আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিষয়গুলো ভাবতে হবে সবারই

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরি সিরাজুর রহমান ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বাংলাদেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো অর্থহীন, মূল্যহীন কথা বলবেন, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দেবেন- সেটা আগে আশা করা যায়নি। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়ই অসত্য কথা বলেন। দেশে যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন হচ্ছে সেটা তিনি অস্বীকার করে চলেছেন। তিনি বরাবরই দাবি করেন তার আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। সাধারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে অপমান করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেননা দেশের মানুষ দেখছে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অন্তত দশ গুণ বেশি।

গত শুক্রবার রাতে সাংবাদিক মেহেরুন রুনি ও তার স্বামী সাগর সরওয়ারের মর্মান্তিক হত্যা বর্তমান বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি নাটকীয়ভাবে তুলে ধরেছে। এ উপলক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। এ রকম সময়সীমা তিনি আগেও বহুবার দিয়েছেন কিন্তু সেসব সময়সীমা রক্ষিত হয়েছে কি না খতিয়ে দেখার তাগিদ তিনি অনুভব করেননি। পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সময়সীমা কিংবা হুমকি-ধমকিকে বিশেষ আমল দেয় বলে দেশের মানুষ মনে করে না। অবশ্যি সম্পূর্ণ দলীয়কৃত পুলিশকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই।

এ সরকার পুলিশকে প্রায় সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে রাজনৈতিক বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে টুঁটি টিপে মারতে। তা ছাড়া এ সরকারের আমলে বেশির ভাগ দুষ্কৃতি আর অপরাধ করছে আওয়ামী লীগের ভেতরের লোকেরা। তাদের গায়ে হাত দেয়ার সাহস সব সময় পুলিশের হয় না। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার চিদাম্বরম সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে উপলক্ষে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আর গুলি চালাবে না।

স্মরণীয় যে তার কিছুকাল আগেই বিএসএফ কিশোরী ফালানীকে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তা-ই নয়, তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। অবশ্যি গত তিন বছরে বাংলাদেশী হত্যা বিএসএফের জন্য নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০০ বাংলাদেশী বিএসএফের গুলিতে হতাহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ ভারতীয় অন্যান্য কর্মকর্তাও দফায় দফায় আশ্বাস দিয়েছেন যে বিএসএফ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না।

কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই হত্যাসহ বিএসএফের বাড়াবাড়ির খবরাদি প্রকাশিত হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি বিএসএফকে বলেছে ‘ট্রিগারহ্যাপি ফোর্স’। এখন আবার বিএসএফের মহাপরিচালক ইউ কে বনসাল সরাসরি বলে দিয়েছেন যে তার বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করবে না। প্রমাণ হলো যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস কিংবা প্রতিশ্রুতি আন্তরিক নয় এবং বিএসএফ দিল্লির সরকারের নির্দেশকে গ্রাহ্য করে না। জেনারেল বনসালের অজুহাত, বাংলাদেশ সীমান্তে কিছু বদলোক আছে।

যেকোনো দেশেই হোক অবৈধ প্রবেশকারীরা সব সময় আদর্শ চরিত্রের লোক হয় না। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও প্রতি বছর লাখে লাখে মানুষ অবৈধভাবে প্রবেশ করে। তাদের বেশির ভাগই আসে জীবিকার সন্ধানে। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ থেকেও বহু মাদক চোরাচালানি, সন্ত্রাসী ইত্যাদি প্রকৃতির অবৈধ বহিরাগত আসে। বিমানবন্দরে কিংবা সীমান্ত এলাকায় অনেকে ধরা পড়ে।

সীমান্ত দিয়ে যারা ফসকে আসে তাদের অনেকে পরে ধরা পড়ে। সাধারণত এদের আদালতে হাজির করা হয় এবং আদালতের নির্দেশ পেলে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। হিথরো বিমানবন্দরে কিংবা ডোভার সমুদ্রবন্দরে সীমান্তরক্ষী বাহিনী কোনো অনুপ্রবেশকারীকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে বিগত ৫২ বছরে আমি শুনিনি। আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা স্পষ্টতই জেনারেল বনসাল আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা করে তার নিজের আইন প্রয়োগ করছেন। এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে কিছু অনুপ্রবেশ ঘটে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক কারণে কিছু লোক সাময়িক কর্মসংস্থানের সন্ধানে পাশের দেশে যেতে চায়- যেমন উপমহাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক ইউরো-আমেরিকার দেশগুলোতে যাচ্ছে। এর পেছনে ভারতেরও বিরাট ভূমিকা আছে। ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানি বন্ধ করে দিচ্ছে। নইলে বাংলাদেশের উর্বর জমিতে আরো ভালো ফলন হতো, ধান কাটতে লোকে প্রাণ হাতে নিয়ে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করত না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনবসতি ভারতের যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি ঘন।

তার ওপরও প্রায় তিন লাখ ভারতীয় অবৈধভাবে শুধু বৃহত্তর ঢাকা ও চট্টগ্রামেই চাকরি করছে। বাংলাদেশে ব্যাপক অভিযোগ আছে যে ভারতীয়রা বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে অনুপ্রবেশ করে এ শিল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে, যাতে এই লাভজনক রফতানিবাণিজ্য ভারতের হাতে চলে যেতে পারে। ভারতের ‘ডাম্পিংয়ের’ কারণে বাংলাদেশে বহু শিল্প টিকে থাকতে এবং গড়ে উঠতে পারছে না, এ দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বাংলাদেশের মাৎস্যজীবীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে ভারতীয় জেলেরা আমাদের সমুদ্রসীমার ভেতরে এসে মাছ ধরছে এবং আমাদের জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে কর্মসংস্থান হচ্ছে না, এ দেশের মানুষ যে লাখে লাখে মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপে-আমেরিকায় শ্রম বিক্রি করতে ছুটছে, এই হচ্ছে তার কারণ।

অস্থায়ী কর্মসংস্থানের আশায় যেসব ভাগ্যহত বেপরোয়া মানুষ বিদ্যুৎ-সঞ্চালিত দুই স্তর কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ভারতে যেতে চায় তারাও সমগোত্রীয়। ভারতীয় অভিধানে বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার অর্থ হচ্ছে নির্জলা শোষণ। সীমান্তে যে কিছু চোরাচালানি আছে সেটাও অনস্বীকার্য। কিন্তু সেটা একতরফা নয়, দ্বিপক্ষীয়। অসাধু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা শাড়ি ইত্যাদি জামাকাপড় এবং বহু শিল্পোৎপাদন বাংলাদেশে অবৈধভাবে চালান করতে চায়, ভারতে গোমাংশ নিষিদ্ধ বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গরু তারা বাংলাদেশে পাঠাতে চায়, আর বাংলাদেশে চোরাচালানির জন্য সীমান্তের লাগোয়া তারা ফেনসিডিল প্রভৃতি নিষিদ্ধ মাদকের বহু কারখানা গড়ে তুলেছে।

বাংলাদেশের কর্মহীন দরিদ্র লোকদের জন্য সেটা লোভনীয় আমন্ত্রণ। অনৈতিক হলেও সেটা অপ্রত্যাশিত কিংবা অস্বাভাবিক নয়। সে জন্য বাংলাদেশীদের চড়-ইপাখির মতো গুলি করে মারা শুধু অন্যায়ই নয়, অমানবিক। চুক্তি অমান্য ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ তা ছাড়া মুখে বন্ধুত্বের ফুলঝুরি ছোটালেও ভারতীয় নেতাদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া রীতিমতো দুঃখজনক। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালুর অনুমতি দিয়েছিলেন।

কিন্তু ভারত সেটাকে পাকা বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। সে বছরই মুজিব ছিটমহল বিনিময় এবং কিছু জমি বিনিময় করে সীমান্ত সহজ ও স্বাভাবিক করার জন্য ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি সংবিধান সংশোধন করে বেরুবাড়ি ছিটমহলটি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত ৩৭ বছর পরেও চুক্তির তার দিকটা পালন করেনি। শেখ হাসিনা বড়াই করেন যে ১৯৯৬ সালে তিনি ফারাক্কায় পানিবণ্টনের চুক্তি করেছিলেন ভারতের সাথে।

কিন্তু সে চুক্তি অনুযায়ী কোনো বছরেই নির্ধারিত পরিমাণ পানি বাংলাদেশ পায়নি। এমন চুক্তি শুধু অর্থহীন নয়, রীতিমতো অপমানকর। গত বছর শেখ হাসিনার সরকার ঢাকঢোল পিটিয়েছিল এই বলে যে মনমোহন সিং ঢাকায় এসে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করবেন। মহমোহন ৬ সেপ্টেম্বর এসেছিলেন এবং ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লির দরবারের মতো সংবর্ধনা নিয়ে ৭ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন। সে চুক্তি আজো হয়নি।

তিস্তার পানি ভাগের চুক্তির জন্য বাংলাদেশ এখন দেনদরবার করছে কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির দরবারে। এর পরে হয়তো পশ্চিম দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরবার করতে যাবেন দীপুমণি। অন্তত বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে ভারত পাত্তা দিচ্ছে না। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির এই হচ্ছে করুণ চিত্র। তা ছাড়া প্রশ্ন উঠতে পারে : ভারত কি আদপেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করছে? কেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

বিএসএফের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বিএসএফের বাড়াবাড়ি ইদানীং সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের আশ্রয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশের জমি দখল করছে, ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে এসেই আমাদের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের হত্যা ও নির্যাতন করছে, এমনকি উলঙ্গ করেও তাদের মারধর করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অকর্মণ্য বর্ডার গার্ড ফোর্স (বিজিএফ) নীরব দর্শকের মতোই এসব অন্যায় দেখে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। অনেকের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠছে, বিডিআর বেঁচে থাকলে বিএসএফ কি এ ধরনের অবৈধ, অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে পারত? কেউ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে বিএসএফের বাড়াবাড়িগুলোর বিরুদ্ধে বিডিআর সব সময় রুখে দাঁড়িয়েছে।

১৯৯৭ সালের এক বিখ্যাত ঘটনায় বিএসএফের লোকেরা কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ীতে বাংলাদেশের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে পড়েছিল এবং বিডিআরের বীর জওয়ানেরা তাদের ধরে ফেলেছিলেন। বিডিআরের ওপর ১৯৭১ সালেও ভারত সরকার খুশি ছিল মনে হয় না। আশ্রিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সাথে সে বছর ভারত সাত দফা চুক্তি করেছিল। সে চুক্তির তিনটি শর্ত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একটা শর্তে বলা হয়েছিল যে ‘বিএসএফের তত্ত্বাবধানে’ স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য একটা ‘বর্ডার গার্ড’ বাহিনী গঠন করা হবে।

অর্থাৎ বিডিআর ভেঙে দেয়ার কথা ১৯৭১ সালেই দিল্লিতে চিন্তা করা হচ্ছিল। সে জন্যই তিন বছর আগে, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে বহু প্রশ্নের জবাব এখনো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেই মনে হয়। সে বিদ্রোহের আগের কয়েক দিন আওয়ামী লীগের কয়েকজন ‘ইয়ং টার্ক’ খুবই তৎপর ছিলেন বলে তখনো মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। এঁরা মুঠোফোনে বিডিআরের কিছু জওয়ানের সাথে ঘন ঘন কথাবার্তা বলছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীদের নেতারা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেন এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা’ করেন।

সে দিন বিকেলে এই ‘ইয়ং টার্করা’ বিডিআর সদর দফতরে যান এবং বিদ্রোহীদের সাথে অজ্ঞাত বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করেন। সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও সেখানে গিয়েছিলেন। মিডিয়ার খবরাদি অনুযায়ী তিনি বিডিআর সদর দফতরে উপস্থিত থাকার সময়ই নতুন করে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। তা ছাড়া সে দিন বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী বিডিআরের দিকে এগিয়ে আসছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের পথেই থামিয়ে দেয়া হয়। সে বিদ্রোহে নিহত মোট ৭৪ জনের মধ্যে সেনাবাহিনীর মাঝারি ও শীর্ষপর্যায়ের ৫৭ জন অফিসার ছিলেন।

সেনাবাহিনীকে নিজেদের মতো ব্যবস্থা নিতে দেয়া হলে এঁদের অনেকে হয়তো রক্ষা পেতেন। বিদ্রোহের তদন্তের সমন্বয়ের ভার দেয়া হয় তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব ফারুক খানকে। তিনি সকাল-সন্ধ্যা সংবাদ সম্মেলন করে পরষ্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিক এবং বিরোধী দলগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। তখনো কেউ কেউ বলেছিলেন যে বিভ্রান্তি ও ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন অসম্ভব করে তোলাই বাণিজ্যমন্ত্রীর উল্টোপাল্টা বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল। বিডিআর বিদ্রোহের আসল রহস্য কী? বেশ কিছুকাল থেকেই বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হচ্ছে।

শত শত জওয়ানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, কাউকে কাউকে ইতোমধ্যে কঠোর দণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিচার যে সম্পূর্ণ ও ব্যাপক সে কথা কেউ বলছেন না। তাদের মতে, ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো সম্বন্ধে তদন্ত করা হলে সে বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ ও প্রকৃত হোতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। সেটা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ দিকে ঐতিহ্যবাহী এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি বিডিআরকে ভেঙে দেয়া হয়েছে।

তাদের স্থলে একটি অকর্মণ্য বিজিবি গঠন করা হয়েছে। এভাবে ১৯৭১ সালের সাত দফা দিল্লি চুক্তির একটা শর্ত পূরণ করা হলো। সেই চুক্তির আরো দুটো শর্তে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের নিজের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না, ভারত তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে এবং স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতিও থাকবে না বাংলাদেশের। সে দু’টি শর্ত পূরণেরও কি চেষ্টা হচ্ছে? তিস্তা চুক্তি সম্বন্ধে দীপুমণি এখন দিল্লির পরিবর্তে কলকাতার সাথে দেনদরবার করছেন আর বিডিআর বিদ্রোহের পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী কী অবস্থায় আছে সে সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ কোনো ধারণা পাচ্ছে না। বিদ্রোহের পরে পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনা সদর দফতরে গিয়ে অফিসার শ্রেণীর সাথে সম্মেলন করেছিলেন।

মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল যে মাঝারি স্তরের কিছু অফিসার বিডিআর বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তার পর থেকে জেনারেলদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আলোকচিত্র ছাড়া সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব যেন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। ঊনবিংশ শতকের আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে একটা রসিকতা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। সেটা হচ্ছে : ‘ঠু মেনি চিফস বাট নো ইন্ডিয়ানস’। অর্থাৎ সর্দার বেশি, অনুসারীর অভাব।

অতি সম্প্রতি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অধিকর্তা অস্বাভাবিক ও বিস্ময়করভাবে সংবাদ সম্মেলন করে একটা লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তার বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনীর মাঝারি ও শীর্ষস্তরের কয়েকজন ‘ধর্মান্ধ’ অফিসার ও বাইরের কয়েকজন ‘ধর্মান্ধ’ লোক শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার চক্রান্ত করছিলেন। এ অভিযোগের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে বহু মহলে প্রশ্ন উঠেছে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নিযুক্ত ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পরিষ্কার বলে দেন যে ১৯৭১ সালের সাত দফা দিল্লি চুক্তি তিনি মানেন না।

তার ফলেই মিসেস গান্ধী ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিতে রাজি হন। কেউ কেউ সে সময় আমাকে বলেছেন দিল্লি চুক্তিকে সই করেছিলেন বলেই মুজিব তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। ওপরে উল্লিখিত বিষয়াবলি দৃষ্টে এ সন্দেহ করা কি অসঙ্গত হবে যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লিতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একাত্তরের সাত দফা চুক্তি মেনে নিতে রাজি হয়ে এসেছিলেন? সে চুক্তির লাশ কি আবার কবর থেকে তুলে আনা হয়েছে? অন্যথায় ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাংলাদেশের অসহায় কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। হয়তো সে জন্যই শেখ হাসিনার সফরে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সরকার এত উদ্বিগ্ন। [সূত্র : নয়া দিগন্ত-১৭/০২/২০১২] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.