বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
মধ্যযুগে ইউরোপ জুড়ে ‘ডাইনি’দের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। যে সব নারীদের ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল আসলে তারা ছিল ইউরোপের প্রাচীন মাটি থেকে উঠে আসা প্যাগানসংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
প্যাগানদের ধর্মীয় রীতিনীতি এবং উপসনাপদ্ধতি খ্রিস্টধর্মের চেয়ে পৃথক ছিল। এ কারণেই প্যাগান ডাইনিদের খ্রিস্টধর্ম বিরোধী বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ইউরোপ জুড়ে লক্ষাধিক নারীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল । এইসব ডাইনিরা নাকি আকাশে উড়তে পারে, পশুতে রূপান্তরিত হতে পারে, পিশাচের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে। এসব মনগড়া অভিযোগে সমৃদ্ধ এক লোকজ সংস্কৃতির বিনাশ সম্ভবপর হয়েছিল।
কেননা মধ্যযুগের ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম অপ্রতিরোধ্য ছিল -অবশ্য সত্যে নয়-সংখ্যায় ...
প্যাগান উর্বরা শক্তির প্রতীক। আমরা Pagan বলতে কেবলই মূর্তিপূজক বুঝি। যা পুরোপুরি সঠিক নয়। আসলে Pagan শব্দটি লাতিন paganus শব্দ থেকে উদ্ভূত; এর অর্থ- গ্রাম্য।
৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে প্যাগান কেল্টরা বাস করত।
এদের পুরোহিতদের বলা হত ড্রুইড। তারা সূর্যের উপাসক ছিল। বনদেবীর পূজা করত। ৪৩ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ইংল্যান্ড আক্রমন করে। রোমানদের চোখে কেল্টরা ছিল প্যাগানুস।
রোমানরা প্যাগানসংস্কৃতি ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও প্যাগান দেবদেবীর আরাধনা অব্যাহত থাকে।
১৮০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম ইংল্যান্ডে এল। তবে রোমানদের বিরোধীতার সম্মূখীন হয়েছিল।
৪০৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান সৈন্যরা ইংল্যান্ড ত্যাগ করে। এরপর স্যাক্সনরা ইংল্যান্ড জয় করে।
এরা ছিল প্যাগান। এরা প্রথম প্রথম খ্রিস্টধর্মের বিরোধীতা করলেও ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এরা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় যাজকেরা পাকাপোক্ত হয়ে বসে এবং খ্রিস্টবিরোধী প্যাগানসংস্কৃতি নির্মূল পদক্ষেপ গ্রহন করে।
প্যাগানসংস্কৃতির মূল বৈশিস্ট্য ছিল বহুঈশ্বরবাদ, নারীপ্রাধান্য ও প্রকৃতিলগ্নতা। এই ছবিটিতে নারীর প্রকৃতিলগ্নতা ফুটে উঠেছে।
এবার আমরা দেখব কথিত witch বা 'ডাইনি' আসলে কারা? ইংরেজি witch শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে wicca শব্দ থেকে। এটি অনেক পুরনো একটি ইংরেজি শব্দ। উইকা শব্দের প্রকৃত মানে ‘যে জ্ঞানী ’ অথবা ‘যে নিগূঢ় জ্ঞান অর্জন করেছে’। এই উইকা শব্দটির অন্য অর্থ হল: প্রাচীন প্যাগান ধর্মের উপাসক নারী ও পুরুষ । এরা ঈশ্বরের পুরুষালি, মেয়েলি ও পার্থিক রূপের আরাধনা করত।
এই ধারণাটি খ্রিস্টধর্মের মূল ধারণার বিরোধী। মধ্যযুগে খ্রিস্টমাতা মেরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও ইনকুইজিশনের মুখোমুখি হতে হত। উইকান ধর্মে অবশ্য স্বর্গমত্যের ধারণা রয়েছে-এরা পরকালেও বিশ্বাসী। তবে উইকা ধর্মটি পুরোহিততান্ত্রিক এবং কর্তৃত্ববাদী নয় বলেই খ্রিস্টীয় ধর্মের ধ্বজাধারীদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছিল।
তথাকথিত 'ডাইনি'।
ওপরের ছবিটিকেই খ্রিস্টধর্মের যাজকেরা এভাবে বিকৃতি করেছে।
উইকান ধর্মের এক বিশেষ দিক হল witchcraft. যা ছিল নারীদের কৃত্য। অবশ্য খ্রিস্টীয় জগতে witchcraft শব্দের অর্থ করা হয় ডাকিনীবিদ্যা। অবশ্য উইকা পরিভাষায় ভাষায় witchcraft অর্থ হল: ‘জ্ঞানীদের শিল্প-কৌশল’। প্যাগান ধর্মের অর্ন্তভূক্ত উইকান ধর্মটি অনেক পুরনো।
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে খ্রিস্টধর্মের আগমনের পূর্বে উইকানদের (এদেরই পরবর্তীকালে ‘উইচ’ বলা হয়) সম্মান ছিল। উইকানরা বিশ্বাস করত গুহ্যজ্ঞান বংশ পরম্পরায় সঞ্চালিত হয়। যেমন ট্যালিপ্যাথি। এও এক ধরণের ম্যাজিক। উইকান নারীরা ছিল মানবতাবাদী।
তারা তন্ত্রমন্ত্রের দ্বারা মানুষের রোগ বালাই সারিয়ে তুলত। এই তন্ত্রমন্ত্রই ছিল খ্রিস্টানদের কাছে কুসংস্কার। যা হোক। পরবর্তীকালে ইউরোপের মানুষ উইকান নারীদের ভয় পেতে লাগল। তার অবশ্য কারণ ছিল।
উইকানরা এমন সব বিষয় জানত যা সাধারণ লোকে জানত না। যেমন, উইকান নারীরা জন্মের সময় সম্মোহনবিদ্যা প্রয়োগ করে গর্ভবতী নারীর যন্ত্রণা কমাত। আজও হিপনোসিস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। যুগ পালটে গেছে। আজ কেউ হিপনোসিস জানলে লোকে তাকে ভয় করে না।
উইকান প্রতীক। আসলে উইকান ধর্মের মূল জ্ঞান প্রকৃতি পর্যবেক্ষণলব্দ জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভেষজ ঔষধি, টেলিপ্যাথি, ফেইথহিলিং, প্রি-কগনিশন, ক্লাইরভয়ান্স, অ্যাস্ট্রাল-ট্রাভেলিং এবং ক্রিস্টাল বল -এসব উইকান ধর্মের অর্ন্তগত। এসই আবার খ্রিস্টবিরোধী।
খ্রিস্টীয় চার্চ ভাবল উইকানরা এসব গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করেছে শয়তানের কাছ থেকে ।
এমন কী ভেষজ লতাপাতার জ্ঞানও গির্জের পিতাদের কাছে ছিল অগ্রহনযোগ্য। খ্রিস্টানরা কেবল প্রার্থনায় বিশ্বাস করত। যে কারণে উইকানদের ম্যাজিক আর প্রকৃতি উপাসনা সন্দেহের চোখে দেখা হল। মধ্যযুগে অসুখবিসুখকে ভাবা হত ঈশ্বরের ক্রোধের কারণ। যারা এর চিকিৎসা করত তারা ছিল চার্চের শক্র।
১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ উইচক্র্যাপ্ট অ্যাক্ট -এ বলা হল: চিকিৎসার জন্য যারা ‘উইচদের’ কাছে যাবে তারাও ধর্মের চোখে সমান অপরাধী। খ্রিস্টধর্ম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। উইকা ধর্মে নারীর প্রাধান্য খ্রিস্টীয় যাজকদের ক্রোধের উদগীরণ করেছিল ...প্যাগান ধর্মটিকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লাগল। গির্জা পিতারা উইকান নারীকে বলল, ওল্ড, পুয়োর অ্যান্ড ফিমেল।
ক্রশবিদ্ধ নারী
আরও কয়েকটি কারণে নারীর ওপর গির্জার পিতাদের দারুণ ক্ষোভ ছিল।
মধ্যযুগের ইউরোপের গির্জা পিতাদের কাছে সৌন্দর্য ছিল অশুভ আর সুখশান্তি হল পাপ; যৌনতা ছিল অন্যায়, জন্মদানও ছিল বিরক্তিকর। আর এ সবই নারীর অনিবার্য অনুসঙ্গ। খ্রিস্টীয় যাজকদের নারীবিদ্বেষের আরেকটি কারণ ছিল-নারী পুরুষকে পাপের পথে নিয়ে যায়-এই বদ্ধমূল ধারণা। তা ছাড়া ঈভ আপেল খেয়েছিল। এবং তা ছিল স্বর্গ থেকে পতনের কারণ।
কাজেই, নারী অশুভের দ্বার। গির্জার পিতারা আরও বিশ্বাস করত
CLEANLINESS IS NEXT TO GODLINESS!
নারী প্রাকৃতিক ভাবেই পরিস্কার না, উইকান নারীরা তো আরও নোংরা। যা হোক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ডাইনি’ বিরোধী ইহুদি-খ্রিস্টান শাস্ত্রীয় শ্লোক: A man also or woman that hath a familiar spirit, or that is a wizard, shall surely be put to death: they shall stone them with stones: their blood shall be upon them. (Leviticus 20:27) ... অপরদিকে খ্রিস্টধর্ম ইউরোপে প্রচলনের পূর্বে ভাবা হত: মানবদেহ কামময় (লাস্টফুল) নয়। যৌন সুখের প্রয়োজন আছে এবং তা মানুষের জন্ম হয়।
মানুষ সুখ কামনা করে। মানুষ যন্ত্রণাদায়ক জীবনে স্বস্তির জন্য প্রকৃতিকে সৌন্দর্য খোঁজে।
উইকান নারীদের বিচার।
চার্চের সিদ্ধান্তে অবশেষে পঞ্চদশ শতক থেকে উইকানদের ‘ডাইনি’ আখ্যায়িত করে পোড়ানো আরম্ভ হয় । উইকানদের সবাই যে নারী ছিল তা নয়।
পুরুষও ছিল। তবে সংখ্যায় অল্প। যে কারণে-genderized mass murder বলা হয়। এই হত্যাকান্ড চলে ১৪৮০ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ অবধি । এই সময়ে ৪০,০০ থেকে ১০০,০০০ নারীর মৃত্যু হয় ! অভিযুক্তকারী ও বিচারক উইকান নারীর সম্পদ ভাগাভাগি করে নিত।
নিধনযজ্ঞে গির্জার কর্তৃত্ব থাকলেও বিচার হত আদালতে। উইকান নারীদের বিচার হওয়া ছিল সহজ। কেননা, সে সময়কার নারীদের সম্বন্ধে ধারণা ছিল ...All wickedness is but little to the wickedness of a woman… What else is woman but a foe to friendship, an unescapable punishment, a necessary evil, a natural temptation, a desirable calamity, domestic danger, a delectable detriment, an evil nature, painted with fair colours… Women are by nature instruments of Satan – the are by nature carnal, a structural defect rooted in the original creation.”
একজন উইকান নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে
উইকান বিড়াল। গলায় উইকান প্রতীক। নারীদের সঙ্গে সঙ্গে উইকান নারীদের বিড়ালও পুড়িয়ে মারা হত।
কেননা, সেকালের খ্রিস্টীয় সমাজে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে- বিড়াল হল ডাইনিদের চর। বিড়ালের সংখ্যা হ্রাস পায় ইউরোপে । কাজেই ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি ঘটে। ইঁদুর প্লেগের জীবাণু বহণ করে। প্লেগের প্রাদূর্ভাব ঘটে।
প্লেগের কারণ হিসেবে আবার উইকানদের দায়ি করা হয় ....
যা হোক । এত অত্যাচার নির্যাতন সত্ত্বেও প্যাগান ধর্ম ইউরোপ থেকে কখনোই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তার কারণ হল আমদানীকৃত ধর্মের চেয়ে লোকজ সংস্কৃতি অনেক বেশি শক্তিশালী। এই কারণেই আমরা কুড়ি শতকের ইউরোপে নতুন করে প্যাগান ধর্মের উত্থান দেখি।
এই মহামানবকে চিনে রাখুন।
এঁর নাম জেরাল্ড গার্ডনার (১৮৮৪-১৯৬৪) ইংলিশ লেখক নৃতত্ত্ববিদ এবং মরমী। ইনি কুড়ি শতকে ইউরোপে উইকান সংস্কৃতির পুনুরুত্থান ঘটান। উইকানদের শাস্ত্রও লেখেন ইনি। যে শাস্ত্রের বৈশিস্ট (১) বহু ঈশ্বরবাদ;(২) প্রকৃতিলগ্নতা এবং (৩) পবিত্র নারীবাদ।
প্যাগান ধর্মে বিশ্বাসী এ কালের তিনজন উইকান নারী
এই সময়ের প্যাগান-নাচ।
অনেক উইকান নারীর মৃত্যুর পর আজ আর পুড়ে মরার ভয় নেই ...
তথ্যসূত্র:
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।