যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর। আরে আরে, আমি কি সত্যি সত্যি মরে গেলাম! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু না হয়েও উপায় নেই। আমি শত চেষ্টা করেও হাত পা নাড়াতে পারছি না।
আমি পুরোপুরি আমার দেহটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি কিন্তু নাড়াতে পারছি না। মরেই গেলাম বুঝি এই ভয়ে চোখ খুলছি না। নাকি চোখ খোলার চেষ্টা করেও খুলতে পারছি না। নিজের শরীরের উপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আচ্ছা এই যদি মৃত্যু হয় তাহলে তো ভালোই।
বলা নেই কওয়া নেই, কেমন ঠুস করে মরে গেলাম। আমি ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছি।
শো শো করে প্রবল বেগে বাতাস বইছে আমার শরীরকে ঘিরে। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে বাতাস কেটে আমি শূন্যে উড়ে চলেছি। কেমন হালকা লাগছে শরীরটা।
পিঠের নিচ দিয়ে আলতো হাতে আমার দেহটাকে কারা যেনো বহন করে নিয়ে চলেছে। শরীরটাকে আমার ভর শূন্য মনে হচ্ছে। উড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমি ভাবতে চেষ্টা করছি আসলেই কি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতেও আমার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ক্রিয়াশীল রয়েছে।
একটু আগের ঘটনাও আমার পরিস্কার মনে আছে।
ভার্সিটির ক্লাশ শেষ হওয়া মাত্র আমি ডাইনিং থেকে খেয়ে হলের রুমে এসে একটু বিশ্রাম নেওয়ার মানসে শুয়েছি। আমার স্পষ্ট সব মনে পড়ছে। ক্লাশ শেষে কোথাও এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াইনি। ভার্সিটি জীবনে দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাই তড়িঘড়ি রুমে আসা।
যে ড্রেস পড়ে ফ্যাকাল্টি গিয়েছিলাম সেই ড্রেসই গায়ে আছে। বিকেল ৩.২০ এর শাটল ট্রেনে শহরে যাবো। মাঝখানে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় শুয়েছি।
এর মাঝেই আমি মরে গেলাম! মরে যাওয়াটা যদি এত সহজ হয় তবে সেটাই ভালো। আমি পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে চিন্তাভাবনা প্রসারিত করলাম।
আচ্ছা মানুষ মরে গেলে তো তার রুহ বা আত্মাটা বেরিয়ে যায়। কিন্তু আমি অনুভব করছি আমার পুরো দেহটাই উড়ে চলেছে। কিন্তু উড়ে চলা দেহটা যে আমার প্রকৃত দেহ নয় তা বুঝতে পারছি। হাত পা নাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু নাড়াতে পারছি না।
একজন মৃত মানুষ নিশ্চয়ই হাত পা নাড়াতে পারে না। আচ্ছা দেখিতো চোখ দুটো খোলা যায় কিনা। এবার আমি প্রাণপনে চোখ দুটো খোলার চেষ্টা চালালাম।
কী আশ্চর্য! চোখ দুটো খুলতে পেরেছি। চোখ খুলতেই আমার বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো।
আমার চোখের সামনে দিয়ে লাল, হলুদ, নীল, কালো রঙের গ্রহ নক্ষত্রগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলো। কোনোটা বড়, কোনোটা মাঝারি, কোনোটা আবার একেবারেই ছোট। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। আচ্ছা আমাকে নিশ্চয়ই এই গ্রহ নক্ষত্রগুলোর কোনো একটাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মরে তো গিয়েছিই, এ নিয়ে আফসোস করে আর কি হবে! আমার ভাবনায় পেয়ে বসে শেষ পর্যন্ত আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে।
ভার্সিটির বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। এই কিছুক্ষণ আগেও তাদের সাথে গল্পগুজব করেছি। আচ্ছা ওরা যখন দেখবে আমার নিস্তেজ দেহটা খাটের উপর পড়ে আছে তাদের প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে! আমি চেষ্টা করেও আমার নিস্তেজ দেহটাকে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু উড়েই চলেছি। এই চলার শেষ কোথায় কে জানে!
উড়ে চলার এই সময়টুকু আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে।
বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। আমার আকস্মিক মৃত্যুকে আমি ভাগ্য বলে মেনে নিয়েই পরবর্তী পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দিয়েছি। শুধু মনে পড়ছে আমার বাবা মাকে। তারা যখন শুনবে আমি মারা গিয়েছি নিশ্চয়ই অনেক কাঁদবে। কাঁদুক।
একদিন না একদিন তো মারা যেতেই হবে। এখন যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানকার পরিস্থিতিটা আগে দেখি।
হঠাৎ রুমের মধ্যে দিলীপের কন্ঠস্বরের আওয়াজ পেলাম। দিলীপ আমার রুমমেট। আমার মনে পড়ে গেলো রুমে আরও অনেকেই আছে।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনোয়ার আমার পাশেই শোয়া। দিলীপের এক পরিচিত ছোটভাই দিলীপের বিছানায়। ও অ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়ার জন্য আজই আমাদের রুমে উঠেছে। আমি বিছানায় শোয়ার আগে তাদের সবার সাথে কথা বলেছি। বিছানায় শুয়েও কিছুক্ষণ কথা হয়েছে।
আচ্ছা দিলীপ যে কথা বলে উঠলো তাহলে কি মরে যাওয়ার পরেও ক্থা শোনার ক্ষমতা থাকে!
দিলীপের কথার প্রতিউত্তরে ছোটভাই কি যেনো জবাব দেয়। আমি চেতনার জগতে ফিরে আসি। চোখের সামনে গ্রহ নক্ষত্রগুলো এখন আর সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে না। কেমন যেনো স্থির হয়ে আছে লাল, কালো, হলুদ গ্রহ নক্ষত্রগুলো। বাতাসের শো শো শব্দটা ঠিকই পাচ্ছি।
কোথায় যেনো পড়েছিলাম শরীর অসাড় হয়ে পড়লে পায়ের আঙুল নাড়ানোর জন্য। আস্তে আস্তে ডানপায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলটা নাড়ানোর চেষ্টা করি। আরে! ঠিকই নাড়াতে পারছি। এবার পুরো ডান পা’টা নাড়ালাম। তারপর বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলটা নাড়ালাম।
আস্তে আস্তে পুরো বাম পা’টা নড়ে উঠল। ডান হাত নাড়িয়ে দেখলাম। এবার নাড়ানো যাচ্ছে। বাম হাতটাও নাড়ালাম। এবার পুরো শরীরে চেতনা ফিরে এসেছে।
আচ্ছা এতক্ষণ কি আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম?
চেতনা ফিরে আসার পরও আমি ঠিক যেভাবে ছিলাম সেভাবেই শুয়ে থাকি। অদ্ভূত এক আবেশ এসে আমার মনকে আলোড়িত করে তুলেছে। পরাবাস্তব জগত থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ আমি ঝিম মেরে থাকি। ঘটনাটি বড়জোর কয়েক মুহূর্তের। এই কয়েক মুহূর্ত আসলে আমি কোথায় ছিলাম? আমার অবচেতন মনে কি সৌরজগত ঘুরে আসলাম? ধাতস্থ হতে আমার কিছুক্ষণ সময় লাগে।
ভার্সিটির যে সিঙ্গেল খাট তাতে দুজনে শেয়ার করা অনেকটা কষ্টসাধ্য। আমার পাশে বন্ধু মনোয়ার শোয়া। তাই আমি একেবারে পূর্বদিকে দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে শুয়েছিলাম। এখনও সেভাবেই আছি। আমি চিৎ হয়েই আছি।
আমার ঘাড়টা কাত হয়ে মাথাটা পূর্বদিকে দেয়ালের সাথে ঠেকানো। ফলে আমার চোখদুটো একদম দেওয়ালের সাথেই ঠেকে আছে প্রায়।
চেতনা ফিরে পেয়ে আমি পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছি। এই যে গ্রহ, নক্ষত্র এত কিছু দেখলাম এটা কি ঘুমের ঘোরে কোনো স্বপ্ন নাকি জাগ্রত অবস্থায় দেখা। কাউকে কিছু না বলে আমি আবারও চোখদুটোকে দেওয়ালের নিকট নিয়ে গেলাম।
আরে কি আশ্চর্য! দেওয়ালের চুনকাম উঠে গিয়ে বিন্দু বিন্দু যে বালুকণা গুলো বেরিয়ে আছে সেগুলো চোখের মণিতে বড় বড় লাগছে। বালুকণাসম একটি ছোট্ট হলদেটে শামুকও দেখতে পেলাম। তন্দ্রার ঘোরে চোখের মণির অতি নিকটেই এগুলোই আমার কাছে বড় বড় গ্রহ নক্ষত্রের মতোই লেগেছে। বালুকণাগুলো কোনোটি কালো, কোনোটি একটু লালচে, কোনোটি সাদা।
আমি যখন বিছানায় শুই তখন কারেন্ট ছিল না।
টেবিল ফ্যানের সুইচ দেওয়া ছিল। এর মাঝেই কারেন্ট এসে ফ্যান চালু হয়ে গিয়েছিল। ফুল স্পীডে ফ্যানের বাতাস আমাকে গ্রহ গ্রহান্তরে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি দিয়েছিল। পুরো ঘটনাটি বড়জোর দুয়েক মিনিটে ঘটেছিল। এই সময়টুকুতে আমি নিশ্চয়ই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম আর এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাটি দেখে এসেছিলাম।
চেতনা ফিরে পাওয়ার পর বিস্ময়াভিভূত এই ঘটনাটির একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম নিজে নিজেই।
অনেক সময় চিৎ হয়ে ঘুমোলে ঘাড় যদি একপাশে কাত হয়ে থাকে তাহলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। এসময় মানুষের শরীরে যে প্রতিক্রিয়া হয় সেটাকে বোবায় ধরা বলে। আমি বুঝতে পারছি কিছু সময়ের জন্য আমাকেও বোবায় ধরেছিল। ঘটনাটি আমার কাছে এতটাই জীবন্ত মনে হয়েছিল যে আমি আজও এ ঘটনাটি ভুলতে পারিনি।
প্রায় বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কতটুকু বর্ণনা করতে পেরেছি তা জানি না কিন্তু আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম একটি ঘটনা। মাঝে মাঝে ভাবি ইস্! মৃত্যু যদি এরকম সহজ হতো তাহলে মরণে ভয় কিসের! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।