খেলা নিয়ে স্যাট্যায়ার লেখায় আমার উৎসাহ। মুখে স্মিত হাসি নিয়ে চারিদিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। অনেকদিন পর তার মনটা আবার খুশিতে ভরে উঠলো। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে।
তার দলের লোকেদের পদচারনায় মুখর হয়ে উঠেছে আজ পুরো ঢাকা।
ঢাকার অলিতে-গলিতে তাদের বিচরন ক্রমেই বাড়ছে। রাজপথ আজকে কাঁপছে-তার লোকেদের পদভারে,স্লোগানের কম্পনে নাকি অস্ত্রের আঘাতে;তা তিনি জানেন না। জানতেও চান না। এতদিনের স্বপ্নপুরনের সময়ে তিনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
সামনে এগোতে থাকলেন ধীরে ধীরে।
নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে তার। ঢাকার দূষিত বাতাস আজকে আরও দূষিত হয়ে গেছে। ঢাকার বাতাসে আজ বারুদের গন্ধ। চারপাশের বাড়ি-ঘরে লেগে থাকা আগুন যেন কার্বন নিঃসরণের পুরো দায়ভার নিজের কাঁধে নেবার পাঁয়তারায় মগ্ন। মানুষের আর রাস্তার কুকুরের গলিত লাশ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত-কে বেশী দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে তা নিয়ে।
শীর্ণ মানুষগুলো এতোটুকু শরীর নিয়েও এগিয়ে আছে। বেঁচে থাকলে কুকুরগুলো পরাজয়ের লজ্জায়ও মারা জেতো। তবে তিনি চিন্তিত নন;ভাবছেন-“আমাদের সরকার ক্ষমতায় গেলে পরিবেশের প্রভূত উন্নতি করবে। যেমনটা করেছিলাম ২০০১-২০০৬ এ। “ ‘আমরা??’-একটু ভ্রু কুঞ্চিত হল তার।
তিনি তো ওই সময়ে সরকারে ছিলেন না। কিন্তু এবার তিনি সরকারে থাকবেনই। ম্যাডাম তার কর্মে সন্তুষ্ট। শুধু কথার জোরে একটা সরকারের পতন ঘটানো চাট্টিখানি কথা না। সেই ঘটনাই তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন।
চিন্তা করতে করতে আত্মশ্লাঘায় ভরে উঠলো মির্জা সাহেবের মন।
হাঁটতে হাঁটতে যে কখন চলে এসেছেন টিএসসি তে তা খেয়াল করেননি মির্জা সাহেব। পুরো টিএসসি দখল করে ফেলেছে তার ছাত্রদল। তার দলের বিরোধী যাকেই দেখছে বাঁশ,চাপাতি,রড,রামদা,চাকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। “মার শালাদের।
এতদিন কম মার খাই নাই। “ আনমনেই বলে উঠলেন মির্জা সাহেব। বলেই চারদিকে তাকালেন। আশেপাশে কেউ শুনলো নাতো!!তিনি কয়েকদিন পরেই দেশের মন্ত্রী হবেন। এখন পাবলিক এসব শুনলে তো হাসবে!!!ভাবার সময় হঠাৎ কাঁধে ব্যাথা করে উঠলো তার।
গত বছরের মিছিলে পুলিশের লাঠির বাড়ির ব্যাথা তার আজো যায় নাই।
সামনেই দেখলেন তার দলের সমর্থকেরা আগুন লাগিয়ে দিলো কয়েকটা ছাত্রের গায়ে। কিছুক্ষণ ছটফটানোর পর আস্তে আস্তে নেতিয়ে গেলো কয়েকটা। ২-৩ টা তখনও চিৎকার করছিলো। কিন্তু ওদিকে তাকানোর সময় তখন মির্জা সাহেবের কর্মীদের নেই।
পাশেই কয়েকটা গাড়ী ছিল,ওগুলোতে আগুন লাগানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। এতো কেরোসিনতো অপচয় করা যায়না!!দলের তরুণদের এতো অগ্রসর চিন্তা দেখে পুলকিত হলেন তিনি। এরাই তো দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। তাদের বুদ্ধি দেখে তার মুখ গাড়ির জ্বলন্ত আগুনের থেকেও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “দল ভালই রাম-রাজত্ব চালাচ্ছে এই এলাকায়”-একথা মনে উঠলেও সাথে সাথে বাক্যটা এক্সপাঞ্জ করে ফেললেন তিনি।
রাম বলা যাবে না। ‘বড় হুজুররা’ খেপতে পারেন। তাদের অবদান এই আন্দোলনে কম নয়। তারা এই “পার্শ্ববর্তী দেশ” এর শব্দ এই দেশে বরদাশত করবেন না। সরকারে গেলেই এই জাতীয় শব্দ অর্ডিন্যান্স করে বাতিল করবেন বলে মনঃস্থির করেন তিনি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও অনেক অর্ডিন্যান্স করেছেন। তারাও করবেন।
একটু পরেই চলে এলেন শেরে বাংলা নগরে। নজরুল এভিনিউ ধরে এগোতে লাগলেন তিনি। দূর থেকেই দেখতে পারলেন পিন্টুকে।
তার দলবল নিয়ে এমপি হোস্টেলের রুম দখলে ব্যস্ত সে। “বদ অভ্যাস এখনও যায়নাই!”আনমনে গজড়াতে থাকলেন মির্জা সাহেব। পুরো দেশ যেখানে পরে আছে,সেখানে সে চলেছে এমপি হোস্টেল দখল করতে!আরে ওটাতো এমনিতেই হবে। তার দলের ৩০০ জন সদস্য আর ৫০ জন সংরক্ষিত নারী নামের লেডি কমান্ডোর পদচারনায় কয়েকদিনের মধ্যেই মুখরিত হয়ে উঠবে এই চত্বর। ৩০০;শুনতেই কেমন যেন লাগছে তার।
হলিউডের “300” ছবিটার মতো মনে পড়ল কারন ছাড়াই। বুকটা টান টান করে মির্জা সাহেব হাঁটতে থাকলেন। নিজেকে ওই ছবির দাড়িওয়ালা নায়কের মতো লাগছে তার। শুধু দাড়িটাই নেই। ওটা এখন থেকে লাগবে।
‘বড় হুজুররা’ দাড়ি রাখেন। তিনিও এখন থেকে রাখবেন। যদিও তিনি বা ‘বড় হুজুররা’ কেউই নামাজী নন।
আর রোজার মাসে দৈনিক ৩ বেলা ইফতার করা হয়। রাজনীতিবিদ মানুষ-প্রতিদিন ৩-৪ টা ইফতার পার্টি থাকেই।
ওগুলোতে উপস্থিত থাকা লাগে। শেরাটনে হলে তো কথাই নেই। ইফতারের পর আসলেই ‘পার্টি’ হয় ওখানে। ওখানকার লাল পানির স্বাদ দুই দলের নেতাদেরই পছন্দের। একেবারে সেহেরী করেই বাসায় ফিরতে পারেন তারা।
জিয়া পার্কের লেক ধরে এগোতে থাকলেন তিনি। দলের কর্মীরা এখানেও আছে। আগে এখানে প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি বসে থাকতো। আজেবাজে কাজ করতো। এখন থেকে এসব পশ্চিমা কাজকারবার এই পার্কে হবে না।
তারা প্রতিদিন রুটিন করে এখানে মাজার পূজা করতে আসবেন। সেই সময় এসব আকাম দেখলে তাদের আধ্যাত্মিক মনোযোগ নষ্ট হবে। এসবের জন্য শহীদ মিনার আছে। “আছে তো?”নিজেকেই প্রশ্ন করলেন মির্জা সাহেব। তার জানা মতে বড় হুজুররা ভোর রাতেই বের হয়েছিলো শহীদ মিনার ভাঙ্গতে।
সাভারের স্মৃতিসৌধ ও আস্ত রাখার কথা না। তার জন্য ভালই হয়েছে। মন্ত্রী হলে আর কষ্ট করে বছরে দুইবার ফুল দেওয়া লাগবে না।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বর্তমান অবস্থার কথা মির্জা সাহেব কল্পনা করতে থাকেন। এতক্ষনে নিশ্চয়ই একজন “মহান ভাষা সৈনিক” মুক্ত হয়ে গেছেন।
তার দলের বাকি নব্য সৈন্যরা তাকে নিয়ে বিজয় মিছিলও সম্ভবত করছে। তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন কোরবানির গরুর মতো মালা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। পাশে মুক্ত হওয়া বড় হুজুরের আরও অনুসারীও আছে। ক্রমাগত জাতির পিতাকে আর তার দলকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের চিৎকারে পুরান ঢাকার নড়বড়ে দালানগুলো ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে।
মির্জা সাহেব নিজেও তার বুকে সেই কম্পন অনুভব করছেন।
অবশেষে নিজের দলের কার্যালয় আসতে পারলেন তিনি। কিছু অতি উৎসাহী কর্মী এখানেও টায়ার জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওই জ্বলন্ত টায়ার টপকাতে টপকাতে ছাগলগুলার মা বাপের গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকেন মির্জা সাহেব। কার্যালয়ে ঢুকতেই দেখতে পেলেন তার দলের পাতি নেতাদের।
সবাই বিজয়ল্লাসে মেতে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর সাংবাদিক দেখলেই এগিয়ে গিয়ে নিজ দলের নেতা কর্মীর উপর গুলি বর্ষণের জন্য সরকারের মুন্ডুপাত করে যাচ্ছে। মির্জা সাহেব মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন উপরের তলায়। ওখানে তার দলের হাই কমান্ডের বৈঠক চলছে। নিজের জন্য ভালো একটা পোস্ট বাগাতে হবে যেভাবেই হোক।
তিনি হবেন বড় মন্ত্রী। সাংবাদিকরা তার কাছে ছুটে আসবে মুখ থেকে ২-৪ টি লাইন শুনার জন্য। পুলিশ থাকবে আগে পিছে। তাদের মাঝেই বুক চিতিয়ে হাঁটবেন। আর জনগনের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করবেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই হঠাৎ করে শরীরের নিচে ভেজা ভেজা অনুভব করলেন। তাকিয়ে দেখলেন এতক্ষন তিনি একটা লুঙ্গি পরে ছিলেন। লুঙ্গির গিঁটের কাছাকাছি অনেকটুকু অংশ ভেজা। তারপরেই তার মোবাইল বেজে উঠলো।
মোবাইল ধরার জন্য হাত বাড়াতেই খেয়াল করলেন মির্জা সাহেব;তিনি তার ঘরে শুয়ে আছেন।
কোল বালিশটা তার দুই পায়ের চিপায় অবস্থান নিয়েছে। খাটের বেড শিটও আগোছালো হয়ে আছে। কিন্তু তার লুঙ্গিতে ঠিকই পানি লেগে আছে। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে শুয়ে থাকলেন তিনি। এরপর বুঝলেন পুরো ঘটনা।
এই বয়সেও স্বপ্নদোষে আক্রান্ত হয়েছেন। তারই প্রমান তার ভেজা লুঙ্গি। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে পারেননি।
তাড়াতাড়ি লুঙ্গি পালটে টিভির সামনে বসলেন তিনি। গতকাল অনেক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মির্জা সাহেব।
মহাসমাবেশে সরকারের বাধার কথা বলতে বলতে নিজের মুখের ফেনা তুলে ফেলেছিলেন। পিন্ডি চটকেছিলেন সরকারি দলের। নিজের দলের কর্মীদের দুর্দশার কথা বলে কুম্ভীরাশ্রুও বিসর্জন দিয়েছেন। শহিদুল ইসলাম প্রধানের ওই মজার কথাও আবার শোনা দরকার। হতাশ মনে টিভি দেখতে বসলেন তিনি।
ওগুলো আজকে ভালো করে দেখবেন। তাহলে হয়তোবা মন্ত্রিত্ব পাওয়ার “ভেজা স্বপ্ন” ভুলতে পারবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।