মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা। ছোটবেলায় শিখেছিলাম বই খাতা নিচে পড়ে গেলে সালাম করে তুলে রাখতে হয়। কারণ এরা বিদ্যা শিক্ষার যন্ত্রপাতি। যে সে জিনিস নয়। বিদ্যাকে সম্মান করতে না শিখলে বিদ্যা অর্জিত হয় না।
ভাবসম্প্রসারণ মুখস্ত করেছিলাম অসীর চেয়ে মসী বড়। যে সে মুখস্ত নয় রীতিমতো নোট করে মুখস্ত। সত্যি কথাই বলি বিদ্যা শিক্ষার উপর অতো মায়া মহব্বত কোনকালেই খুব একটা কাজ করেনি, কিন্তু একটা ব্যপার সেই ছোটকাল থেকেই মাথার ভেতর এঁটে ছিলো, শিক্ষা যে সে ব্যপার নয়। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যার তার সাধ্যে কুলায় না। খুব অসাধারণ ধরণের কিছু মানুষই পারে এই কটমটে নীরস বিরস লেখালেখিকে আত্মস্থ করে শিক্ষিত হতে।
শিক্ষা তাই অনেক সম্মানের একটা ব্যপার। অনেক বেশী সম্মানের। তাইতো ভীষণ বৃষ্টিতে স্কুল থেকে যখন বাসায় ফিরতাম, ছোট দুহাতে বিশাল ব্যাগ আর ছাতা একসাথে সামলানো সম্ভব হতোনা। বেশীরভাগ সময় নিজে ভিজে যেতাম কিন্তু বইখাতাগুলোকে ভিজতে দিতাম না। কোন কারনে যদি ভিজেও যেতো, বাসায় এসেই ইস্ত্রি দিয়ে ডলে ডলে কুঁচকে যাওয়া পাতাগুলোকে সোজা করতাম।
মনেই থাকতোনা পরনের কাপড়গুলো তখনো ভেজা। অনেকে বলে বইয়ের পাতায় পাতায় দাগানো না থাকলে নাকি পড়াশোনা হয়না। ব্যাপারটাতে যদি সামান্যতমও সত্যতা থাকে তাহলে বলতে হবে আমি কলেজ পর্যন্ত মুর্খ ছিলাম। কারণ তখন পর্যন্ত আমার বইয়ের ভেতর কোন দাগ খুঁজে পাওয়া যেতনা। এতো সুন্দর করে সাদা জমিনের উপর ছাপানো একটা বই, তার ভেতর হঠাৎ একটা কমদামী বলপয়েন্ট কলমের দাগ।
কি বেমানান, কি নিষ্ঠুর। আবার হয়তো দেখা যেতো সন্ধ্যাবেলা সেই বইটা খুলেই কপাল কুঁচকে ফেলেছি। পড়াশোনা করতে হবে যে। তারপরও বইখাতার যত্নের কমতি হয়না। কারণ? ঐ যে বলে আসলাম না, বিদ্যাকে সম্মান করতে না শিখলে বিদ্যা অর্জিত হয় না যে।
এতো গেলো জড়বস্তুর কথা। এবার জীবজগতে আসি। আরেকটি ভাবসম্প্রসারনের কথা মনে পড়ে গেলো শিক্ষক হলেন দ্বিতীয় পিতা। যে মানুষটাকে ছোটবেলায় বিদ্যা শিক্ষার যন্ত্রপাতিকে সম্মান করতে সেখানো হতো তার জন্য এ ধরণের ভাবসম্প্রসারন খুবই সত্য এবং স্বাভাবিক। হ্যাঁ, পড়ালেখার মতো এমন কটমটে জিনিস নিয়ে তারা পড়ে থাকেন এবং অন্যদেরও পড়ানোর চেষ্টা করেন।
এরা তো সুপার হিরোর চেয়েও বেশীকিছু। হ্যাঁ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুপার ভিলেনও। তবে উভয় ক্ষেত্রেই একটা কমন জিনিস আছে। আর তা হল সম্মান এবং শ্রদ্ধা। আমি শিক্ষাকে সম্মান করতে শিখেছি।
আর শিক্ষার পেছনের এই জ্বলজ্যান্ত মানুষ গড়ার কারিগরকে আরো বেশী সম্মান করতে শিখেছি। আজ তাই আমি লজ্জিত। বাংগালী জাতির লজ্জা পাওয়ার কারনের কখনো অভাব হয়না। তারপরেও আমাদের লজ্জার ভান্ডার ফুরিয়ে যায়না। আমরা বার বার লজ্জিত হই।
কিংবা বলা যায় লজ্জিত হতে হতে আমরা অভ্যস্ত। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক র্যবের হাতে অপদস্ত হলেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক র্যবের একজন ড্রাইভারের হাতে মার খেলেন। সেই বিদ্যাপীঠেরই একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি লজ্জিত, আমি কুন্ঠিত।
স্যার ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যেতাম।
এই রেওয়াজ কে কবে চালু করেছিলো জানা নেই। তবে এই রেওয়াজ পালন করে যাওয়ার সময় আমাদের মধ্যে কোন দ্বিধা কাজ করতোনা। কারণ এই সম্মান একজন শিক্ষক হিসেবে তার প্রাপ্য। এবং একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার আওতায় পড়ে যায়। মানিব্যাগ থেকে দশটা টাকা বের করে দিয়ে দেয়া যতটা সোজা, বইয়ের পাতা থেকে ভীষণ কঠিন দশটা শব্দ বের করে একই সাথে সত্তরটা মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া আমার কাছে ততটা সোজা মনে হয়না।
এই কঠিন কাজটি একমাত্র শিক্ষকেরাই পারেন। তাই আমি কৃতজ্ঞ। অন্যরা কে কি ভাবে আমি জানিনা, জানতেও চাইনা। আমি শুধু জানি আমি নিজেকে অকৃতজ্ঞ ভাবতে চাইনা। আজ সেইরকম একজন মানুষ লাথি খেলো।
লাথি কি উনি একাই খেয়েছেন। আমরা খাইনি? আমাদের বিবেকবোধ খায়নি? ঐ লাথি শুধু উনার বুকে নয়, পুরো জাতির মুখে পড়েছে।
আমি জানি, আমাদের নানী দাদীদের কাল আর নেই। বইকে এখন কেউ সালাম করেনা। স্কুল ছাত্রের হাতে শিক্ষক নিহত হয়, এইটাও এখন চমকে উঠার মতো কোন ব্যপার না।
বাঙ্গালীর কঠিন হজম শক্তি। হজমী ছাড়াই সব হজম হয়ে যায়। তবে আমি কেন হজম করতে পারছিনা। তাই আজ এলোমেলো কিছু কথা লিখছি। এলোমেলো, কারণ এগুলো একটা অসীর কাছে লাঞ্ছিত মসীর লেখা।
সাজিয়ে লিখে কি লাভ? আরে লিখেই বা কি লাভ?
এই যে কালো পোষাকধারী জাতির রক্ষকেরা, তোমাদেরই বলছি, একজন শিক্ষককে আক্রমন করার জন্য তোমাদের দেশের রক্ষক বানানো হয়নি। একজন শিক্ষকের বুকে লাথি মারার জন্য তোমাদের পায়ে বুট জুতা পড়ানো হয়নি। ধিক্কার জানাই তোমাদের মতো নরপশুদের। তোমাদের পোষাকের মতো তোমাদের ভেতরটাও কালো। এতোকাল সন্ত্রাসী মেরেছো, দেখেছি, ছাত্র মেরেছো তাও বোবার মতো দেখেছি, ভালো মানুষ মেরেছো, আমরাও ভালমানুষের মতো চায়ের কাপ হাতে পেপারে তোমাদের কেচ্ছাকাহিনী পড়ে গিয়েছি।
আর পারছিনা, আমার হজম শক্তি হার মেনে গিয়েছে। এতোদিন যে শিক্ষককে সম্মান জানানোর জন্য দাঁড়াতাম আজ দাঁড়াবো সেই শিক্ষকের অপমানের প্রতিবাদ করতে। সেই প্রতিবাদটুকু আমাদের লাঞ্চিত শ্রদ্ধার স্মারক হয়ে থাক।
র্যাব সদস্যের মারধরে ঢাবি শিক্ষক আহত
নিরাপত্তাহীন আতঙ্কে আছি, র্যাবের নির্যাতনে আহত ঢাবি শিক্ষক সাইফুদ্দিন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।