বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ লেখার শুরুতেই কবি আল মাহমুদের লেখা একটি কবিতার দুটি চরণ উদ্বৃত করি।
মধ্যযুগের এক যুবক গোস্বামী/
দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ। (সোনালি কাবিন)
কি এর মানে? কে দেহে পথের নির্দেশ পেতে চায়? পথের নির্দেশই-বা কি? এই সব প্রশ্ন আমাদের আলোরিত করে বৈ কী।
এবং আমরা বুঝতে পারি যে মধ্যযুগের বাংলায় ভাবুকগন দেহবাদী সাধনমার্গের আশ্রয় নিয়েছিল। ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে আরও বোঝা যায় যে- মধ্যযুগের বাংলার সেই দার্শনিক ভাবনায় আর্যপূর্ব উপাদান ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ শতক থেকে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ-এই ৮০০ বছর ধরে বাংলায় আর্য ভাবধারা বিস্তার লাভ করে। এই সময়ে বাংলার জনসমাজে বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পাশাপাশি বাংলায় আর্যপূর্ব অবৈদিক ধারাটি বিদ্যমান ছিল।
দেহে পথের নির্দেশ পাবার ইঙ্গিতটি অনার্য চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা যেতে পারে।
কিন্তু কীভাবে মধ্যযুগের বাংলায় দেহবাদী ধ্যান ধারণার উদ্ভব হল?
এই প্রশ্নটির উত্তর আমাদের বাংলায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের মধ্যে খুঁজতে হবে। কেননা, বাংলার অন্যতম প্রাচীন ধর্মটিই ছিল বৌদ্ধধর্ম। যে বৌদ্ধধর্মটি কালক্রমে দুটি মূলধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি মহাযান ।
এবং অন্যটি হীনযান। মহাযান অর্থ- মহৎ মার্গ (যে মহৎ পথে যান (শকট) চলে) বা পথ। যে বুদ্ধ নির্দেশিত নির্বাণে উপনীত হতে এবং বুদ্ধত্ব লাভে আগ্রহী, সে যে মহৎমার্গ বা উপায় অবলম্বন করে তারই নাম মহাযান। হীনযানীরা বুদ্ধত্ব লাভে আগ্রহী নয়, তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের এবং তপস্যার মাধ্যমে নির্বান লাভে আগ্রহী । এ জন্য মহাযানীরা এ মতকে হীন মনে করে।
দুটি সম্প্রদায়ের বিভক্তির এটিই মূল কারণ।
ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মহাযানীপন্থা চীন ও জাপানে প্রচার করেছিলেন। গুপ্তযুগের ভারতবর্ষে মহাযান বেশ প্রসার লাভ করেছিল। গুপ্তযুগের পরে অবশ্য বৌদ্ধধর্মের অবনতি সূচিত হয়। বৌদ্ধমঠগুলি শূন্য পড়ে আছে ... চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ এর লেখায় এরকম বর্ণনায় পাওয়া যায়।
তবে বৌদ্ধধর্ম একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। বিহারের নালন্দা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলার পাল রাজাদের আমলে অন্যতম বিদ্যাপীঠের মর্যাদা লাভ করেছিল।
সে যাই হোক । গুপ্ত যুগের পর ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক মানের বেশ অবনতি ঘটেছিল । এ প্রসঙ্গে সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গুপ্তযুগের সমাপ্তির পর থেকে সমবেদী মায়াবিদ্যা ও যৌনঅতীন্দ্রিয়বাদের আদিম ধারণা ভারতীয় ধর্মে পরিব্যপ্ত হয়েছিল।
’ (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা; ১৪০) এই আদিম বা আর্যপূর্ব ধারণা বৌদ্ধমতকেও প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে অষ্টম শতকে বাংলা ও বিহারে (মগধে) মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম পরিবর্তিত হয়ে। ‘বজ্রযান’ নামে একটি মতবাদ গড়ে ওঠে। বিহারের বিক্রমশীলা মঠটি ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের অন্যতম সাধনমার্গ।
একাদশ শতকে এই মঠের বজ্রপন্থিগন তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বাংলার অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অন্যতম। বাংলার পাল রাজারা বজ্রযানী মতবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এবার বাংলায় বজ্রযান মতের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচনা করব।
বৌদ্ধধর্মকে বাংলার আর্যপূর্ব লোকায়ত ভাবধারা প্রভাবিত করেছিল।
(যে আর্যপূর্ব লোকায়ত ভাবধারা পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মকে প্রভাবিত করে লোকায়ত ইসলামে রূপান্তরিত করেছিল) শিকড়টি প্রাচীন সভ্যতায় নিহিত বলেই বাংলার লোকায়ত ভাবধারায় রয়েছে নারীপ্রাধান্য। এ কারণে বাংলাকে আজও আমরা বলি "মাতৃতান্ত্রিক বাংলা। " বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবির কবিতায় বাংলা মায়ের পরিচয় ফুটে উঠেছে এভাবে-
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥
কাজেই মাতৃতান্ত্রিক বাংলা অনিবার্যভাবেই মহাযানী বৌদ্ধধর্মকে প্রভাবিত করেছিল।
মহাযানীপন্থার অন্যতমা দেবী ছিলেন প্রজ্ঞাপারমিতা। তখন একবার বলেছি যে মহাযানীরা বুদ্ধত্ব লাভে আগ্রহী এবং বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত হচ্ছেন তিনি যিনি বারবার জন্মগ্রহন করেন এবং অপরের পাপ ও দুঃখভার গ্রহন করে তাদের আর্তি দূর করেন। মহাযানীপন্থায় কয়েক জন বোধিসত্ত্ব রয়েছেন। এঁদের মধ্যে অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী এবং বজ্রপানি প্রধান।
প্রজ্ঞাপারমিতা কে বোধিসত্ত্বেরই গুণাবালীর মূর্ত রূপ বলে মনে করা হত। বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী কল্পনা করা হয়েছিল। এই দেবীই ছিলেন দেবতাদের প্রকৃত শক্তি। দেবতাকে মনে করা হত সদূর এবং অজ্ঞেয় এবং দেবীকে সক্রিয় মনে করা হত। এই ধারণার পিছনে, আমি মনে করি, সাংখ্যদর্শনের প্রভাব রয়েছে।
সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা কপিল ছিলেন প্রাচীন বাংলার একজন দার্শনিক। কপিলের একটি বিখ্যাত উক্তি হল: ‘প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক চঞ্চলা, পুরুষ অপ্রধান। ’ সে যাই হোক। মহাযানীরা বিশ্বাস করতেন যে: দেবতাকে পেতে হলে দেবীর সাহায্য নিতে হয়। সৃষ্টিকে ভাবা হত যৌনমিলনের প্রতীক।
কাজেই কোনও কোনও মহাযানী সম্প্রদায়ে যৌনমিলন ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছিল।
এই যৌনবোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মরমী অতীন্দ্রিয়বাদ । হীনযানীরা বিশ্বাস করতেন মুক্তির উপায় হল ধ্যান এবং আত্মসংযম। পক্ষান্তরে, মহযানীরা মনে করতেন মুক্তি অর্জনে প্রয়োজন স্বয়ং বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বর দাক্ষিণ্য। এভাবে উদ্ভব হয় বজ্রযানী মতবাদ।
বজ্রযানীরা বিশ্বাস করতেন যে মোহিনী শক্তি আয়ত্ব করে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। এই শক্তিকে 'বজ্র' বলা হত। বজ্র নারীরই অন্যতম শক্তি। এ জন্য বৌদ্ধধর্মের নতুন শাখার নাম হয়েছিল বজ্রযান। তাহলে বজ্রযানের উদ্ভবস্থল হিসেবে কি আমরা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামটিকে চিহ্নিত করতে পারি? যে গ্রামে দশম শতকে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়েছিল?
কিন্তু, বাংলায় কারা প্রথম বজ্রযানের ধারণা conceive করেছিলেন?
মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধসমাজে স্থবিরবাদ নামে একটি দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়েছিল ।
স্থবিরবাদীরা মনে করতেন: যে কেউ নিরাসক্তি এবং মানসিক অনুশীলনের উচ্চ স্তরে পৌঁছলে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী হতে পারে। বুদ্ধ যাদুবিদ্যা চর্চার নিন্দা করতেন। অথচ বাংলার স্থবিরবাদীগণ যাদুবিদ্যা চর্চা করতেন। পাশাপাশি প্রত্যেক বৌদ্ধই যে মঠের সংযত জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনুমান করায় যায়, এই প্রতিষ্ঠানবিরোধীরাই বজ্রযানের ধারণা প্রথম conceive করেছিলেন ।
এর আগে একবার বলেছিলাম যে: পাল রাজারা বজ্রযানী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। পাল রাজারা বাংলায় বজ্রযানী মতবাদের একটি বিধিবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। পাল যুগের বাংলায় বজ্রযানীদের প্রভূত সম্মান ছিল।
বজ্রযানীদের প্রধানা দেবী হলেন তারা। ইনি ছিলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী।
মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী যোগীনি -প্রমূখ তুচ্ছ দেবীও বজ্রযানীদের আরাধ্য ছিল। বজ্রযানীগণ বিশ্বাস করতেন দেবদেবীদের করূণা ভিক্ষা করে লাভ নেই। এদের বাধ্য করতে হবে। যে গ্রন্থে এ কাজ করার উপায় তাদের বলা হত ‘তন্ত্র’। যে কারণে বজ্রযান কে বলা হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম।
মন্ত্র এবং যন্ত্র -এ দুই হল বজ্রযানের সাধনার উপকরণ। যন্ত্র হল মোহিনী প্রতীক, যা সঠিক ভাবে আঁকতে হয়। (মোহিনী প্রতীক হল religious symbolism. যা মার্কিন লেখক ড্যান ব্রাউন আধুনিক পাঠকে কাছে পরিচিত করেছেন । )
বজ্রযানের প্রধান মন্ত্র হল:
ওম মনিপদ্মে হূম
আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম ...
পূর্বেই একবার উল্লেখ করেছি যে: বিহারের বিক্রমশীলা বিহারটি ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্র। একাদশ এই মঠের বজ্রযানী বৌদ্ধরা তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন ।
তিব্বতে আজও অসংখ্যবার ‘ওম মনিপদ্মে হূম’ জপ করা হয়। আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম -এই মন্ত্রটি বুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাপারমিতার এবং বোধিসত্ত্ব এবং তারা দেবীর যৌনমিলনের প্রতীক। তবে বজ্রযান কেবলি যৌন সাধনপন্থ নয়, বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি রহস্যময় রূপ।
এভাবে বজ্রযান হয়ে উঠেছিল যৌনঅতীন্দ্রিয়বাদী ...
তবে বজ্রযানে ধ্যানের গুরুত্বকে অবহেলা করা হয়নি। বজ্রযানীর উদ্দেশ্য ছিল যৌনচর্চার মাধ্যমে দেবীর কৃপা লাভ করে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা অর্জন।
যা একটি ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা থেকে ভারতবর্ষের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বজ্রযানী সাধকদের বলা হত সিদ্ধ অথবা সিদ্ধাচার্য। এঁদের সংখ্যা ছিল ৮৪। পূর্বে মহাযানপন্থার বইপুস্তক লেখা হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায় । বজ্রযানী সিদ্ধাচার্যগণ লিখতেন বাংলায় ।
তাদের ভাবনার সঙ্কলনই- চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ। চর্যাপদই বাংলা ভাষার আদিরূপ। একজন অন্যতম বজ্রযানী হলেন লুই পা। লুই পা কে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের আদি কবি। বজ্রযানী কবিরা রাগ-রাগিণীর মাধ্যমে সুরে সুরে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মীয়তত্ত্ব পৌঁছে দিতেন।
বাংলায় সংগীতের মাধ্যমে দর্শন চর্চার সেই শুরু ...
যা বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে আজও অব্যাহত রয়েছে।
আবহমান বাংলার এই এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য ...
ধর্মমতের বিবর্তন অনিবার্য। বজ্রযান থেকে উদ্ভব হয়েছিল সহজযানের। বজ্রযানীরা রহস্যময় সব আচার অনুষ্ঠান ও ব্রত পালন করত। সহজযানীরা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা অস্বীকার করেছিল।
সহজযান আসলে বজ্রযান এরই সূক্ষ্মতর রূপ। সহজযানে আচার অনুষ্ঠান নেই, দেবদেবী নেই। সহজযানীরা বলতেন,কাঠ- মাটি -পাথরের তৈরি দেবদেবীর কাছে মাথা নোয়ানো বৃথা। তাঁদের কাছে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের একেবারেই মূল্য ছিল না। চর্যার একটি পদে এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে-
এস জপহোমে মন্ডল কম্মে
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে।
তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে
বোধি কি লব ভই প্রণ বি দেঁহে।
এই জপ -হোম-মন্ডল কর্ম নিয়ে সব সময় বাহ্যধর্মে লিপ্ত আছিস। তোর নিরন্তর স্নেহ বিনা, হে তরুণি, এই দেহে কি বোধি লাভ হয়?
সহজযানীরা বিশ্বাস করতেন জপ কি প্রার্থণা করে মুক্তি অর্জন সম্ভব না। পরমজ্ঞান সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা-স্বয়ং গৌতম বুদ্ধও জানতেন না। তাঁদের মতে সবার পক্ষেই বুদ্ধত্ব লাভ সম্ভব।
এবং এই বুদ্ধত্বের অধিষ্ঠান দেহের মধ্যে। তাঁদের মতে দেহবাদ বা কায়সাধনই একমাত্র সত্য। সহজযানীদের মতে শূন্যতা প্রকৃতি। এবং করুণা পুরুষ। এই ধারণাও, আমার মনে হয়, কপিল প্রবর্তিত সাংখ্যদর্শনের প্রভাব।
সে যাই হোক। এই শূন্যতা ও করুণার মিলনে অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মিলনে বোধিচিত্তের যে পরমানন্দ অবস্থা হয় তাই মহাসুখ। এই মহাসুখই একমাত্র সত্য। সহজযানের লক্ষ ছিল মহাসুখ। সহজযানীরা মৃত্যুর পর মুক্তিলাভে বিশ্বাস করতেন না।
এই ধারণা উনিশ শতকে লালনের গানে প্রকাশ পেয়েছে-
শুনি মলে (মরলে) পাব বেহেস্তখানা/ তা শুনে তো মন মানে না/
বাকির লোভে নগদ পাওনা/ কে ছাড়ে এ ভুবনে/
সহজ মানুষ/ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে ...
প্রশ্ন উঠতেই পারে। লালনের এই ‘সহজ’ মানুষের সঙ্গে সহজযানের কি সম্পর্ক? সহজযানের লক্ষ ছিল মহাসুখ। লালনের মোক্ষ অচিন পাখিরূপী মনের মানুষের সন্ধান। পার্থক্য এতটুকুই। শত বছরের ব্যবধানে গড়ে ওঠা সহজযান এবং বাউল দর্শনের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই ...এটাই স্বাভাবিক।
তবে বাউলদের মতো সহজযানীরাও ছিলেন দেহবাদী। কেননা, সহজযানীরা বিশ্বাস করতেন: রস-রসায়নের সাহায্যে কায়সিদ্ধি লাভ করে জড় দেহকেই সিদ্ধদেহ এবং সিদ্ধদেহকে দিব্যদেহে রূপান্তরিত সম্ভব। (ভাষা এখানে বদলে যাচ্ছে, কেননা বিষয়টি দর্শনের অন্তর্গত) ...সে যাই হোক। সহজযানীরা অচিন্ত্যযোগী। এর মানে -জন্ম -মরণ সংসার কীভাবে হয়, তাঁরা জানেন না।
জন্ম যেমন মরণও তেমনি। জীবিত ও মৃতে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। সহজযানের আদর্শ হল সাম্য ভাবনা এবং আকাশের মত শূন্যচিত্ত। শরীরের মধ্যেই অশরীরীর গুপ্ত লীলা। সুতরাং বনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরে থাকারও প্রয়োজন নেই।
আগম, বেদ, পুরাণ। সবই বৃথা। সহজের রূপ নিস্কলুষ এবং নিস্তরঙ্গ। তার মধ্যে পাপপুণ্যের প্রবেশ নেই। সহজে মন নিশ্চল করে, যে সাম্য ভাবনা লাভ করেছে, সেই একমাত্র সিদ্ধ।
তার জরা মরণ থাকে না । শূন্য নিরঞ্জনই মহাসুখ। সেখানে পাপ নেই,পূণ্য নেই।
সহজযানে গুরুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন। গুরুকে বলা হত ‘বজ্রগুরু।
’ বাউল দর্শনেও গুরুর ভূমিকা প্রধান। এ কারণে লালন গেয়েছেন-
কবে সাধুর চরণধূলি/মোর লাগবে পায়/ আমি বসে আছি আশাসিন্ধুর কূলেতে সদাই ...
এক কথায় সহজযানের উদ্দেশ্য হল কঠোর সাধনায় মুক্তি কামনার পরিবর্তে সদগুরুর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার মাধ্যমে পরম সুখ লাভ করা। এটি চিত্তের এমন এক অবস্থা , যেখানে সুখ ভিন্ন অন্য কোনও বিষয়ের অস্তিত্ব থাকে না।
মধ্যযগের মরমী কবি সাধক বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস থেকে আরম্ভ করে কবীর,দাদু, তুলসীদাস -এঁরা প্রত্যেকেই চিন্তার দিক থেকে বাংলার সহজযানীদের উত্তরসূরী ছিলেন। কেননা, সহজযানের মূলকথা ছিল- ‘যা মানুষের মধ্যে শাশ্বত স্বরূপের উপলব্দি আনে, যার মাধ্যমে জগতের প্রাণিকুল ও বস্তুনিচয়কে অনুভব করার দর্শনই বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতের অন্তর্নিহিত সত্য।
’ (বাংলাপেডিয়া; আজহারুল ইসলাম এবং সমবারু মহন্ত )
মধ্যযুগের বাংলার লোকায়ত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাংলায় বৌদ্ধধর্ম এমন রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, লৌকিক হিন্দু ধর্ম থেকে তা খুব একটা ভিন্নতর ছিল না। এই পরিবর্তনকেই বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান ও তন্ত্রযান ও সহজযান ও কালচক্রযানের রূপান্তর বলে আখ্যাত করা হয়েছে। ’ এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক আবদুল মমিন চৌধুরী লিখেছেন,‘বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই লোকজ সংস্কৃতি হয়তো বা বাংলার আর্য-উত্তরাধিকারের কারণে ঘটেছিল বলে বলা যেতে পারে এবং এর থেকেই সৃষ্টি নিয়েছিল মানবতাবাদ, কিছুটা বিকৃত হয়তো বা। ’ ( প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি;পৃষ্ঠা, ৮১) যে মানবতা বাদ কে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় দেখেছেন ‘মধ্যপর্বে হাতে আদিপর্বের শ্রেষ্ঠতম; মহতত্তম উত্তরাধিকার’ হিসেবে।
তথ্যসূত্র:
নীহাররঞ্জন রায়; বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব)
আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি
এ কে এম শাহনাওয়াজ; বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা
সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস।
(দ্বিতীয় খন্ড )
ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য ; বৌদ্ধদের দেবদেবী।
এবং
বাংলাপেডিয়ায় আজহারুল ইসলাম, সমবারু মহন্ত, রেবতপ্রিয় বড়–য়া এবং সুমন কান্তি বড়–য়া লিখিত প্রবন্ধসমূহ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।