আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যযুগের বাংলার নাথধর্ম

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, বাংলায় প্রতিমুহূর্তে লোকধর্ম সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। (স্মৃতি থেকে লিখছি বলে রবীন্দ্রনাথের অবিকল উক্তিটি স্মরণ করতে পারছি না।

) তবে বাংলার লৌকিক ধর্মের অস্তিত্ব অনুভব করা প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। কারণ বাংলার ধর্ম বলতে আমরা মূলত হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মই বুঝি-এবং এর বাইরে বাংলায় আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব থাকতে পারে তা যেন আমাদের বিশ্বাসই হয় না। তবুও যুগযুগ ধরে বাংলায় লৌকিক ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। এবং এটাই সত্য। বাংলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকর্ধম হল: কর্তাভজা, কিশোরীভজন, জগোমোহিনী, ন্যাড়া, বলাহাড়ি, বাউল, মতুয়া, সাহেবধনী।

এসব লোকধর্মের সাধনপদ্ধতির অন্যতম হল সংগীত। এসব লোকধর্মের ওপর সাংখ্য বৌদ্ধ ও তন্ত্রের স্পস্ট প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলার লোকধর্মের প্রবক্তাগণ সমাজে উচ্চশ্রেণি কর্তৃক কোণঠাসা বলেই বৈশিষ্ট্যে বাংলার লোকধর্মসমূহ জাতপাতবিরোধী। সেই সঙ্গে তন্ত্রের প্রভাবে লোকধর্মমতগুলি হয়ে উঠেছে নারীবাদী । বাউল মামুন নদীয়ার একটি গানে রয়েছে ... নারীর ওই সিন্ধুমাঝে ভানুর এক কিরণসাজে তাহার মধ্যে প্রেমের বাঁচা রে মামুন নদীয়া বলে চল সখী গহীন জলে শুদ্ধপ্রেম কেনাবেচা করি লো কিশোরী এর সঙ্গে তুলনীয় নবম-দশম শতকের একটি চর্যাপদ (তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কবিতা) তো বিনু তরুনি নিরন্তর ণেহে বোধি কি লভ ভই প্রণ বি দেঁহে।

সেই যাই হোক। বাংলার অন্যতম একজন লোকধর্মগুরু হলেন মীননাথ । ইনি ছিলেন নাথধর্মের প্রবক্তা। মীননাথের শিষ্যদের বলা হয় নাথযোগী। বাংলার বাইরে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত অবধি নাথধর্মের বিস্তার ছিল।

মীননাথ-এর সময়কাল ১০ম থেকে ১২শ শতক। (দেখুন: বাঙালির ইতিহাস। নীহাররঞ্জন রায় পৃষ্ঠা: ৫৩১) মীননাথের জন্ম হয়েছিল চন্দ্রদ্বীপ । তো, চন্দ্রদ্বীপ কোথায়? চন্দ্রদ্বীপ হচ্ছে বর্তমান বরিশাল। নাথধর্মের প্রবক্তা মৎস্যেন্দ্রনাথের জন্ম বরিশালেই হয়েছিল।

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় এবং ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাও এই বিষয়ে অভিন্ন মত পোষন করেছেন। মৎস্যেন্দ্রনাথের লেখা পাঁচটি গ্রন্থ নেপালে পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য -কৌলজ্ঞাননির্নয়। প্রথম জীবনে মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন ধীবর; অর্থাৎ জেলে। পরে তিনি নাথধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন।

আখড়া নির্মাণ করেছিলেন। লোকে বলত নাথযোগীদের আখড়া। একজন সামান্য ধীবর পরবর্তীতে কী ভাবে প্রভাবশালী ধর্মগুরুতে উন্নীত হলেন? কৌলজ্ঞাননির্নয় এর মতো বই লিখলেন? তবে কি তিনি প্রথম জীবনে ধীবরের ছদ্মবেশে ছিলেন? মৎস্যেন্দ্রনাথ? ভাটি অঞ্চলের সুরকার শাহ আবদুল করিম যেমন প্রথম জীবনে ছিলেন রাখাল । ... পরে? আমরা এখন জানি শাহ আবদুল করিমের গানের কি মানে! ... এবং এই সব প্রশ্ন আমাকে ভীষন ভাবায়। মৎস্যেন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে কেউ কি একটি উপন্যাস লিখবেন? শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে অসাধারণ সব প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে।

এবং আরও হবে। মৎস্যেন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে কে একটি উপন্যাস লিখবেন? কে আলো ফেলবেন আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনার শেকড়বাকরে? সেই আলোছায়াময় আবছা অন্ধকার? জানি যে কেউ না। আমরা বর্তমান নিয়ে বড় বেশি নিমজ্জিত। মৎস্যেন্দ্রনাথ আবার কে? অথচ আমরা আমাদের শেকড়বাকর নিয়ে ভারি স্পর্শকাতর ... তো, মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সে যুগের অন্যতম এক কবি। এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

জীবনানন্দের জন্মও ওই বরিশালেই। বরিশালের জলহাওয়া মৎস্যেন্দ্রনাথকে আপ্লুত করে থাকবে নিশ্চয়ই । আজও আমাদের যেরকম করে থাকে ... তো মৎস্যেন্দ্রনাথ ঠিক কি বিশ্বাস করতেন? মৎস্যেন্দ্রনাথ ঠিক কোন্ কথা বলতেন মধ্যযুগের বাংলার মানুষকে? মৎস্যেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে ... মানুষের দুঃখ শোকের কারণ অপক্ক দেহ। যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করে সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হয়ে সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ম লাভ করা যায়। ...এ কথাই ছড়িয়েছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ।

(এ কথার মানে আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি। হয়তো একদিন বুঝতে পারব ...মৎস্যেন্দ্রনাথ-এর কথা কি মধ্যযুগের বাংলার মানুষ বুঝতে পারত? এরকম ভেবে অবাক হতেই হয় ...) যাক। তৎকালের মানুষ মৎস্যেন্দ্রনাথ- এর কথায় বিশ্বাসও করেছিল। দলে দলে ভিড় করেছিল নাথযোগীদের আখড়ায়। দিব্যদেহের অধিকারী হওয়ার জন্য।

দিব্যদেহের অধিকারী কোনও মানুষ কি কোনও পাপ করতে পারে? না। পারে না। এই হল বাংলার মানবতাবাদ। বাংলার শত শত লোকলোকসম্প্রদায় যা আজও সহস্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ধারণ করে রয়েছে। তা নাথযোগীরা দেখতে কেমন ছিল? বাংলাপিডিয়ায় আনোয়ারুল করিম লিখেছেন- “নাথযোগীদের মাথায় থাকত জটা,সর্বাঙ্গে ছাই-ভস্ম, কানে কড়ি ও কুন্ডুল, গলায় সুতা, বাহুতে রুদ্রাক্ষ,হাতে ত্রিশূল,পায়ে নূপুর,কাঁধে ঝুলি ও কাঁথা।

তাদের কুলবৃক্ষ ছিল বকুল; প্রধান আহার্য কচুশাক। ” নাথযোগীরা তিনদিন দীক্ষা নিত। প্রথম দিন গুরু শিষ্যের চুল কেটে দিতের। পরের দিন তার কানে কুন্ডুল পরিয়ে দিতেন। তৃতীয় দীক্ষা ছিল উপদেশী।

তখন নানা পূজা-অর্চনা হত; সে সময় সারারাত দীপ জ্বলত ও নানা অনুষ্ঠান হত। এর নাম “জ্যোস্না-জাগান”। জ্যোস্না-জাগান? বাহ্। এক্ষণে বাংলাকে যেন পাওয়া গেল। বিবাহের ক্ষেত্রে নাথধর্মের অনুসারীরা সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের অনুসরণ করত।

এদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত হলেও বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল না। বিবাহবিচ্ছেদও নেই। তবে এসবই সম্ভবত পরবর্তী সংযোজন। আমি ঠিক জানি না। নাথধর্মের অনুসারীদের মৃতদেহ কবরস্থ করা হত।

তবে সৎকারের ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মালম্বীদের অনুসরণ করত। এইই হচ্ছে বাংলার সমন্বয়- যা বাংলার লোকসম্প্রদায়ের মূল বৈশিষ্ট্য। এককালে নাথধর্মের প্রতিপত্তি ছিল ভারতবর্ষের উড়িষ্যা থেকে পাকিস্থানের পেশোয়ার অবধি। (দ্র: নাথধর্ম: বাংলাপিডিয়া। )কথাটা যারা বিশ্বাস করবেন না; তাদের বলি যে-১৯৪০ সালে বরিশালের আবুল কাশেম ফজলুল হক লাহোর কাঁপিয়ে দিয়ে ছিলেন ...এবং, বাংলার তথা বরিশালের একজন ধর্মসাধকের একটি লোকায়ত মত এককালে ভারতবর্ষের লোকদের মধ্যে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছিল-এই কথাটি জানাতেই এই নিবন্ধের অবতারনা।

তবে নানা কারণে পরবর্তীকালে নাথধর্মটি বাংলায় টিকে থাকতে পারেনি। বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদী উত্থান তার একটি কারণ। একাদশ শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা বাংলার ক্ষমতা দখল করে। সেনরা বৌদ্ধ ও নাথযোগীদের ধর্মহীন আখ্যা দিয়ে নির্মম ভাবে পীড়ন করেছিল। এটি বাংলার অন্ধকারতম একটি অধ্যায়।

(এবং এই অমানবিক পীড়ন আমাদের যেন সাম্প্রতিক কালের বাউল নীপিড়ণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়!) সেনরা বাংলায় এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকে। তারা বাংলার মানবতাবাদ উপলব্দি করতে পারেনি হয়তো-বা। তারা হয়তো উপলব্দি করতে পারেন নি যে বাংলা একটি মাত্র ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্টিত করার স্থান নয়, হাজার বছর ধরেই বাংলায় অজস্র ধর্মবিশ্বাস বিদ্যমান, বাংলায় বহমান অজস্র নদীর মতোই ... ক্রমে ক্রমে নাথযোগীরা বাংলা থেকে উৎখাত হয়ে যেতে থাকে। ক্রমশ তারা হয়ে গেল ‘যুগী’। এদের বৃত্তি হল কাপড় বোনা।

নাথধর্মের শেষ চিহ্ন রয়ে গেল কেবল নামের পদবীতে। তো, বাংলার ইতিহাসে নামধর্মের গুরুত্ব কতখানি? কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, ষোড়শ শতকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্যদেব বাংলায় যে ভক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তার মূল প্রেরণা একমাত্র সুফিবাদের মধ্যে নিহিত ছিল না, সেই প্রেমবাদী ভাববিপ্লবের অন্যতম প্রেরণা ছিল বাংলার নাথধর্মটির মানবতাবাদী চেতনা । তথ্যনির্দেশ: ১) নীহাররঞ্জন রায়; বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব) ২) এ কে এম শাহনাওয়াজ; বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা ৩) আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি ৪)বাংলাপিডিয়া। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.