আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"কাব্য সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি"

জাহেলি যুগে কাব্য ও তার বিষয়বস্তু ইসলামের আবির্ভাবকালে আরব সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল গণ্ডমূর্খ, অশিক্ষিত ও বর্বর । সুতরাং তৎকালীন আরবি সাহিত্য ছিল লোকজ সাহিত্য । আর সেই লোকজ সাহিত্যকথা এতোই উন্নত ছিল যে , তা হোমারের ইলিওড ও ওডেসীকে হার মানাবার উপযোগী । তবে তখন কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল প্রেমলীলা, মদ্যপান, জুয়াখেলা, বংশগৌরবগাঁথা, যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি উস্কানির মত এমন কিছু বিষয়, যা একটি সভ্য সমাজের জন্য কোনমতেই শোভনীয় নয় । ইমরুল কায়েসের মত কবির কবিতার বিষয়বস্তু ছিল নারী ও ঘোড়া ।

কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে রণগীতি, প্রেমগীতি, রঙ্গব্যঙ্গাত্মক কবিতা আবৃত্তি করে বহু কুখ্যাত ও বিখ্যাত কবিগণ যশ কামাত, যা তৎকালীন সকল কাব্যকলাকে ছেড়ে গিয়েছিল । যদিও তা বল্গাহীন জৈবানুভূতির যৌনরসে উৎসারিত আদিম পাশবিক উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিল । আল কোরআনে কবিতার প্রতি বিরূপ মনোভাব ও তার কারণ স্বাভাবিক ভাবেই কবিগণ কবিতা রচনার ক্ষেত্রে অলীক কল্পনা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তারা কারো প্রশংসা ও কুৎসা রটনার ক্ষেত্রে সত্য ও বাস্তবতার সীমা লঙ্ঘন করে থাকে । আরবরা কবিদেরকে গণক মনে করত ।

তাদের ধারণা ছিল, কবিগণ জ্বীনদের মাধ্যমে অদৃশ্যের খবর সম্পর্কে অবগত হন । তাই তারা রাজা-বাদশাহদের নির্দেশের চেয়েও কবিদের নির্দেশকে বেশী গুরুত্ব দিত । আল্লাহ্‌ তায়ালা মহানবী (সাঃ) কে ঐশী বাণী প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করলে মক্কার কাফের সম্প্রদায় মহানবী (সাঃ) এর প্রচারিত বাণীকে ঐশী বাণী হিসাবে মানতে অস্বীকৃতি জানায় । তারা তাঁকে কবি, গণক ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে এবং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কুৎসা ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করতে থাকে । কবিতা রচনায় তাদের কুরুচীপূর্ণ বিষয়বস্তু ও ইসলামকে নিয়ে কুৎসা রটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্‌ তায়ালা কাব্য চর্চাকে মন্দ কাজ আখ্যায়িত করে তার প্রতি নিরুৎসাহিত করেছেন ।

তন্মধ্যে প্রণিধানযোগ্য আয়াত হলঃ والشعراء يتبعهم الغا ون ، ألم تر أنهم في كل وادٍ يهيمون وأنهم يقولون ما لا يفعلون (الشعراء-224-226) “এবং কবিদের অনুসরণ করে তারা, যারা বিভ্রান্ত । তুমি কি দেখনা, ওরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় ? এবং তারা যা করে না তা বলে । “ অন্যত্র বলা হয়েছেঃ وما علمناه الشعر وما ينبغي له يس-69 “ আমি তাঁকে (রাসুলকে) কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং এটা তাঁর পক্ষে শোভনীয় নয়। “ ইমাম রাগেব আল ইস্ফাহানী তাঁর আল-মুফরাদাত গ্রন্থে বলেছেনঃ ولكون الشعر مقر الكذب - قيل حسن الشعر أكذبه অর্থাৎ (কোরআনে কবি ও কবিতাকে মন্দ বলা হয়েছে ) এজন্য যে, কবিতা মিথ্যার ঘাটি। বলা হয়েছে যে, সর্বাধিক উত্তম কবিতা সেটিই, যা সর্বাধিক মিথ্যা ।

তবে এসব মন্তব্য ঢালাওভাবে সকল কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । বরং এটা শুধু উপরিউক্ত দোষসমূহে দুষ্ট এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) কে পীড়া দিয়েছে কেবলমাত্র তারই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য , তারই সমালোচনা করা হয়েছে এখানে । সত্যভাষণ সম্বলিত এবং সৎকাজে উদ্বুদ্ধকারী কবিতা নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় নয় বরং প্রশংসনীয় । যেমন প্রথমোক্ত আয়াতের শেষাংশে এ ভ্রান্তির অপনোদন করে আসল কথা বলা হয়েছে যে, إلا الذين أمنوا وعملوا الصالحات و ذكروا الله كثيراً وإنتصروا من بعد ما ظلموا “কিন্তু তারা ছাড়া, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে বার বার স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হবার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। “ বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন ইবনে রাশীক তাঁর ‘উমদা গ্রন্থে।

তিনি বলেন, প্রথম আয়াতে নিন্দাবাদ করা হয়েছে মুশরিক কবিদের, যারা রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করত এবং ইসলামের বিরোধিতা করত। আর আয়াতের শেষে إلا الذين أمنوا থেকে রাসুল (সাঃ) এর কবি হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ)এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, এরা কুরায়েশদের কাছে তীর নিক্ষেপের চেয়েও অধিকতর ভয়ঙ্কর। কথিত আছে যে, আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) কাঁদতে কাঁদতে রাসুল (সাঃ)এর খিদমতে হাজির হয়ে বল্লেন,ইয়া রাসুল্লাহ (সাঃ) কবিদের সম্মন্ধে এই আয়াত নাযিল হয়েছে আর আমরা কবি। রাসুল (সাঃ) উত্তর দিলেন, সম্পূর্ণ আয়াত পড়।

ইমানদার নেককারদের বলা হয়নি। তখন তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস,আ ত ম মুসলেহ উদ্দিন। ) কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) এর মনোভাব কবিতা সম্পর্কে সাধারণ মনোভাব ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন যে, কবিতা তো একধরনের কথামালা। আর কথার মধ্যে যেগুলো উত্তম ও সুন্দর, কবিতার মধ্যেও সেগুলো উত্তম ও সুন্দর।

আর কথার মধ্যে যেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত, কবিতার মধ্যেও সেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত। ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর أدب المفرد গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে এ মর্মের একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে- قال رسول صلي الله عليه وسلم الشعر بمنزلة الكلام حسنه كحسن الكلام و قبيحه كقبيح الكلام অর্থাৎ “রাসুল (সাঃ) বলেন,কবিতা কথার মতই। ভাল কথা যেমন সুন্দর, ভাল কবিতাও তেমনি সুন্দর এবং মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতই মন্দ। “ ابن رشيق তাঁর ‘উমদা গ্রন্থে হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসুল (সাঃ) বলেন, إنما الشعر كلام مؤلف فما وافق الحق منه فهو حسن وما لم يوافق الحق منه فلا خير فيه “কবিতা সুসমঞ্জস্য কথামালা।

যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতা সুন্দর। আর যে কবিতায় সত্যের অপলাপ হয়েছে সে কবিতায় কোন মঙ্গল নেই। “ অপর এক হাদীসে আছেঃ قال رسول صلي الله عليه وسلم إنما الشعر كلام فمن الكلام خبيث و طيب অর্থাৎ “রাসুল (সাঃ) বলেন,কবিতা তো বাক্য। আর বাক্যের মধ্যে খারাপও থাকে, ভালোও থাকে। “ এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদিস হলঃ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক বেদুঈন রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে আলাপ করতে লাগল।

তার আলাপে বিমোহিত হয়ে রাসুল (সাঃ) বললেনঃ ( إن من البيان لسحرا وإن من الشعر لحكمة، (ابودود،ترمذي،بخاري অর্থাৎ “কোন কোন বর্ণনায় যাদু রয়েছে। আর কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকৃষ্ট জ্ঞানের কথা। “ এক বর্ণনায় আছে যে, আমর ইবনুল- আহতামের আলাপ যখন তাঁকে বিমোহিত করেছিল তখন উপরোক্ত উক্তি করার সাথে সাথে ছন্দবদ্ধভাবেও তিনি বলেছিলেনঃ لقد خشيت أن تكون ساحراً* رواية مراً ومراً شاعراً (আল ইকদুল ফারীদ) # রাসুল (সাঃ) মন্দ ও অশ্লীল কবিতার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন। তাই তা শুনতে ও আবৃত্তি করতে স্বভাবতই তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেনঃ لأن يمتلئ جوف أحدكم قيحاً حتي يريه خير له من أن يمتلئ شعراً “তোমাদের কারো পেটে (মন্দ) কবিতা থাকার চেয়ে সে পেটে পুঁজ জমে তা পচে যাওয়া অনেক উত্তম।

“ (বুখারী,মুসলিম,তিরমিযী, আবু দাউদ) হযরত আয়েশা (রাঃ) হাদীসটি শুনে বলেছিলেন, রাসুল (সাঃ) কবিতা দ্বারা ঐ সকল কবিতা বুঝিয়েছেন যাতে তাঁর কুৎসা বর্ণিত হয়েছে। ( জাবী জাদাহ ‘আলী ফাহমী, হুসনু’স সাহাবা) অপর এক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেন, من قال في الاسلا م هجاءً مقذعاً فلسانه هدر “যে ইসলাম সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক ও নিন্দামূলক কবিতা বলে তার জিহ্বা ধ্বংস হক। “ ابن رشيق তাঁর ‘উমদা গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, এখানে সেই ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যার অন্তরে কবিতা এমন ভাবে বদ্ধমূল হবে এবং কবিতায় সে এমন ভাবে মত্ত হয়ে যাবে, যার ফলে কবিতা তাকে দ্বীন থেকে গাফেল করে দিবে এবং আল্লাহ্‌র জিকির, নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখবে। আর এ ক্ষেত্রে শুধু কবিতাই নয় বরং যার ভূমিকা এ ধরণের তাই নিষিদ্ধ। আর যেসব কবিতার ভূমিকা এ ধরণের নয় বরং যা সাহিত্য, কৌতুক ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয় তাতে কোন দোষ নেই।

তাই দেখা যায়, খুলাফায়ে রাশিদীন, বহু উচ্চ পর্যায়ের সাহাবী, তাবেঈন ও ফকিহ ইমামগণ কবিতা আবৃত্তি করেছেন। # সচ্চরিত্রবান কবির উত্তম ও সুন্দর কবিতা শুনতে রাসুল (সাঃ) আনন্দবোধ করতেন। রাসুল (সাঃ) বহু কবিতা আগ্রহভরে শুনেছেন এবং আরো অধিক শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যথাঃ শারীদ আছ ছাকাফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি একদা রাসুল (সাঃ) এর পেছনে আরোহণ করেছিলাম। পথিমধ্যে রাসুল (সাঃ)বললেন, তোমার কি উমাইয়া ইবনে আবিস সালত এর কবিতা জানা আছে? আমি বললাম, হাঁ।

তিনি বললেন আবৃত্তি কর। আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করলে তিনি বললেন, আরো শুনাও। আর একটা আবৃত্তি করলে বললেন, আরো শুনাও। এমনি করে সেই দিন আমি একশটি কবিতা আবৃত্তি করলাম। (মুসলিম) এক বর্ণনায় এসেছে, কবিতা শুনে রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, এ ব্যক্তির জিহ্বা ঈমান এনেছে কিন্তু অন্তর কুফরী করেছে।

মু’আল্লাকার এক জন কবি লাবীদ ইবনে রাবী’আ যিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও একজন একত্ববাদী ও আদর্শবান কবি ছিলেন, যার প্রমাণ তাঁর কাব্যে পাওয়া যায়। যথা, এক আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর সকলই বিলীন হয়ে যাবার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেছেনঃ ألا كل شيء ما خلا الله باطل * و كل نعيمٍ لا محالة زائل “আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর সকল জিনিসই বাতিল এবং সকল নিয়ামত অবশ্যই একদিন বিলুপ্ত হবে। রাসুল (সাঃ) এ কবিতা শুনে বলেছিলেন, কবিরা যা কিছু বলেছেন তন্মধ্যে সর্বাধিক সত্য কথা হল লাবীদ যা বলেছেন। (আল ইসাবা,ইবনে হাজার আস্কালানী ) # রাসুল (সাঃ) কবিতা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি কবিদের জন্য দু’য়া করতেন ও তাঁদের পুরস্কৃত করতেন।

মক্কার মুশরিক কুরাইশদের পক্ষ থেকে আবু সুফিয়ান, আমর ইবনুল আ’স, আব্দুল্লাহ ইবনু’য যিবা’রা , দিরার ইবনুল খাত্তাব, আবু আযযা আল-জুমাহী, হুবাইরা ইবনে আবী ওয়াহাব আল-মাখজুমী প্রমুখ ইসলাম ও রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে কটাক্ষ করে কবিতা রচনা করতে শুরু করলে কবিতার মাধ্যমে তাদের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় । রাসুল (সাঃ) সাহাবীদেরকে সম্মোধন করে বলেনঃ ماذا يمنع الذين نصروا الله و رسوله بأسلحتهم ان ينصروه بالسنتهم অর্থাৎ “যারা হাতিয়ারের দ্বারা আল্লাহর রাসুলকে সাহায্য করছে, কথার (কবিতা) দ্বারা আল্লাহর সাহায্য করতে কিসে তাদেরকে নিষেধ করে ?” (ইবনে হিশাম,জুরজি যায়দান) তখন মুসলিম কবিদের মধ্য থেকে তিনজন এ কাজে এগিয়ে আসেন। তন্মধ্যে হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) অন্যতম। তিনি স্বীয় জিহ্বার অগ্রভাগ টেনে ধরে বলেছিলেন, আল্লাহ্‌র কসম ! বসরা ও সানা’আর মধ্যে এ জিহ্বার চেয়ে আর কিছু আমাকে আনন্দ দেয় না। (উসদুল গাবা) রাসুল (সাঃ) তাঁর জন্য দু’য়া করেন যে, “হে আল্লাহ্‌ ! তুমি ‘রূহুল কুদুস’ (জিব্রাইল আঃ) কে দিয়ে তাঁর সাহায্য কর।

“ অতঃপর তাঁর কবিতা বলার জন্য মসজিদে নববীতে একটি মিম্বার বানিয়ে দেন। সেই মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে তিনি মুশরিক কুরাইশদের কটাক্ষমূলক কবিতার এমন জবাব দেন, যার ফলে তাদের মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। (আল ইসাবা,ইবনে হাজার আস্কালানী ) রাসুল (সাঃ) তাঁকে বলেছিলেন, আমিও তো কুরাইশ। তুমি কিভাবে তাদের কুৎসা বর্ণনা করবে ? তখন তিনি পাণ্ডিত্যপূর্ণ জবাব দিয়েছিলেনঃ اسلك منهم كما تسل الشعرة من العجين “অর্থাৎ মথিত আটা থেকে যেমন চুল বের করে আনা হয়, আমিও তেমনি আপনাকে বের করে আনবো। “ (উসদুল গাবা) কা’ব বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যাও, তোমরা মুশরিকদের বিপক্ষে কবিতার লড়াইয়ে লেগে যাও।

কারণ মুমিন জিহাদ করে জান দিয়ে ও মাল দিয়ে। মুহাম্মদের আত্মা যার হাতের মুঠোয় তাঁর শপথ ! তোমাদের কবিতা তীরের ফলা হয়ে তাদের কলজে ঝাঁঝরা করে দিবে। (আওনুল বারী) যখন হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কুরাইশদের নিন্দা করে এ চরণটি বলেছিলেনঃ هجوت محمداً فاجبت عنه * وعند الله في ذلك الجزاء “তুমি (আবু সুফিয়ান) মুহাম্মদ (সাঃ) কে ব্যঙ্গ করে কবিতা রচনা করেছ, তাই আমি তার উত্তর দিচ্ছি। আল্লাহর কাছে এর পুরস্কার ও বিনিময় রয়েছে। “ তখন তা শুনে রাসুল (সাঃ) তাঁকে বেহেশতের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, جزاؤك عند الله الجنة يا حسّان অর্থাৎ “হে হাসসান! আল্লাহ্‌র নিকট তোমার পুরস্কার রয়েছে জান্নাত।

“ (কিতাবুল উমদা,ইবনে রাশীক) আবু লায়লা নাবিগা আল জা’দী (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর সামনে কবিতা আবৃতি করলেন। সে কবিতার দুটি চরণ ছিল এরূপঃ ولا خير في حلم إذا لم تكن له * بوادر تحمي صفوه أن يكدرا ولا خيرفي جهل إذا لم يكن له *حليم اذا ما اورد الامر اصدرا “ধৈর্যের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, যখন তাতে এমন শক্তি ও ধার না থাকে যে, তা তার প্রাণ-প্রিয় বন্ধুকে রাগান্বিত অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারে। আর মূর্খতার মধ্যেও কোন কল্যাণ নেই, যখন তার জন্য কোন ধৈর্যশীল না থাকবে যে, যখন কোন কাজ শুরু করবে তখন তা সফলভাবে সমাপ্ত করবে। “ তা শুনে রাসুল (সাঃ) বললেন, لا يفضض الله فاك “আল্লাহ্‌ তোমার মুখ বিনষ্ট না করুন। “ অতঃপর তিনি ১৩০ বছর জীবিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর সম্মুখ ভাগের দাঁত অটুট ছিল।

( আল ইকদুল ফারীদ ) রাসুল (সাঃ) কাব ইবনে যুহাইরের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে তিনি ছদ্মবেশে রাসুল (সাঃ) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার বিখ্যাত কবিতা بانت سعاد আবৃতি করেন। যার প্রথম চরন হলঃ بانت سعاد فقلبي اليوم متبول * متيم أثرها لم يفد مكبول এ কবিতা শুনে রাসুল (সাঃ) এতোই খুশি হন যে, তাঁকে ক্ষমা করে তো দিলেনই উপরন্তু নিজের গায়ের পবিত্র চাদরখানিও তাঁকে পড়িয়ে দিলেন। এজন্যই তাঁর এ কবিতার আর এক নাম "قصيدة البردة" বা চাদরের কবিতা । তামীম গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসুল (সাঃ) এর নিকট আগমন করে। তাদের সাথে কবি যিবরিকান ইবনে বদর, আকরা ইবনে হাবিস ও খতীব আতারেদ বিন হাজেব ছিল।

হুজরার বাহির থেকে তারা ডেকে বলল, হে মুহাম্মদ ! আমরা তোমার সাথে গৌরব ও কবিতার প্রতিযোগিতা করব। কারণ আমাদের প্রশংসা মানুষকে সুন্দর ও চমৎকার করে, আর আমাদের দোষ বর্ণনা মানুষকে কলুষিত ও দোষী করে। রাসুল (সাঃ) স্বীয় খতীব সাবিত বিন কায়েস ও কবি হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কে নিয়ে আসেন। অতঃপর সাবিত আতারেদের সাথে বক্তিতা প্রতিযোগিতা করেন ও হাসসান যিবরিকানের সাথে কাব্য প্রতিযোগিতা করেন। ইবনে হাবেস বলেন, আল্লাহ্‌র কসম এই ব্যক্তি অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) ঐশী বাণী প্রাপ্ত।

তাঁর খতীব আমাদের খতীবের চেয়ে বড় খতীব। তাঁর কবি আমাদের কবিদের চেয়ে বড় কবি। তাদের আওয়াজ আমাদের আওয়াজের চেয়ে উচ্চ। অতঃপর তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করে ও রাসুল (সাঃ) কে অনেক উপঢৌকন প্রদান করে। (সীরাতে ইবনে হিশাম) # রাসুল (সাঃ) নিজেও কবিতা আবৃতি করেছেন।

হযরত বারা ইবনে ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, হুনাইনের যুদ্ধে যখন শত্রু পক্ষ হাওয়াযিন গোত্রের তীরাঘাতের ফলে মুসলমানদের কিছু কিছু লোক পিছু হটে গিয়েছিল, তখন রাসুল (সাঃ) একটি সাদা খচরের উপর আরোহণ করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আর বলছিলেনঃ "أنا النبي لا كذب * أنا ابن عبد المطلب “আমি নবী এতে বিন্দু মাত্র মিথ্যার অবকাশ নেই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। “ হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (সাঃ) খন্দকের নিকটে গেলেন। মুহাজির ও আনসার গণ শীতের সকালে খন্দক খনন করছিলেন। একাজ করার জন্য তাদের সাথে কোন চাকর ছিলনা।

রাসুল (সাঃ) যখন তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর অবস্থা দেখলেন তখন আবৃতি করলেনঃ اللهم إن العيش عيش الأخرة * فاغفر للانصار والمهاجرة “হে আল্লাহ্‌ ! প্রকৃত সুখ শান্তি ও জীবনই হল আখেরাতের শান্তি ও জিবন। তাই আপনি আনসার ও মুহাজেরদের ক্ষমা করুন। “ অতঃপর তাঁরা এর জবাবে বলেছিলেনঃ نحن الذين بايعوا محمداً * علي الجهاد ما بقينا ابدا “আমরা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর হাতে জিহাদের উপর বা’ইয়াত করেছি যতদিন আমরা জীবিত থাকি। “ রাসুল (সাঃ) এর জবাবে বলেছিলেনঃ اللهم لا خير الا خير الأخرة * فبارك في الانصار والمهاجرة “হে আল্লাহ্‌ ! আখেরাতের কল্যাণই একমাত্র কল্যাণ। সুতরাং আপনি আনসার ও মুহাজিরদের বরকত দান করুন।

“ (হায়াতুস সাহাবা,ইউসুফ কান্দলভী) হযরত বারা ইবনে ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আহযাবের দিন আমরা রাসুল (সাঃ) কে মাটি বহন করতে দেখলাম। তাঁর পেট ধূলায় ধূলিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেদিন মাটি বহন করছিলেন আর বলছিলেনঃ والله لو لا الله ما اهتدينا * ولا تصدقنا و لا صلينا فأنزلن سكينة علينا * وثبت الأقدام ان لا قينا إن الأولي بغوا علينا * إذا أرادوا فتنة أبينا আল্লাহ্‌র কসম ! আল্লাহ্‌র মর্জি না হলে আমরা হিদায়েত পেতাম না। আমরা দান ছাদকা করতে পারতাম না, সালাতও আদায় করতে পারতাম না। হে আল্লাহ্‌ ! আমাদের জন্য প্রশান্তি নাযিল করুন।

আর শত্রুদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হলে আমাদের পা মজবুত করে দিন। নিশ্চয় প্রথম দিকের লোকেরা আমাদের প্রতি বিদ্রোহ করেছে। তাঁরা যখন ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় তখন আমরা অস্বীকার করি। (বুখারী) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, রাসুল (সাঃ) কি কোন কবির কবিতা আবৃত্তি করতেন? তিনি বলেছিলেন,তিনি (রাসুল সাঃ)যখন ঘরে ঢুকতেন তখন তিনি প্রায়ই আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কবিতার এ চরণ আবৃত্তি করতেনঃ ستبدي لك الأيام ما كنت جاهلا * و يأ تيك بالاخبار من لم تزود “অতিসত্বর কাল তোমার জন্য প্রকাশ করে দিবে যে বিষয়ে তুমি অজ্ঞ ছিলে এবং জাদের কথা তুমি জমা করে রাখনি, তাদের সংবাদ অবশ্যই তোমার কাছে এসে পৌছবে। “ (তিরমিযী, সিয়ারু আ’লামিন-নুবালা,আত তাবাকাতুল কুবরা) ∞ সমাপ্ত ∞ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।