ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র ২০তম কংগ্রেসের
কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে খসড়া প্রস্তাবের চতুর্থ অধ্যায়
৪.১ আন্তর্জাতিক শ্রেণীশক্তিসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাতস সাম্রাজ্যবাদের অনুকুলে আসার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার তিনটি ঘোষিত লক্ষ্য অর্জন করতে বিশ্বজুড়ে আধিপত্যকে সংহত করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছে।
৪.২ প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় অবশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিলুপ্তি ঘটানো; দ্বিতীয়ত, হয় পরাস্ত করে অথবা অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে দেশগুলিকে ক্ষমতাহীন করে দেওয়া; তৃতীয়ত, বিশ্ব জাতীয়তাবাদ, বি-ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়ার সময় জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যা বাস্তবায়িত হয়েছিল এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, সাধারণভাবে বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিজ সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা, বিশেষ করে অনুমিত প্রতিযোগীদের ওপর।
৪.৩ এই নতুন বিশ্ব ব্যেবস্থা সর্বত্র কায়েম করার লক্ষ্যে নকশা সাজানো হয়েছে। (১৫) এই লক্ষ্যে, একদিকে একতরফা যুদ্ধ করে সামরিকভাবে ইরাককে দখল করা হয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে।
(১৬) একই সঙ্গে, ন্যা টো, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর যার অস্তিত্ব রাখা একেবারেই উচিত ছিল না, সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ কাঠামো হিসাবে তাকেই আবার শক্তিশালী করা হয়েছে। (১৭)
৪.৪ নিজের প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে এবং তা বজায় রাখতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পদ, বিশেষত শক্তিসমূহের উৎস এবং সুনির্দিষ্টভাবে তেলের ওপর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ কায়েম করাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। (১৮) অতএব, এখন তার সমস্ত মনোযোগ পশ্চিম এশিয়ায়। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় তেল ও গ্যাসের ভান্ডারের ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণনীতির কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল আফগানিস্তান। (১৯) ইজরায়েলকে সামরিকভাবে মদত দেওয়া এবং পশ্চিম এশিয়া সঙ্কটকে জিইয়ে রেখে রাজনীতি ও শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা এই প্রয়োজনেরই প্রত্যক্ষ পরিণাম, ‘শাসনক্ষমতা পরিবর্তন’-এর হাওয়া তুলে এই ভূখন্ডের সম্পদের নিয়ন্ত্রণে সাম্রাজ্যবাদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।
৪.৫ তিউনিশিয়া, মিশর, ইয়েমেন এবং অন্যা ন্য দেশগুলিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন অথবা মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনতার বিদ্রোহী অভ্যূত্থান ‘আরব বসন্ত’ দেখেছে। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং আরো উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষাই এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এই অঞ্চলে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কয়েকটি মিত্রশক্তিকে হারিয়ে সাম্রাজ্যবাদ নতুন উদীয়মান শক্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে নির্লজ্জভাবে লিবিয়াতে সামরিক হস্তক্ষেপ করছে অথবা বাহ্রিনে হস্তক্ষেপের জন্য সৌদি আরবকে মদত দিচ্ছে। যদিও এই ঘটনাপ্রবাহ আরো এগোবে, এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের এই অংশে আন্তঃ-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে। ইরান, তুরস্ক, সিরিয়ার মতো পশ্চিম এশীয় শক্তিগুলি তাদের আঞ্চলিক প্রভাবকে পুনরায় সংহত করতে চাইছে।
৪.৬ এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত, সাম্রাজ্যবাদ যেখানেই শাসনক্ষমতার পরিবর্তন করতে সফল হয়েছে, সেখানে তারা শুধুমাত্র চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রপন্থী শক্তিকেই জায়গা ছেড়েছে, পর্যায়ক্রমে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তিকে আক্রমণ করে। পরবর্তী শক্তিকে দুর্বল করা সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি ঘোষিত লক্ষ্য, কারণ তারাই প্রকৃত ও দৃঢ়ভাবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। সাম্রাজ্যবাদ এবং মুসলিম মৌলবাদী শক্তি বামপন্থীদের দুর্বল করার লক্ষ্যে কাজ করছে। ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে তীক্ষ্ণ করেছে এবং সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। এর আগে, তেলের ওপর দখলদারি কায়েম রাখতে, ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাহ্ জমানায় কমিউনিস্ট এবং প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদীদের সুপরিকল্পিতভাবে পাশবিক নিপীড়ন করা হয় এমনভাবে যাতে প্রধান বিরোধী হিসাবে একমাত্র মুসলিম মৌলভীরাই উঠে আসার সুযোগ পায়।
আফগানিস্তানে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত প্রগতিশীল শক্তিকে শাসনক্ষমতা থেকে হঠাতে সক্রিয়তার ফলে মুজাহিদিন-তালিবান-ওসামা বিন লাদেন-এর অশুভ আঁতাত — মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ তৈরি করে। সাম্প্রতিক ‘আরব বসন্ত’-এর ঘটনার সঙ্গে এখানকার অনেকগুলি দেশে একই ধরণের বিপদ আসন্ন হতে দেখা যাচ্ছে।
৪.৭ সাম্রাজ্যবাদের এই সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হলো তার অভিভাবকত্বে একটি একমেরু বিশ্বব্য৭বস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী ভাবাদর্শগত আক্রমণ নামিয়ে আনা। সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত বাজারকেই গণতন্ত্রের সমতুল মনে করে। এই ভেক ধরে এবং গণতন্ত্রের ধারণাকে উর্ধ্বে তুলে ধরার নামে সাম্রাজ্যবাদ সেই সব শাসনব্য বস্থার ওপরে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করছে, যারা তার আধিপত্যের বিরোধিতা করছে, নয়া-উদারবাদী সংস্কার এবং ‘মুক্ত বাজার’ নীতি চাপানোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
৪.৮ সাম্রাজ্যবাদ, তথাকথিত ‘মানবাধিকার’ এবং ‘বিশ্বজনীন মূল্যবোধ’-কে উর্ধ্বে তুলে ধরার নামে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ করছে। যদিও এই সব সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নির্লজ্জভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আড়াল করার সঙ্গে সঙ্গেই একই অজুহাত দেখিয়ে পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়াকে ছোট ছোট শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার কাজে হস্তক্ষেপ করেছে। অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলির বুর্জোয়াজী, যারা এতদিন ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব’-র ধারণাকে অলঙ্ঘণীয় বলে উর্ধ্বে তুলে ধরে এসেছে, তারাই এখন ‘মানবাধিকার’ রক্ষার নামে স্বাধীন দেশগুলির জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করছে এবং সামরিক হস্তক্ষেপ করে তাকে ধ্বংস করছে।
৪.৯ নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ৯/১১-র আক্রমণের পরে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে যে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যা পী যুদ্ধ’ শুরু হয়, তা আসলে নির্লজ্জ সামরিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে, জাতীয় সার্বভৌমত্বকে পদদলিত করার জন্যে এবং নিজের স্বার্থের অনুকুলে একটি ‘শাসনব্যীবস্থা পরিবর্তন’ চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে, যা আমরা দেখেছি ইরাক এবং আফগানিস্তানে, যা এখন দেখছি ইরানকে হুমকি দেওয়ার মধ্যে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদে অভ্যস্ত সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদ ঘটানো মৌলবাদী সংগঠনগুলি একে অপরের পরিপূরক।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনই সফল হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এই দুই বিপদের বিরুদ্ধেই কার্যকরীভাবে লড়াই করা যায়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যেমন সাম্রাজ্যবাদী সামরিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিতে অজুহাত হিসাবে ‘সাম্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-কে ব্যবহার করা হতো, তেমনি ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-কেও এখন স্বাধীন দেশগুলির জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং এইসব দেশের জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
৪.১০ সাম্রাজ্যবাদ বিষাক্ত কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার শুরু করেছে এবং বর্তমানে কমিউনিজমকে ফ্যানসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে একইভাবে তুলনা করছে। ইউরোপীয় সংসদ কমিউনিজমকে ফ্যা সিবাদের সঙ্গে তুলনা করে ব্যভবস্থা গ্রহণ করছে এবং আইন প্রণয়ন করতে চাইছে। চেক রিপাবলিক, পোল্যা ন্ড প্রভৃতির মতো পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে কমিউনিস্ট প্রতীক এবং কার্যকলাপ আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৪.১১ সমাজতন্ত্রকে এখনো স্বৈরশাসন এবং সাম্রাজ্যবাদী সংজ্ঞা অনুসারে মানবাধিকার এবং সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের বিপরীত হিসেবে অভিহিত করে নিন্দা করা হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হচ্ছে তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার ওপর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই অজুহাতে কিউবার বিরুদ্ধে তার অপরাধমূলক অর্থনৈতিক অবরোধ অব্যাহত রেখেছে।
৪.১২ সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উদারবাদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে ভাবাদর্শগত যুদ্ধ এই সময়ে আরো আক্রমণাত্মক হয়েছে। বিশ্বায়নের এই প্রক্রিয়ায় এবং অতিমাত্রায় উন্নীত প্রযুক্তির সহায়তায় মেগা কর্পোরেশনগুলিতে তথ্য, যোগাযোগ ও বিনোদন প্রযুক্তির এক-কেন্দ্রাভিমুখিতা(convergence) ঘটেছে।
(২০) মানবিক বৌদ্ধিক কার্যকলাপের এই পর্যায়েরও একচেটিয়াকরণ এবং বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য সংবহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এই সময়কালের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প বা সমালোচনার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ভাবাদর্শগত আক্রমণ নামিয়ে আনছে। সাংস্কৃতিক আধিপত্য হলো বিশ্বায়নের এমন একটি প্রক্রিয়া যা জনসাধারণের মধ্যে একটি সমধর্মী রুচিবোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনে তৈরি। যত বেশি অংশের মধ্যে সম-রুচি তৈরি হবে, তত বেশি বিশাল অংশের জনসাধারণের জন্য একই ধরণের ‘সাংস্কৃতিক পণ্য’ নির্মাণের প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো সহজ হবে। সংস্কৃতির পণ্যাসয়ন এই বিশ্বায়নের একটি স্বাভাবিক পরিণতি। শ্রেণী আধিপত্যের দৃষ্টিতে দেখলে, সংস্কৃতির এই বিশ্বায়ন মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
সংস্কৃতি এক্ষেত্রে কোনো নান্দনিক আবেদন রাখার কাজ করে না, বরং দারিদ্র ও দুর্দশার সমস্যাৃকে আড়াল করা, এর থেকে অন্যদিকে চালিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
৪.১৩ এই মতাদর্শগত আক্রমণ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যকে আরো শক্তিশালী করার সামগ্রিক প্রচেষ্টারই একটি অঙ্গ, মানবসভ্যদতার বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে যাকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
টীকা দ্রষ্টব্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।