আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা

শাকিলা তুবা “বাসায় কাজের লোক না থাকলে আমার কি যে ঝামেলা যায়, এ কথাটা শাহেদ কখনোই বুঝলো না। হুট করে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বাসায় ফিরলো। কি আর করা! অগত্যা রান্না বান্না করে সবাইকে খাইয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত ১২টা বেজে গেল। আমিও থালাবাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। সব ধুয়ে অবসর হতে হতেই ভাবলাম কাল সকালের নাশতার জন্যে সবজি কেটে ফ্রিজে রেখে দিই।

সকালে উঠে ক’টা রুটি বানিয়ে, সবজিটা ভেজে দিলেই হবে। আর ডিম তো আছেই পোচ করে দেবক্ষন। বেডরুমে ঢুকে দেখি বাহ শ্রীমান তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কি আরামের একটা ঘুম দিয়েছেন! পুরুষমানুষগুলো কি যে স্বার্থপর হয়! এই যেমন আমার ছেলেটা। নয় বছর বয়স হয়েছে, ওর সব কিছু এখনো আমাকেই করে দিতে হয়। মেয়েটা পাঁচ বছরের।

অথচ দেখো কি লক্ষী। আজো যখন বাসায় এত গেস্ট, মেয়েটা আমাকে টেবিলে প্লেট সাজাতে সাহায্য করলো। গ্লাসগুলো সাজিয়ে দিল। আর ছেলেটা বসে বসে তখন কার্টুন দেখছিল। আমি বাথরুমে ঢুকে মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

তারপর মুখে ক্রিম ঘঁষতে ঘঁষতে একদম বিছানায়। শরীর আর বইছে না। ওয়াল ঘড়িতে দেখলাম সময় রাত দেড়টা বাজে। হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ অফ করে শুয়ে পড়লাম। আমার বাঁদিকে শাহেদ, ডানপাশে মেয়ে টায়রা আর ওর পাশে দেয়াল বরাবর ছেলে টোকন।

ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় ডুবে গেলাম। চোখটা লেগে এসেছিল প্রায়। কোন এক আজানা কারনে ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে হোঁচট খেলাম মনে মনে। বাইরের স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো পর্দা ছাড়িয়ে আমার ঘরে এসে এক চিলতে ফিতের মত পড়ে থাকে প্রতিদিন।

আজো পড়েছে। সে আলোয় আমি দেখলাম, সম্পূর্ন অপরিচিত মোটা, কালো, মধ্যবয়স্ক এবং কুৎসিত এক লোক মুখ হা করে আমার পাশে ঘুমুচ্ছে। আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে চাইলো। কেমন যেন বিশ্রী একটা গন্ধ চারপাশে। কোনমতে পাশ ফিরে দেখলাম ঐপাশে কালো কালো দু’টো অপরিচিত ছেলেমেয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে।

কিছুই বুঝতে পারছি না! এবার আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বিছানাটা আমার নয়, এমনকি বাড়ীটাও। কেমন যেন পুরনো দিনের একটা বাড়ী। হায় হায়, এ আমি কোথায়? বাড়ী যদি অন্যের হয় বেডসুইচটা কি আছে? কোন কিছু না ভেবেই আমি লাফ দিয়ে উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা অন করে দিলাম। আলো জ্বলে উঠতেই আমার বুকটা যেন আরো হিম হয়ে উঠলো। দেখি, আমার বর শাহেদ আর ছেলেমেয়ে দু’টো বিছানায় উঠে বসে আছে আর একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

ওদের দৃষ্টিতে হিমশীতল শূণ্যতা বুঝিবা মৃত মানুষের চোখ। আমি চীৎকার করতে করতে ছুটে গেলাম দরজার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক শুধু দেখলাম ওরা সেই একই ভাবে বসে আছে তবে দৃষ্টিটা আমার উপর। কোনরকমে গিয়ে কিচেনে ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার হৃৎপিন্ডটা বের হয়ে আসবার উপক্রম হল।

দেখি অনেকগুলো অচেনা মহিলা আমারই রান্নাঘরে। পিঠা বানাচ্ছিল বুঝিবা। তাদের সামনে ছড়ানো চালের গুঁড়ি, কোড়ানো নারিকেল আর গুড়। ওরা হাসি আনন্দে কলকল করছিল। আমি ঢুকতেই সবাই খুব অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে, সবারই চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।

তারপরই ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ভূ—উ—ত, ভূ—উ—ত বলে। আর একজন আমার গায়ে ছুড়ে দিলো চালের গুঁড়াগুলো। আমি পাগলের মতো ওই ঘর থেকেও বেরিয়ে এলাম। এখন আমি বেডরুমে ঘুরছি, রান্নাঘর-ড্রইংরুম সব ঘুরছি। ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেছে সব।

কেউ নেই। এমন কি আমার স্বামী বা ছেলেমেয়েরাও কোথাও নেই। ডাইনিং টেবিলে বসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরী লিখছি। কেন লিখছি তাও জানিনা। আমার সারা গায়ে এখনো চালের গুঁড়া লেগে আছে, গলায় হাতে, কাপড়ে।

এত রাতে, এত্তো বড় একটা বাড়ীতে আমি একা। আমার মতো ভীতু মানুষ একদম একা। কি করে এটা সম্ভব হলো জানিনা। আমি কাঁদছি আর বিড়বিড় করে ডাকছি, শাহেদ, শাহেদ---“ এটা আমার ছোট খালার লেখা একটা ডায়েরীর অংশবিশেষ। আঠারো বছর আগে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে উনি ঘুমন্ত অবস্থাতেই হার্ট এটাক করা মারা যান।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো, উনি যে রাতে মারা যান ডায়েরীটা সে রাতের। মারা যান ঠিক রাত দেড়টায়, যখন আমার খালু আর খালাতো ভাইবোন টায়রা, টোকন ঘুমিয়ে ছিল। খালু টয়লেটে যাবার জন্যে রাত দুইটায় ঘুম থেকে উঠে দেখেন খালার সারা শরীর চালের গুঁড়ায় মাখামাখি আর তার শরীরটা তখনো গরম। ডাক্তার এসে মত দেন যে উনি রাত দেড়টায় পৃথিবী ছেড়েছেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.