(পূর্ব প্রকাশের পর)
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটি ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের সূর্য সন্তানরা। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সৎপ্রতিবেশীসুলভ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। সে ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রতিবেশীদের সাথে অনেক অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। অতীতে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্রাতিকৃতির হলেও কতিপয় বিষয় মিটে গেছে।
সমুদ্র আইনে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব জলভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সমুদ্রের জলভাগের পাঁচটি নির্ণায়ককে কেন্দ্র করে অধিকার ও কর্তৃত্ব আরোপ করা হয়। প্রথমত অভ্যন্তরীণ জলভাগ যা মূলভূখ-ের প্রান্তরেখার খাঁড়ি। দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের অন্তর্গত জলভাগ যা মূলভূখ-ের প্রান্তরেখা হতে অনধিক ১২ মাইল বিস্তৃত। তৃতীয়ত সন্নিহিত জলভাগ যেখানে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার সংরক্ষিত আছে। এর বিস্তৃতি ২০০ নটিক্যাল মাইল।
এ অঞ্চলে মৎস্যশিকার, খনিজ সম্পদ আহরণ, বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালন এবং অবৈধ বাণিজ্য ও চোরাচালান রোধকল্পে অন্য রাষ্ট্রের জাহাজ প্রবেশে বাধা দেয়ার অধিকার আছে। চতুর্থত মহীসোপান যার বিস্তৃতি অনধিক ৩০০ মাইল। মহীসোপানের বাইরে রাষ্ট্রের অধিকার নেই। পঞ্চমত বহিঃসমুদ্র। একে বলা হয় আন্তর্জাতিক জলপথ।
সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে বিবাদ ছিল। মিয়ানমারের সাথে যে বিবাদ ছিল তা নিষ্পত্তি হয়েছে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালত (ইটলস) কর্তৃক বাংলাদেশের পক্ষে রায়ের মাধ্যমে। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর্যন্ত জিইয়ে থাকা পরস্পর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যে জটিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের (ইটলস) মাধ্যমে মীমাংসা হলো, এটা বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের হৃদয়ের সাগরে কত যে উৎসাহ, উদ্দীপনা আশা-ব্যঞ্জনা জাগরিত করেছে ও মর্যাদার হয়েছে তা যেমন অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে স্থিরচিত্রে চিত্রায়িত করে দেখানো সম্ভব না হলেও কেবল অনুভূতির আবেশে আবেগতাড়িত হয়ে সমুদ্রতলদেশে সঞ্চিত পলল দ্বারা উত্থিত ভূভাগের ভবিষ্যৎ কল্পনার ছবিটা যে অস্বাভাবিক কিছু নয় এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা সম্যক অবগত আছেন। তবে ভাববাদীদের ভাবনায়ও যে পরিবর্তন ও প্রত্যাশা থাকে এবং তা যে কোনো একদিন বাস্তবতার রূপ পরিগ্রহ করে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের (ইটলস) রায় তা-ই প্রমাণ করেছে। এতদিন বঙ্গোপসাগর ছিল কেবল প্রত্যাশার নোঙরে পেঁচানো পুঁজি।
এখন কিন্তু সেটা বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে ঢালু হয়ে সাগরের অতল গহ্বরে (সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড) পৌঁছে গেছে। যা হোক না কেন, ভূগোলবিদের মানচিত্রে পরিবর্তিত কলেবরের সাথে ভূতাত্তিকবিদগণের গবেষণার ব্যাপকতা যে একরকম বেড়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গোপসাগর প্রকৃতির দান। মালিকানা স্বত্বে এটি বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের। একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অধিকার কোনো রাষ্ট্রের নেই।
বলা যায় এটি একটি এজমালি সম্পত্তি। তবে এখন কিন্তু আইনি ফয়সালার মাধ্যমে অধিকারভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের নিজ নিজ ভৌগোলিক পরিসরের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের (ইটলস) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের অংশ হতে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা। যা কিনা বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৭৬ শতাংশের সমান। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান মোট আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯৮ বর্গ কিলোমিটার হিসেবে প্রাপ্ত সমুদ্রসীমা যেন আর একটি বাংলাদেশ।
তবে এ প্রাপ্তি কারো দয়ার দান নয়। বাংলাদেশ তার ন্যায্যহিস্যা পেয়েছে। মিয়ানমার ও ভারত তাদের সুবিধা নিশ্চিত করে সমুদ্র অঙ্গনে বাংলাদেশকে জোন-লকড করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ গুড়েবালি হয়েছে। বাংলাদেশ ওজন বুঝে চলে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হলে সেখানকার বিজ্ঞ বিচারকদের রায় ওষুধে ধরেছে প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের বিপক্ষে।
অথচ বাংলাদেশ প্রায় চার দশক আগেই সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিল। তথাকথিত সমদূরত্বের অন্যায় দাবি প্রতিষ্ঠা করতে তারা ২০০৮ সালে সামরিক মহড়া দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে জোর যার মুল্লুক তার। তারা বুঝতে পারেনি যে বাংলাদেশের ঢাল ও তলোয়ার দুই আছে। আমরা যে ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সরদার নই বিশ্ব দরবারে তা প্রমাণ হয়েছে। ১৯৫২-তে প্রতিষ্ঠা করেছি মাতৃভাষা।
তাও আবার সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে অবমুক্তি পেল ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে । আর ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা অর্জন সবই তো বাংলার ডাকা বুকাদের কা-। বঙ্গোপসাগরের সাথে রয়েছে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। এর বিবর্তন শুরু হয়েছে গ-োয়ানা ল্যান্ড থেকে। রূপতত্ত্বে যাকে গাঙ্গেয় নালী (সাইনাস গ্যাঙ্গেটিকাস্) বা গঙ্গার উপসাগর হিসেবে দশম শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন মানচিত্রে উপস্থাপন করে বঙ্গভূমির শাসন কার্য পরিচালনা হতো।
রূপতত্ত্বের সাথে ভূতত্ত্ববিদ কোলম্যানের নিমগ্ন গহ্বর (সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড) সৃষ্টির মতবাদ গাঙ্গেয় নালীর বিবর্তন বিষয়টি একরকম মিলে যায়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপসাগর। যার অবস্থান ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্বদিকে। পশ্চিমে ভারত ও শ্রীলঙ্কা, উত্তরে বাংলাদেশ, পূর্বে মিয়ানমার ও ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ভূ-অভিক্ষেপে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান ৫ ডিগ্রি থেকে ২২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮০ ডিগ্রি থেকে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত।
আয়তন ২১ লাখ ৭৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার। মোচাকৃতির এ উপসাগরের শীর্ষে অবস্থান করছে বঙ্গীয় বদ্বীপ। যার এক বৃহদাংশ তিনটি প্রধান নদী যথা- পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের পলি দ্বারা পুষ্ট। আজ থেকে প্রায় ১০ লাখ বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিন কাল হতে তার জলরাশির অভ্যন্তরস্থ সব প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ দ্বারা আমাদের কিভাবে সাহায্য করে আসছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশের অধিকারভুক্ত এলাকা ভারত ও মিয়ানমারের চেয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
আমাদের উপকূল ভাগ অবতল হওয়ায় এখানে পলি সঞ্চায়নের পরিমাণ বেশি। যদিও নিমগ্ন গহ্বরের ঢাল অধিক তবু ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী দ্বারা বাহিত প্রায় ২.৫০ মিলিয়ন টন পলি প্রতিবছর সাগরে যোগ হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রগর্ভে নতুন নতুন দ্বীপ ও চরা ভূমির সৃষ্টি হচ্ছে। এদের মধ্যে নিঝুম দ্বীপ ও দক্ষিণ তালপট্টি অন্যতম। ১৬০০ কিলোমিটার প্রশস্তের বঙ্গোপসাগরের গড় গভীরতা ২৬০০ মিটার।
বর্তমানে তা কমে ১৫০০ মিটারে দাঁড়িয়েছে এবং বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশেষ করে উপকূল ভাগের কাছাকাছি অঞ্চলে গভীরতা ৫-৬ ফুটে দাঁড়িয়েছে এমন খবর দৈনিকসমূহে প্রচারিত হয়েছে। অদূরভবিষ্যতে ভূমি জেগে উঠার সম্ভাবনা যে প্রবল তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাংলাদেশ ভূমি-ক্ষুধিত দেশ যেখানে মানুষ ও ভূমির অনুপাত ব্যাপকভাবে ব্যবধান। আর সেটা যদি অবলীলাক্রমে বঙ্গোপসাগর থেকে এসে যায় তা কম কিসে। বাড়তি ভূমি ছাড়া ও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় বঙ্গোপসাগরের প্রভাব অতিগুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গোপসাগর ধাতব, অধাতব, বায়বীয় সম্পদ ছাড়াও জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের দিক থেকে বঙ্গোপসাগর বিশ্বের ৬৪তম বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে। বায়বীয় সম্পদের মধ্যে তেল-গ্যাস অন্যতম। অধাতব সম্পদের মধ্যে লবণ, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, সালফার, ইলোমাইট, জিরকন ও তেজস্ক্রিয় বালি প্রভৃতি ছাড়া ও নানা অজানা সম্পদ। এখানকার জলরাশির মধ্যে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির মাছ, বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী, জলজ শৈবাল যা উপকূলীয় অঞ্চলের ৫% ভাগ লোক ছাড়াও দেশের বিশাল জনসমষ্টি আমিষের অভাব পূরণ করে আসছে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সাগরে স্থলভাগের চেয়ে অধিক সম্পদ রয়েছে এ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তার ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা ও উল্লেখ করেছেন। সমুদ্র সীমা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব ও বহুলাংশে বেড়ে গেল। কারণ সম্পদকে রক্ষা করতে হলে যে বিষয়টি আগে আসে তা হলো সমুদ্র অঞ্চলে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণে যা কিছু প্রয়োজন তা করতে হবে। সমুদ্রের অপরিমেয় সম্পদ আহরণ এবং সংরক্ষণে পর্যাপ্ত জনবল দরকার তার জন্য সমুদ্র সংক্রান্ত বিভাগের আবশ্যকীয়তার বিষয়টিও ভাবতে হবে।
অতএব বোঝা যাচ্ছে সমুদ্রে যে অজস্র জানা-অজানা সম্পদ সম্ভার রয়েছে তা অনুসন্ধানপূর্বক চিহ্নিত করে অধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের সুবিধা মতো অভিজ্ঞ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় জরিপ কার্য চালিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করা। আমাদের দেশের তেল-গ্যাসের ওপর যে শকুনিদের লোলুপ দৃষ্টি নেই এ কথা বলা যাবে না। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে অবিলম্বে ঠা-া মাথায় সম্পদের ব্যবহারোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ভূমি-ক্ষুধিত সোনার বাংলাকে আগামী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়া। পরিশেষে বলা যায় অপার সম্ভাবনার বঙ্গোপসাগরে সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে গিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আমরা যদি এক সাথে কাজ করি তাহলে গোটা দেশের অর্থনৈতিক চেহারাটা যে পাল্টে যায় এ যাবৎ প্রাপ্ত বিজয় গাঁথা তা-ই প্রমাণ করেছে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।