্ণ তাদের কার্যকলাপ বজায় রাখতে পারে সেদিকে তিনি তৎপর থাকবেন। আধুনিক বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে আমরা এ ধরনের উদার ঘোষণা আশা করতে পারি কিনা সন্দেহ! এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হল সংক্ষেপে মধ্যযুগের বাঙালির ভাববিপ্লবের স্বরূপ আলোচনা করা। পাশাপাশি মধ্যযুগের ভাববিপ্লবের সুমহান ধারাটি যে অত্যন্ত বেগবান গতিতে বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা। মধ্যযুগের বাঙালির ভাববিপ্লবের মূলকেন্দ্রে ছিলেন উদার এবং অসাম্প্রদায়িক পাল শাসকগণ।

তারা যে উদার ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিমন্ডল সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিলেন তারই ছায়াতলে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করে সেই যুগের বিদগ্ধ বাঙালি কবি এবং চিন্তাবিদেরা তাদের স্বাধীন ধ্যানধারণা প্রকাশ করেছিলেন। তৎকালীন বাংলার ধর্মীয় বাস্তবতা ছিল মহাযানী বৌদ্ধধর্ম। চিন্তার স্বাধীনতা থাকলে যা হয়- বাংলায় মহাযানী বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর ঘটেছিল । তো কারা এই রূপান্তরের কুশীলব ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর হল: ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিখ্যাত লাল নীল দীপাবলী বইতে যাদের ‘গৃহত্যাগী বৌদ্ধবাউল’ বলেছেন তারা। সেই বৌদ্ধবাউলদের সংসার ছিল না।

তাঁরা এক গোপনতত্ত্বের সাধনা করতেন । তারা ছিলেন দেশপ্রেমিক। কেননা, আগে বাংলায় মহাযানী বৌদ্ধধর্মের চর্চা হত সংস্কৃত ভাষায়। সেই গৃহত্যাগী বৌদ্ধবাউলেরা বললেন, আমরা সংস্কত ভাষায় লিখব না। তাহলে? পালি ভাষায়? যে ভাষায় বুদ্ধ কথা বলতেন, ধর্ম প্রচার করেছেন? তারা বললেন, না।

আমরা পালি কিংবা সংস্কৃত ভাষায় লিখব না। আমরা আমাদের দেশের ভাষায় লিখব। তারা যে ভাষায় লিখলেন, সেই ভাষাই বাংলা ভাষার আদিনিদর্শন। অর্থাৎ তাঁরাই ‘চর্যাপদ’ লিখেছিলেন। ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন,‘বাঙলা ভাষার প্রথম বইটির নাম বেশ সুদূর রহস্যময়।

বইটির নাম চর্যাপদ। ’ মধ্যযুগের বাংলার ভাববিপ্লবের কুশীলবের লেখা বইয়ের নামই, ‘চর্যাপদ’। তাদের কয়েকজনের নাম হল কাহ্নপাদ, লুইপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, ঢেন্টনপাদ, শবরীপাদ। শবরীপাদ- এর লেখা একটি কবিতার দুটি চরণ পাঠ করা যাক- উষ্ণা উষ্ণা পাবত তর্হি বসই সবরী বালী। মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরীমালী।

যেখানে উঁচু উঁচু পাহাড় আছে সেখানে বাস করে শবরী বালিকা । তার পরনে ময়ূরের বহুবর্ণ পালক, গলায় গুঞ্জা ফুলের মালা। এই আপাত বোধগম্য কথার আড়ালে নিহিত রয়েছে গভীর এক তত্ত্বকথা। কাজেই এখানে প্রতিটি শব্দই প্রতীকি। কাজেই কবিতার আবহে সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর মরমী রহস্যময়তা।

বলাবাহুল্য, বাংলার ভাবজগতে এই মরমী ধারাটি আজও বহমান । লালন-এর একটি গান এই রকম: কি সন্ধানে যাই সেখানে আমি মনের মানুষ যেখানে আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি দিবারাত্রি নাই সেখানে ... মরমীবাদ চর্চা ছাড়াও সেই মধ্যযুগের বাংলার চর্যাপদের কবিদের অনেকেই ছিলেন যুক্তিবাদী চেতনার অধিকারী। কবি সরোজবজ্র ছিলেন তাদেরই অন্যতম। তাঁর লেখা ‘দোহাকোষে’ আমরা যুক্তিবাদের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়ে চমকে উঠি। সরোজবজ্রর কিছুর অসাধারণ বক্তব্য পাঠ করা যাক- হোমাগ্নি মুক্তি প্রদান করে কিনা কেউ জানে না।

তবে তার ধোঁওয়া চোখকে পীড়িত করে। যদি নগ্নতা (বৌদ্ধ ও জৈন ক্ষপনক সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রচলিত) মুক্তি প্রদান করতে পারে, তবে কুকুর ও শৃগাল তা পাবে সবার আগে। বলা হয়ে থাকে যে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণদের জন্ম। কিন্তু তাতে কি? আজকাল তাদের জন্ম অন্য সবার মতোই। তাহলে তাদের (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের) উচ্চতর অবস্থানের কারণ রয়েছে কি? যদি একথা স্বীকার করা হয় যে ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন ‘সংস্কারে’র ফলে উচ্চতর স্থান অর্জন করে, তাহলে আমি বলব চন্ডালদের ঐ সব ‘সংস্কার’ পালন করতে দেওয়া হোক যাতে তারা ব্রাহ্মণ হতে পারে।

যদি তোমরা বল যে বেদ-এর জ্ঞানই তাদের ব্রাহ্মণ করে, তাহলে চন্ডালদের ‘বেদ’ পড়তে দাও। সেই যুগে চন্ডালদের পক্ষে কথা বলা সহজ কথা ছিল না। কেননা চন্ডালরা সে যুগে কেবল ধর্মীয় ভাবেই কোণঠাসা ছিল না, তারা ছিল সমাজের হর্তাকর্তা প্রভুদের সুখ-সুবিধার কাছে জিম্মি! অথচ, সেসবের পরোয়া না-করে মহাত্মা সরোজবজ্র সেই প্রান্তিক চন্ডালদের পক্ষ নিয়েছিলেন! তাঁর প্রবল যুক্তিবোধ এবং বৈপ্লবিক সমাজচেতনার ফলেই এমনটি সম্ভব হয়েছিল। মহাত্মা সরোজবজ্রর এমনতরো মানবিক এবং যুক্তিবাদী বাণীতে জাতপাতবিরোধী বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এই জাতপাতবিরোধী অবস্থান বাংলার চেতনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

যে কারণে মহাত্মা সরোজবজ্রর বহু বছর পরে লালনের একটি গানে তারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই। একটা পাগলামী করে জাত দেয় অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধুলার মাঝে তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে ... বিস্ময়কর এক সামাজিক ভাববিপ্লবের স্ফূরণ ঘটেছিল মধ্যযুগে। এবং তার জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল, যুগে যুগে মানবতাবাদী সাধকগণ সেই বিপ্লবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। মধ্যযুগের সেই ভাববিপ্লব সম্ভব হয়েছিল বাংলার উদার পাল রাজাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার ফলে। যে ভাববিপ্লব বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ছিল যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী এবং নারীবাদী।

এবার সংক্ষেপে এই ভাববিপ্লবের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা যাক। এ নিবন্ধের শুরুতে বলেছি তৎকালীন বাংলার ধর্মীয় বাস্তবতা ছিল মহাযানী বৌদ্ধধর্ম। (খ্রিস্টপূর্ব যুগেই বৌদ্ধধর্ম মহাযান এবং হীনযানে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল) বাংলায় মহাযানী বৌদ্ধধর্মের চর্চা অব্যাহত ছিল। তবে চিন্তার স্বাধীনতা থাকলে যা হয়- মহাযানী বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর ঘটেছিল বাংলায়। এবং প্রথমে তা মন্ত্রযান এর রূপ নিয়েছিল ।

(বিস্তারিত দেখুন । নীহাররঞ্জন রায়। বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব। পৃষ্ঠা; ৫২৬) বাংলার মহাযানী বৌদ্ধপন্ডিতেরা ‘বির্মূত’ ধারণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

অথচ বাংলার সাধারণ জনসাধারণের কাছে যাদুবিদ্যা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়। যে কারণে বাংলার একদল বৌদ্ধ আচার্য মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি নতুন রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন, যাদের কাছে মন্ত্রই ছিল মূল প্রেরণা। এই হল, ‘মন্ত্রযান’। মহাযানের বিবর্তনের দ্বিতীয় স্তরটি হল ‘বজ্রযান’। এর তত্ত্বটি বেশ জটিল এবং এতে নারীপ্রাধান্য রয়েছে।

এ ছাড়া বজ্রযানে মহাসুখের ধারণা রয়েছে, সেই সঙ্গে যৌনতারও গুরুত্ব রয়েছে। বজ্রযানের মূলকথা হল দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, সংসার সমস্তই শূন্য। শূন্যতার এই পরম জ্ঞানই নির্বান। যাই হোক। বজ্রযানী সাধনার সূক্ষ্মতর স্তরই সহজযান।

চর্যাপদের কবিরা ছিলেন সহজযানী এবং সে কারণেই মরমী। মরমী তবে বকধার্মিক নয়! সহজযানী আচার্যগণ তাদের সাহসী ধ্যানধারণার কথা তাদের লেখা দোহাকোষ লিখে গেছেন। ওই সময়ের লেখা একটি দোহা পাঠ করা যাক। এস জপহোমে মন্ডল কম্মে অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে। অর্থাৎ এই জপ -হোম-মন্ডল কর্ম নিয়ে সারাক্ষণ বাহ্যধর্মে লিপ্ত আছিস।

এই বাক্যে যেন অনিবার্যভাবেই সরোজবজ্রর যুক্তিবাদীর স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বেরুচ্ছে। এ যুগের মতো সে যুগেও ধর্মের External Observances পালন করে কিছু মানুষ বকধার্মিক সেজে থাকত। তাদের বিরুদ্ধেই সহজযানী কবির এই তীব্র বিশেদগার, বিদ্রুপ। বকধার্মিকের বাহিক্য ধর্মপালনের অসারতা আঙুল তুলে যেন দেখিয়ে দিচ্ছেন এক যুক্তিবাদী কবি । পরবর্তীতে লালনের একটি গানে এই বিষয়টিই শ্লেষভরে উঠে এসেছে- প্রেম জান না প্রেমের হাটের বুলবুলা ও তার কথায় দেখি ব্রহ্ম-আলাপ মনে গলদ ষোল কলা।

বেশ করে সে বোষ্টমগিরি রস নাই তার গুমোর ভারি। হরি নামের ঢু ঢু তারি তিনগাছি তার জপের মালা। সমাজে নারীর যথার্থ সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ব্যতীত যথার্থ ভাববিপ্লব সার্থক হয়ে ওঠে না। বাংলার মধ্যযুগেও আমরা তেমনিই দেখি। মধ্যযুগের মহানুভব বাঙালি কবিরা নারীকে এক নতুন মর্যাদা দিয়েছেন।

একজন সহজযানী কবির লেখায় আমরা পাই- তো বিনু তরুণি নিরন্তর নেহে বোধি কি লব ভই প্রণ বি দেহেঁ। অর্থাৎ তোর নিরন্তর স্নেহ বিনা, হে তরুণি, এই দেহে কি বোধিলাভ হয়? কি নির্মল চিন্তা! যেকোনও সমাজেই নারী যেখানে প্রতিনিয়তই পুরুষের আধিপত্যে কোণঠাসা,বিপর্যস্ত, ধর্ষনের বস্তু, সেখানে সহজযানী কবি বোধি লাভের জন্য নারীর স্নেহ কামনা করছেন। লক্ষ্য করুন, স্নেহ,কাম নয়, স্নেহ। নারীর প্রতি মধ্যযুগের বাঙালি কবির এই গভীর শ্রদ্ধার নির্দশন দেখে আমাদের বিস্মিত হতে হয় বৈ কী। নারীর প্রতি চর্যাপদের কবিদের এই যে মনোরম দৃষ্টিভঙ্গি একে কি চিন্তাজগতে রেনেসাঁ বলা যায় না? অবশ্যই বলা যায়।

যে ভাববিপ্লব সম্ভব হয়েছিল ধর্মপালের মতো মহৎ শাসকের প্রত্যক্ষ ভূমিকায়? পরিশেষে বলতে পারি, পাল আমলে যে বাংলায় একটি মানবিক এবং যৌক্তিক ভাববিপ্লব ঘটে গিয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সেই ভাববিপ্লবটি এমন একটা সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যখন ইউরোপ নিমজ্জিত প্রবল ধর্মীয় কুসংস্কারে। জগতের অন্যান্য অঞ্চলের স্বাধীন চিন্তার দীপশিখাটিও ছিল নিভু নিভু প্রায় ... সেই যাই হোক। মধ্যযুগে সূচিত মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী চেতনার আলো বাংলা আজও ধরে রেখেছে। সেই উজ্জ্বলতম পথ ধরেই পরবর্তীকালে উচ্চারিত হয়েছিল- সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। কিংবা, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর মানুষেরি মাঝে স্বর্গনরক, মানুষেতে সুরাসুর।

সহায়ক গ্রন্থ নীহাররঞ্জন রায়। বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব। আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি হুমায়ুন আজাদ; লাল নীল দীপাবলী। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.