ভালো লাগে স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে তখন সবেমাত্র অনার্স ফাইনাল দিচ্ছি । আর দুইমাস পর ফাইনাল। তাই রাতদিন এক করে সারাবছর অবহেলায় পড়ে থাকা বইগুলোর গুষ্ঠী উদ্ধার করছি । এমন অবস্থায় বাবা একদিন তার রুমে ডেকে পাঠালেন । বাবাকে আমরা ৩ ভাইবোনই বরাবর ভয় পায়।
আর সবার বড় হওয়ায় আমার ভয়টা মনে হয় একটু বেশী। দুরুদুরু মন নিয়ে গেলাম বাবার কাছে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, "তোমার পরীক্ষা কবে থেকে শুরু হচ্ছে?"
"এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকে। "
"তাহলে তো মাঝখানে এখনো দুইমাস রয়ে গেছে। শুনো, কালকে বিকেলে ভালো জামাকাপড় পড়ে রেডী থাকবে ।
কালকে তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। পছন্দ হলে কালকেই বিয়ে হবে। এখন যাও। "
নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারলাম না কি শুনলাম । যদিও আমার কোন মেয়ের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই তাই পারিবারিকভাবে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই।
কিন্তু এভাবে হুট করে বিয়ে করতে হবে কেন? বাবার মুখের উপর কথা বলবো এমন কথা আমরা কল্পনাও করিনা কখনো। তাই ওখান থেকে বের হয়ে মার কাছে গিয়ে বললাম আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিনা । মা জানালেন বাবা অনেক আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন । দেখতে যাওয়াটা একটা ছুটো মাত্র। তাই বিয়েটা যে হবে তার কোন সন্দেহ নেই।
সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারিনি । একবার ভেবেছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। অনেক কিছু বিবেচনা করে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি। পরদিন ঠিকই আমরা নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি। বিয়ে নিয়ে আমার যে আপত্তিগুলো ছিলো নতুন বউয়ের মিষ্টি মায়াময় মুখটি দেখে সব কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল ।
পরদিন থেকে আমাদের বাড়ির পরিবেশে যেন পরিবর্তনের হাওয়া লাগলো । নতুন বউ পায়ের নুপূরে ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। বাবার গাম্ভীরযের তলায় পিষ্ঠ হয়ে প্রাচীন মানুষের মতো মৃতপ্রায় বাড়িটা হঠাৎ যেন তার হারানো যৌবন ফিরে পেল । দুদিন আগে যার এ বাড়িতে কোন অস্তিত্ব ছিলো না আজ সে সবার মধ্যমণি হয়ে গেছে। দুদিনে সে সংসারে এমনভাবে কর্তৃত্ব স্থাপন করলো যে তাকে ছাড়া এখন সবই অচল লাগে।
আমার ছোট দুই ভাইবোনকেও দেখি সারাক্ষণ ভাবী ভাবী বলে অস্থির । এতদিনে মার একটা মনের মতো সঙ্গী জুটলো দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় । আমি দূর থেকে সবই উপভোগ করি । ছোটবেলা থেকে যে বাবাকে আমরা রাশভারী গম্ভীর বলে চিনতাম , যার সামনে আমরা মুখ ফুটে কখনো কিছু আব্দার করতে পারিনি, সেই বাবার সামনে সে দেখলাম অবলীলায় বলে ফেলে," আব্বা আপনি তো বিয়েতে আমাকে একটা লাল শাড়ীও দিলেন না। লাল শাড়ী ছাড়া কি নতুন বৌ নতুন বৌ লাগে?"
বাবাও দেখলাম হাসতে হাসতে বলছেন, " তাই তো রে মা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।
"
পরদিন বাবা ঠিকই তার জন্য একটা লাল জামদানী শাড়ী নিয়ে আসে । সারাদিন সে ঐ শাড়ী পরে ঘরময় ঝুন ঝুন নুপুরে আওয়াজ তুলে ঘুরে বেড়ায়।
এই চঞ্চলা রমণীকে আমি গোপনে টুনটুনি ডাকতাম। খেয়াল করলাম পুরো ঘর মাথায় তুলে রাখা এই চঞ্চলা রমণীটি আমার রুমে ঢুকেই কেমন চুপ হয়ে যায় । কিছু বললে কেবল হু হা করে উত্তর দেয় ।
বাড়ির অন্যান্যদের প্রতি তাই আমি একটু ঈর্ষাবোধ করতে থাকি।
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় । এরপর থেকেই সে একটু একটু আমার কাছে আসতে থাকে । ওর সব আব্দার যেন এখন শুধু আমাকে ঘিরেই। বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই সে পথ আগলে দাড়াতো।
কেনাকাটার একটা লম্বা লিষ্ট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো ,"তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবা। " ইচ্ছে করেই আমি একটু দেরীতে বাড়ি ফিরতাম। তখন দেখতাম ও অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওর অভিমান ভাঙানো ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কারণ ঐ সময় অভিমান না ভাঙ্গা পর্যন্ত সে আমাকে জড়িয়ে বসে থাকতো।
আর আমি টুনটুনি পাখিটার পালকতুল্য হাতটা ধরে নানা কথা বলে তার মান ভাঙ্গাতাম।
একদিন জানতে চাইলাম," বিয়ের প্রথম দিকে অমন দূরে দুরে থাকতে কেন?"
ও সহজ সরল ভাবে বললো, "বাহ্ রে , তোমার পরীক্ষা ছিলো না? তাই আব্বার কড়া হুকুম ছিলো তোমার পড়াশুনায় যেন ব্যাঘাত না করি। "
এভাবে প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির পরিবেশটা অনেকটা সাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন আর আমরাও কেউ বাবাকে ভয় পায় না।
মা কে অনেকটা প্রাণবন্ত দেখায়। কিন্তু যেই টুনটুনি পাখিটার কিচিরমিচিরে বাড়িটা ভরে থাকতো সে যেন কেমন নিরুত্তাপ হয়ে গেছে। কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলেও কিছু বলে না। একদিন রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে," ওগো, আমার মনে হয় মরণ রোগ হয়েছে। আমি আর মনে হয় বাচবো না।
"
মনে হলো আমাকে সাই করে কেউ চাবুক মারলো। তবু শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললাম," ধুর, কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো। কি হয়েছে একটু খুলে বলো তো?"
ও বললো," আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। সারাক্ষণ খালি মাথা ভার ভার লাগে। হাটতে গেলে মনে হয় পড়ে যাবো।
আবার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না । যাই খাচ্ছি সব বমি হয়ে যাচ্ছে। "
আমি বললাম," চিন্তা করোনা, কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। "
টুনটনির এই হঠাৎ পরিবর্তনে সবাই কমবেশী চিন্তিত হয়ে আছে। এরি মাঝে সবাই জেনে গেছে আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই উদ্দিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। ঢুকার সাথে সাথে সবাই মিলে প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দিলো। সবাইকে শান্ত করে আমাদের পরিবারে নতুন অতিথির আগমনের খবরটা জানিয়ে দিলাম । সেদিনের টুনটুনির লজ্জামাখা মুখটি আমি কখনো ভুলবো না ।
আজ ও দুই সন্তানের গর্বিত মা।
কিন্তু এতদিনেও তার চাঞ্চল্য একটুও কমেনি। বরং ছেলেদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আরো একটু বেড়েছে। আমি খুব মন দিয়ে ওর ছুটোছুটি উপভোগ করো। ওর কপাট শাসনে আমি আজ সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ। শুধু একটা অপূর্ণতা এখনো রয়ে গেছে।
ওকে আজও মুখ ফুটে বলা হয়নি , "টুনটুনি, আমি তোমাকে আমার নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসি। "
পুনশ্চ: ওকে আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে টুনটুনিও ডাকা হয় নি। জানি না কখনো হবে কিনা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।