আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছড়িয়ে পড়া আলো

আগামী ৮মে রেড ক্রস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জ্বীন হেনরি ডুনান্টের জন্মদিন। একই সাথে দিনটি বিশ্ব রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট দিবস। এই উপলক্ষে নিবন্ধটি লেখা। “A Memory of Solferino” বা সলফেরিনোর স্মৃতিকথা কেবল জ্বীন হেনরি ডুনান্ট এর প্রত্যক্ষ করা একটি ভয়াবহ যুদ্ধ বা সলফেরিনোর রণাঙ্গনের সেই দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকা সম্বলিত আত্মকথনই নয় বরং এটি হচ্ছে একটি ধারণার প্রথম আত্মপ্রকাশ। সলফেরিনোর বিভীষিকাময় ঘটনাগুলো তাঁকে উদ্ভুদ্ধ করে একটি আহবান জানানোর যা ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রগুলো মানুষকে কিছুটা হলেও মানুষ হিসাবে ভাবতে বাধ্য করবে।

ডুনান্টের এই আহবান, যা ছিল যুগের তুলনায় অনেক বেশী সাহসী এবং সেই সাথে একই পরিমাণ বিনয়ী, অতি দ্রুত মানষকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব শুধু যুদ্ধ ক্ষেত্রের মাঝে আর সীমাবদ্ধ থাকলনা, ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। ডুনান্টের এই বই আজও সমান মূল্যবোধ নিয়ে অধ্যয়নযোগ্য যাকে মূল্যায়ন করা যায় আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংস্থা রেড ক্রস-রেড ক্রিসেন্টের ভিত্তি হিসাবে। ডুনান্ট সলফেরিনোর স্মৃতির মাধ্যমে দুটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রস্তাবনা রাখেন- ১। প্রত্যেকটি দেশে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা যা যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা করবে।

২। একটি কনভেনশনের মাধ্যমে সকল দেশ সর্বসম্মতিক্রমে একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালার অনুসরণ করবে যাতে এসব স্বেচ্ছাসেবকদের নিরাপত্তা বিধান থাকবে। এই বই এক বিরাট সাফল্য হিসেবে ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়। সৃষ্টি হয় একটি নতুন ধারণার। সলফেরিনোর স্মৃতিকথায় প্রদত্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে ডুনান্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজন্যবর্গ, যুবরাজ ও সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে বইটি বিতরণ করেন।

তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন জেনারেল দ্যুফোর, গুস্তাভ মইনিয়র, ডা. থিয়োডর মাউনোইর ও ডা. লুইস আপ্পিয়া। ১৮৬৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সলফেরিনোর যুদ্ধের চার বছর ও সলফেরিনোর স্মৃতিকথা প্রকাশের এক বছর পর, এই পাঁচজন জেনেভাবাসী একত্রিত হয়ে গঠন করেন "কমিটি অভ ফাইভ"। এর ঠিক আট দিন পর, ১৭ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং কমিটির নতুন নাম করণ করা হয় International Committee for Relief to the Military Wounded. একই বছর ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর প্রথমবারের মতো এ কমিটি জেনেভায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করেন যাতে ১৬টি দেশ তাদের প্রতিনিধি পাঠান। সম্মেলনে একটি নিরপেক্ষ ত্রাণ সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সংস্থার সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে যার যার সরকারকে রাজী করতে প্রতিনিধিবৃন্দ একমত হয়। এছাড়াও যুদ্ধকালীন সময়ে বিবাদমান দুইপক্ষের হুমকি থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের আপাতকালীন হাসপাতালকে নিরপেক্ষ ঘোষণা দেয়া হয়।

যার অর্থ উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর চিকিৎসকদল, আহতদের সাহায্যকারী স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ এবং সর্বপরি আহত সৈনিকগণ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে নিরাপদ থাকবেন। এই নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি সর্বজনগৃহীত প্রতীকের। ১৮৬৪ সালের ২২ আগস্ট আন্তর্জাতিক রিলিফ কমিটি জেনেভায় আয়োজন করে একটি কূটনৈতিক সম্মেলনের যা জেনেভা কনভেনশন নামে সর্বাধিক পরিচিত। সম্মেলনে সিদ্ধান্তগ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে ১৬টি দেশ তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। প্রতিনিধিবৃন্দ যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের নিরাপত্তা, পরিচর্যা ও সাহায্য করতে একমত হন এবং এ ক্ষেত্রে জাতীয়তার পার্থক্য কোন বিভেদের দেয়াল তুলবেনা বলেও সিদ্ধান্তগৃহীত হয়।

এছাড়াও ১৮৬৩ সালের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহকে এই কনভেনশনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই সাথে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রতীক হিসাবে সুইজারল্যান্ডের জাতীয় পতাকার বিপরীত অর্থাৎ সাদা জমিনে লাল ক্রসকে গ্রহণ করা হয়। সম্মেলন ১০টি সিদ্ধান্তগ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয়। (প্রদত্ত লিংকটি আমাদেরকে উক্ত কনভেনশনে নেয়া সিদ্ধান্তসমূহ প্রদর্শন করবে Convention for the Amelioration of the Condition of the Wounded in Armies in the Field. Geneva, 22 August 1864 ) খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশ এতে স্বাক্ষর করেন। ১৮৬৩ সালে আন্তর্জাতিক রিলিফ কমিটির সম্মেলন ও ১৮৬৪ সালের জেনেভা কনভেনশনের ভিত্তির উপর ধীরে ধীরে বিকাশ হতে থাকে এক মহীরুহের, বিশ্বব্যাপি বিস্তৃত ও সর্বজনগ্রাহ্য এক সংগঠন, যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (International Committee of the Red Cross বা ICRC), যার রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের নিরাপত্তা দেয়া ও জেনেভা কনভেনশনের উদ্যোগ নেয়ার অধিকার।

এককথায় বলা চলে বর্তমানে বিশ্বে রয়েছে একটি পৃথিবীব্যাপী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং একগুচ্ছ প্রথা বা কনভেনশন যার একটি ক্ষতিগ্রস্থদের মানবিক সহায়তা প্রদান করে অপরটি দেয় আইনি সুরক্ষা। এ দুটি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে যুদ্ধে আহত, যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক ও বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে এবং যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক ও বেসামরিক জনগণের খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। বিগত দুইটি বিশ্বযুদ্ধে ICRC'এর উদ্বেগের প্রধান বিষয় বস্তু ছিল যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধবন্দীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে ICRC প্রতিনিধিবৃন্দ ছুটে বেড়িয়েছেন এক যুদ্ধ শিবির হতে আরেক যুদ্ধ শিবিরে। একই সময় এই প্রতিষ্ঠান জেনেভাতে গঠন করে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য সংস্থা যা লক্ষাধিক যুদ্ধবন্দী ও তাদের পরিবারের মধ্যে বার্তা আদান প্রদান তথা যোগাযোগ রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি তার নিরাপত্তা ও পরিচর্যার সীমা অধিকৃত অঞ্চলের জনসাধারণ ও শত্রু রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনসাধারণের নিকট পর্যন্ত বিস্তৃত করে। পরবর্তীতে এই কর্মকান্ডগুলো ১৯২৯ ও ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনে সংযোজিত হয় । ১৮৬৩-৬৪ সালের পরপরই ইউরোপব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে জাতীয় রেড ক্রস সোসাইটি পরবর্তীতে যার ঢেউ ইউরোপের বাইরেও আছড়ে পড়ে। এর মধ্যেই শুরু হয় প্রতীক নিয়ে নতুন এক দ্বন্দ্ব যার ফলশ্রুতিতে উদ্ভব ঘটে রেড ক্রিসেন্ট আর রেড লাইন উইথ সান নামে আরো ২টি ভিন্ন নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রতীকের। বর্তমানে রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশীদার ১৮৭টি জাতীয় সোসাইটির প্রায় ১০০ মিলিয়ন সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক যার অর্ধাংশ যুব সদস্য।

জ্বীন হেনরি ডুনান্ট বা কমিটি অব ফাইভের বাদবাকী সভ্যরা বা ১৮৬৩ সালের সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধিবৃন্দ যতটুকু ভেবেছিলেন রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রসার ঘটেছে তার চেয়েও অনেক বেশি। জাতীয় সোসাইটিগুলোর কর্মক্ষেত্র এত বিশাল আকার ধারণ করেছে যে একসময় তা কল্পনাও করা যেতনা। যে আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিল যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবা ও নিরাপত্তা দেয়ার উদ্দেশ্যে তার কর্মক্ষেত্র বর্তমানে যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ সকল মানুষ থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু, গৃহহীন মানুষ ও শত্রুরাজ্যে বসবাসকারী জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের কর্মপরিধির বিস্তারে বিভিন্ন যুদ্ধকালীন সময়ে এর অবদান গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই আন্দোলনের একজন স্বেচ্ছাসেবক, যিনি দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে হাল ধরেছিলেন, শান্তিপূর্ণ সময়েও সমাজ ও দেশের জন্য তার কার্যক্রম থাকে।

প্রকৃতপক্ষে গোটাদুনিয়াতে এই স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ দিন দিন তাদের মানবিক কার্যক্রমের আওতা ক্রমশ বর্ধিত করে চলেছেন। এই আন্দোলন আরও মহত্ত পায় কিশোর/যুবাদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। আমাদের ভুললে চলবেনা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছেলে মেয়েদের অবদানের কথা যারা আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রুষায় রেড ক্রসকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বর্তমানে এই যুব সদস্যরাই হলো এই আন্দোলনের প্রাণ। জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে তারা এগিয়ে চলেছে সেবা ও সংহতির আদর্শ সাথে করে।

আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রসারিত করছে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন। এই আন্দোলন যত বেগবান হচ্ছে, নিত্য নতুন নানাবিদ সমস্যা একে দাঁড় করাচ্ছে পর্বত প্রমাণ বাধার সামনে। জেনেভা কনভেনশনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও রেডক্রস রেড ক্রিসেন্ট মূলনীতির সরাসরি অনুসরণই পারে এই বাধাকে টপকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নৈতিক মূল্যবোধ যোগাতে। মানবতার পথে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন ভাবে পরিচালিত কার্যক্রমসমূহই একে একতাবদ্ধ রাখবে ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে বাধ্য করবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।