মানুষের সমাজে এক মুহূর্ত বাঁচতে চাই
বদরুদ্দীন উমর
কাছাকাছি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে দুটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটি হলো, বিগত এপ্রিল মাসে মেক্সিকো উপসাগরে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের (বিপি) তেল উত্তোলনে বিপর্যয় ঘটায় তেল সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে উপচে পড়তে শুরু করা। তেল ক্রমাগত বের হয়ে সেই থেকে মেক্সিকো উপসাগর ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিছুতেই তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এই সঙ্গে আমেরিকার দক্ষিণে তিনটি রাজ্যের উপকূলে তেল ছড়িয়ে পড়তে থাকায় ওইসব অঞ্চলের পানি এমনভাবে দূষিত হয়েছে, যাতে তার ফলে সব ধরনের জলজ প্রাণী ধ্বংস হওয়ার পথে।
এর দ্বারা সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্যগুলোর জনজীবনও এখন দারুণভাবে বিপর্যস্ত।
প্রায় দুই মাস ধরে যখন মেক্সিকো উপসাগরে এই ধ্বংসকাণ্ড চলছে, তখন ভারতের আদালত ১৯৮৪ সালে ভূপালে মার্কিন কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইডের মালিকানাধীন গ্যাস প্ল্যান্ট বিস্ফোরণের ফলে লাখ লাখ মানুষ নিহত এবং আরও বহু লাখ মানুষ শারীরিকভাবে বড় রকম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনার মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। ২৬ বছর ধরে এই মামলা টেনে নিয়ে আসার পর এখন ইউনিয়ন কার্বাইডের শীর্ষতম কয়েকজন কর্মকর্তাকে মাত্র দু'বছর জেলের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০৪ ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন কার্বাইডের অপরাধের শাস্তি যেখানে হওয়ার কথা ছিল ১০ বছর জেল, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এএইচ আহমেদী মামলাটিকে নিয়ে আসেন ৩০৪-ক ধারায় যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে দু'বছর জেল। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ভূপালে গ্যাস প্ল্যান্ট দুর্ঘটনার পরপরই পুলিশ ইউনিয়ন কার্বাইডের চেয়ারম্যান ওয়ারেন এন্ডারসনকে গ্রেফতার করে।
কিন্তু তারপর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ভূপালের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংকে নির্দেশ দেন এন্ডারসনকে ছেড়ে দিতে। নিজের মন্ত্রিসভার সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই রাজীব গান্ধী ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই এ কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো মুখ্যমন্ত্রী এন্ডারসনকে শুধু জেল থেকে ছেড়েই দেননি, যে ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এন্ডারসনকে গ্রেফতার করেছিলেন, তারাই তাকে নিয়ে গিয়ে একটি বিশেষ রাষ্ট্রীয় প্লেনে চড়িয়ে দিলি্ল রওনা করেন। এর ঠিক পরই এন্ডারসন দিলি্ল থেকে সরকারের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। রাজীব গান্ধীর এই আচরণের কারণ তার ওপর মার্কিন চাপ বলে উচ্চমার্গের একজন কংগ্রেস নেতা উল্লেখ করেন।
এই চাপের কারণে এত বড় গণবিরোধী অপরাধ যে দেশের প্রধানমন্ত্রী করতে পারেন, তার নিজের নৈতিক মান তো বটেই, কিন্তু তার থেকে বেশি দেশটির স্বাধীন চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। বলাই বাহুল্য, যে কারণে রাজীব গান্ধী এন্ডারসনের মতো এক আমেরিকান ক্রিমিনালকে দেশের মাটিতে লাখ লাখ মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচার না করে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন, ঠিক সে কারণেই তার উত্তরসূরি কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে আদালত ইউনিয়ন কার্বাইডের কর্মকর্তাদের মাত্র দু'বছর কারাদণ্ডের বিধান দিয়েছেন। এখানে বলা দরকার, রাজীব গান্ধী শুধু এন্ডারসনকে জেল থেকে বের করে, রাষ্ট্রীয় প্লেনে করে দিলি্ল নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন তা-ই নয়, ভূপালের দুই লাখের ওপর লোকের মৃত্যুর এবং আরও অধিক সংখ্যক লোকের আহত হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার সরকার আদালতের বাইরে ইউনিয়ন কার্বাইডের সঙ্গে সমঝোতা করে মাত্র ৪৭ কোটি ডলারের বিনিময়ে তাদের দায়মুক্ত করেছিলেন! ১৯৯৯ সালে ডাও কেমিক্যাল ইউনিয়ন কার্বাইড খরিদ করে। এখন তারাই মালিক এবং এখন তারা বলছে, ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে তাদের আর করার কিছু নেই; কারণ ১৯৮৯ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে ৪৭ কোটি ডলার দিয়ে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।
এদিকে ইউনিয়ন কার্বাইডের যে কর্মকর্তাদের দু'বছর করে জেল দেওয়া হয়েছে, সেই আমেরিকান নাগরিকদের ভারতে এনে এভাবে জেলে
আটকানো যাবে এর সম্ভাবনা সামান্য।
কাজেই বাস্তবত দেখা যাচ্ছে, ভারতের মাটিতে এত বড় ধ্বংসকাণ্ড ঘটিয়ে দুই লাখের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটিয়ে, মাত্র ৪৭ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণের নামে দিয়ে একটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি ছাড় পেয়ে গেল! এবং এই ছাড় তাদের দিল সে দেশের নির্বাচিত সরকার, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার!! শুধু তা-ই নয়, সরকারের এই গণবিরোধী কাজের শরিক হলেন সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট!!!
বাংলাদেশে ছোট আকারে হলেও এই একই ধরনের ধ্বংসকাণ্ড ঘটেছিল ১৯৯৭ সালের জুন মাসে সিলেটের মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে অতি তুচ্ছ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের নিষ্কৃতি দেওয়া হয়েছিল, যদিও মাগুরছড়ার ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি এখনও অব্যাহত আছে। মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র অক্সিডেন্টাল পরে ইউনোকলকে বিক্রি করেছিল। তারপর এখন সেটা ইউনোকলের থেকে হস্তান্তরিত হয়েছে শেভরনের কাছে। এরা কেউই মাগুরছড়ার ধ্বংসকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ এখন পর্যন্ত দেয়নি।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার, পরে বিএনপি ও ফখরুদ্দীনের বেনামি সামরিক সরকার এবং এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন কোম্পানিগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। যদিও তারা এ দেশে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর ঘটে টেংরাটিলার গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা। ওই ক্ষেত্রের ইজারা কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর। তারাও বিরাট ক্ষতি বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ আজ পর্যন্ত দেয়নি।
এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, শুধু দেশীয় ক্রিমিনালদের জন্যই নয়, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ক্রিমিনালদের জন্যও বাংলাদেশ এক নিরাপদ অভয়ারণ্য।
এবার আসা যেতে পারে মেক্সিকো উপসাগরে গভীর সমুদ্র তলদেশ থেকে তেল উপচে পড়তে থাকার দুর্ঘটনা বিষয়ে। এ দুর্ঘটনায় বিপুল পরিমাণ তেল গত দু'মাস ধরে বিরামহীনভাবে মেক্সিকো উপসাগরে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এর দ্বারা মেক্সিকোর উপকূল ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত তিনটি রাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করার প্রতিজ্ঞা করে তাদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। হোয়াইট হাউসে বসে এ আলোচনার পর ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম মার্কিন সরকারকে ২০০ বিলিয়ন অর্থাৎ দুই হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়েছে।
এরপর বিপি চেয়ারম্যানকে মার্কিন কংগ্রেসের কমিটির সামনেও হাজিরা দিয়ে তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের পক্ষ থেকে ২০ জুন বলা হয়েছে, ইতিমধ্যেই তারা ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি অনুযায়ী গত সাত দিনে ৩১ হাজার চেক ইস্যু করে ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার তাদের প্রদান করেছে। তারা এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের দাবি সংবলিত চিঠি পেয়েছে ৬৪ হাজার লোকের থেকে। তাদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুর্ঘটনার পর বেশ অল্পদিনের মধ্যে তারা ব্রিটিশ তেল কোম্পানিকে বাধ্য করেছে সরকারকে বড় রকম ক্ষতিপূরণ দিতে এবং সেই সঙ্গে ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজারের ওপর মার্কিন নাগরিককে পৃথকভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে।
কিন্তু ভূপালে মার্কিন কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইডের গ্যাস প্ল্যান্ট দুর্ঘটনায় দুই লাখের ওপর লোক নিহত এবং আরও বহু লাখ লোক আহত হলেও তাদের জন্য ভারত সরকার ইউনিয়ন কার্বাইডের থেকে ৪৭ কোটি ডলার নিয়েই বিষয়টির নিষ্পত্তি করেছিল আদালতের বাইরে! তাছাড়া ওবামা যেখানে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের চেয়ারম্যানকে বাধ্য করেছিলেন হোয়াইট হাউসে এসে তার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিতে এবং মার্কিন কংগ্রেসও তাকে তাদের কমিটির সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য করেছে, তেমন কিছুই ভারতে হয়নি। উপরন্তু ইয়ং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ইউনিয়ন কার্বাইডের ক্রিমিনাল শীর্ষ কর্মকর্তা ওয়ারেন এন্ডারসনকে দ্রুত ও সসম্মানে ভারত থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। এর জন্য পার্লামেন্টসহ অন্য কারও কাছে রাজীব গান্ধীকে জবাবদিহি করতে হয়নি! এই হচ্ছে দুনিয়ার সব থেকে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের অবস্থা। তাদের সুপ্রিম কোর্ট, প্রশাসন, পার্লামেন্ট সবকিছু একই কাতারে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিটিকে রেহাই দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের কাছে ভারত রাষ্ট্রের নতজানু অবস্থা ছাড়া একে আর কী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে? বাংলাদেশেরও সেই একই অবস্থা।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, অন্য দেশে তাদের কোম্পানিগুলো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ধ্বংসকাণ্ড করলেও সেখানে তার জন্য তাদের যাতে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে না হয়, এজন্য তারা তাদের মক্কেল রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলো অন্য দেশের জনগণের প্রভূত ক্ষতিসাধন করলেও তাদের কিছু হয় না। কিন্তু সেই একই দুর্ঘটনা কোনো বিদেশি কোম্পানি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটায়, তাহলে তাদের দ্রুত বাধ্য করা হয় ক্ষতিপূরণ দিতে। এমনকি তারা যদি তাদের কোনো ভ্রাতৃপ্রতিম সাম্রাজ্যবাদী দেশের কোম্পানি হয়, তা হলেও। ঘরে-বাইরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই দু'মুখো নীতি প্রমাণ করে বিশ্বজুড়ে তারা দুর্বল দেশগুলোকে নিজেদের মক্কেল বানিয়ে কীভাবে সেসব দেশের জনগণের ওপর নির্যাতন এবং তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।
মুনাফার ক্ষেত্রে কোনো মানবিক বিবেচনাই যে তাদের ক্ষেত্রে কাজ করে না, তাদের এই নীতি ও কার্যকলাপের মধ্যে তার প্রমাণই নিহিত থাকে।
[সূত্রঃ সমকাল, ২২/০৬/১০]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।