আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দের মা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। কবি কুসুমকুমারী দাশ। জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ বরিশালেরই মেয়ে ছিলেন।

গ্রামের নাম গৈলা। যদিও কুসুমকুমারী দাশ ১৮৭৫ সালের দিকে বরিশাল শহরেই জন্ম গ্রহন করেছিলেন । কুসুমকুমারী দাশ-এর বাবা , অর্থাৎ জীবনানন্দের মাতামহের নাম ছিল চন্দ্রনাথ দাশ; তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং বরিশাল ব্রাক্ষ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন । ১৮৬১ সালে বরিশালের যে ব্রাহ্মসমাজটির প্রতিষ্ঠায় জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন । এইখানেই বলে রাখি যে- কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজটি গঠিত হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ।

হিন্দু ধর্মের প্রতি ইউরোপীয় মিশনারিদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই রাজা রামমোহন রায়ের অনুপ্রেরণায় বহু ঈশ্বরবাদী ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মরা উপনিষদের নিরাকার ঈশ্বরে ভজনা করতে থাকে । যদিও ব্রাহ্মদের অনেক আচার খ্রিষ্টধর্মের মতোই ছিল, এবং ব্রাহ্মদের অনেক আচার আবার হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সমর্থিত ছিল। সে যাই হোক। ব্রাহ্মধর্মটি ছিল মূলত উনিশ শতকের একটি ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন। কুড়ি শতকে ব্রাহ্মদের ‘নীতিবাগীশ’ বলে ভাবা হত।

ব্রাহ্ম শব্দটির বিকৃত রূপ ‘বেম্ম’ বলতে বোঝাত নৈতিক বিশুদ্ধতা। জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ এমনই এক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে ছিলেন। জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ- এর পৈত্রিক ভিটেমাটি বরিশালে নয়, ছিল পদ্মারই এক শাখানদী কীর্তিনাশার তীরে বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে। সেই গ্রামখানি কীর্তিনাশার জলে তলিয়ে গিয়েছিল । জীবনানন্দের ঠাকুমা অর্থাৎ সর্বানন্দ দাশ- এর স্ত্রীর নাম ছিল প্রসন্নকুমারী দাশ।

তাঁরই মুখ থেকেই জীবনানন্দ শৈশবে বিক্রমপুর আর পদ্মা নদীর গল্প শুনেছিলেন। সে সব গল্পের মধ্যে ছিল অষ্টাদশ শতকের রাজা রাজবল্লভের স্মৃতি, যাঁর একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদকে বলা হত ‘একুশ রতত্ন’। সেই স্মৃতিই পরবর্তীকালে উঠে এসেছে কবির রূপসী বাংলা কবিতায়: তবু তাহা ভুল জানি-রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা; তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়-(রূপসী বাংলা) জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে কীর্তিনাশার পাড়ে গাঁওপাড়া গ্রামটি কীর্তিনাশার জলে তলিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই সর্বানন্দ দাশ ‘কার্যোপলক্ষে’ বরিশাল শহরে এসেছিলেন। বরিশাল শহরে এসে তিনি নব্য ভাবধারায় উজ্জীবিত হন, অর্থাৎ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন।

দাশ পরিবারের উপাধি ছিল দাশগুপ্ত। সর্বানন্দ দাশ উপাধি থেকে ‘গুপ্ত’ শব্দটি ছেঁটে ফেলেন, কেবলই ‘দাশ’ লিখেন। এরপর তাঁর বিক্রমপুরের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক আর রইল না। বরিশাল শহরেই স্থায়ী হলেন সর্বানন্দ দাশ এবং একে একে সাত পুত্র এবং চার কন্যার জনক হলেন। সর্বানন্দ ‘বেম্ম’ হয়েছে।

এ নিয়ে নানারকম কথা উঠেছিল সে সময় সর্বানন্দ দাশ-এর হিন্দু আত্মীয়সমাজে। সর্বানন্দ দাশ এ কারণে তাঁর বড় ছেলেকে তাঁর হিন্দুসমাজে আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে আসেন। সর্বানন্দ দাশ-এর বড় ছেলের নাম হরিচরণ দাশ। পরে অবশ্য হরিচরণ দাশও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহন করেছিলেন। ব্রাহ্মরা শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত উদার ছিলেন।

সর্বানন্দ দাশ প্রথমে তাঁর বড় ছেলেকে বরিশাল শহরের স্থানীয় জেলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তারপর পাঠালেন কলকাতায়। সেখানে ব্রাহ্ম ইনষ্টিটিউশন, সিটি স্কুলে ভর্তি হন হরিচরণ দাশ । পরবর্তীকালে হরিচরণ দাশ এবং দ্বিতীয় পুত্র সত্যানন্দ দাশ দুজনই কলকাতার ব্রাহ্ম মহাবিদ্যালয় সিটি কলেজে ভর্তি হন। সর্বানন্দ দাশ- এর এই দ্বিতীয় পুত্র সত্যানন্দ দাশই জীবনানন্দের বাবা, অর্থাৎ কুসুমকুমারী দাশ-এর স্বামী।

বরিশাল শহরের একটা স্কুলেই কুসুমকুমারী দাশ তাঁর মেয়েবেলায় পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। অবশ্য চতুর্থ শ্রেণির পর আর পড়া হয়নি। কেননা সেই স্কুলটি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতায় কুসুমকুমারী দাশদের আত্মীয়স্বজন ছিল; কাজেই বালিকা কুসুমকুমারী কলকাতার একটি স্কুলে ভর্তি হল । ‘আমার মা বাবা ’ নামে কবি জীবনানন্দের বিখ্যাত একটি নিবন্ধ রয়েছে, যে নিবন্ধটির মর্যাদা জীবনানন্দ প্রেমিকগণের কাছে ধর্মগ্রন্থের সমান ।

এই পোস্টের অনেক তথ্যই আমি সেই নিবন্ধ থেকেই টুকেছি। মা কুসুমকুমারী দাশ সম্বন্ধে ওই নিবন্ধে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহন করেন। তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়েছিলেন। খুব সম্ভব ফার্ষ্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন, তার পরেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালোই করতে পারতেন, এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তাঁর বেশি শক্তি ছিল মনে হচ্ছে।

’ (আমার মা বাবা) প্রতিভাবান ছেলের পক্ষ থেকে মায়ের মেধার এরূপ অকুন্ঠ স্বীকৃতি আমাদের মুগ্ধ করে বৈ কী । সেই যাই হোক, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমাদের কৌতূহল কিন্তু অন্যত্র। তা হল-উনিশ শতকে সামাজিকভাবে অগ্রসর বহু সংস্কারমুক্ত মানুষ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন, এবং ব্রাহ্মরাও বিবেচিত হতেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ হিসেবে। নারীশিক্ষার প্রতি ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। অথচ, ব্রাহ্মপিরবারের মেয়ে কুসুমকুমারী দাশ কে বিয়ের জন্য পড়াশোনা ছাড়তে হল? ... বিয়ের পর এই প্রতিভাময়ী নারীর কি হল-সে প্রসঙ্গে আমি পরে আসছি।

কলকাতায় কুসুমকুমারী দাশ-এর অভিভাবক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ইঁনি ব্রাক্ষ্মসমাজের উপরের সারির একজন নেতা ছিলেন। তাঁরই আগ্রহে ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হল শিশুদের মাসিক পত্রিকা ‘মুকুল’। মুকুল পত্রিকায় লিখতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লিখতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। আরও লিখতেন তরুণি কুসুমকুমারী দাশ।

প্রথম বছরেই অর্থাৎ ১৮৯৫ সালেই কুসুমকুমারী দাশ- এর বেশ কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছিল মুকুল-এ। এগুলোর মধ্যে ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির প্রথম দুটি চরণ আজ প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে: আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। এবার পুরো কবিতাটি পাঠকরা যাক। আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন, ‘মানুষ হইতে হবে’-এই তার পণ।

বিপদ আসিলে কাছে, হও আগুয়ান, নাই কি শরীরে তবে রক্ত মাংস প্রাণ? হাত পা সবারি আছে, মিছে কেন ভয়, চেতনা রয়েছে যায়, সে কি পড়ে রয়? সে ছেলে কে চায় বল-কথায় কথায় আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়? সাদা প্রাণে, হাসি মুখে কর এই পণ- ‘মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন’। কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার সবারি রয়েছে কাজ, এ বিশ্ব মাঝার, হাতে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ। মায়ের কবিতা সম্বন্ধে জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘মায়ের কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ (রয়েছে?) । অনেক সময় বেশ ভালো কবিতা বা গদ্য রচনা করছেন দেখতে পেতাম। ’ (‘আমার মা বাবা’ ) মুকুল-এ কেবল জীবনানন্দের মা-ই লিখতেন না, লিখতেন জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশ।

কি ছিল তাঁর লেখার বিষয়? তাঁর লেখার বিষয় ছিল: ইতিহাস। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের ওপর সত্যানন্দ দাশ একটি ইতিহাসনির্ভর লেখা লিখেছিলেন। বাঙালি কবিদের মধ্যে জীবনানন্দের কবিতা ইতিহাসচেতনায় মূখর। এখন যেন অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনানন্দের মা এবং বাবা যে পত্রিকায় লিখতেন সেই একই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথও লিখতেন।

সন্দেহ নেই, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক তাৎপর্যময় ঘটনা । মুকুল পত্রিকা পতিষ্ঠার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে সত্যানন্দ দাশ- এর সঙ্গে কুসুমকুমারী দাশ- এর বিয়ের হয়। কুসুমকুমারী দাশ- এর বয়স তখন ১৯। বিয়ের আগে সত্যানন্দ দাশ- এর জীবনের কিছু ঘটনা বলা দরকার। তাতে বরিশালে কুসুমকুমারী দাশ এর শ্বশুরবাড়ীর আবহাওয়া বুঝতে আমাদের কিছুটা সাহায্য করবে।

১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ দেহরক্ষা করেন। শোকসংবাদ শুনে সত্যানন্দ দাশ এবং তাঁর বড় ভাই হরিচরণ দাশ কলকাতা থেকে বরিশাল এসে শ্রাদ্ধপর্ব সেরে আবার কলকাতায় ফিরে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আসন্ন। পরীক্ষায় দু ভাইয়ের কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেননি । এঁদের পিতা সর্বানন্দ দাশ, আমি আগেই বলেছি যে, সরকারি চাকরি করতেন।

তবে তাঁর ছেলেদের কেউই যে সরকারি চাকরি পাননি তা এক লেখায় সত্যানন্দ দাশ উল্লেখ করেছেন । দু ভাই অথই সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তারপর হরিচরণ দাশ পোষ্ট অফিসের চাকরি পেলেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশ হবিগঞ্জে একটা স্কুলে ঢুকলেন পড়াতে। (এই হবিগঞ্জ কি বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা?) সেই যাই হোক।

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশাল শহরে ব্রজমোহন ইনষ্টিটিউশন নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সত্যানন্দ দাশ সে স্কুলে যোগ দিলেন। তবে চাকরি বেশি দিন করতে পারেননি। সেসব অবশ্য অনেক পরের কথা ... আমি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি যে সত্যানন্দ দাশ মুকুল পত্রিকায় লিখতেন । হয়তো সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এবার বরিশালে একটি পত্রিকা সম্পাদনায় উদ্যেগী হলেন।

সময়টা ১৯০০ সাল। জীবনানন্দ দাশ দু বছরের শিশু। সত্যানন্দ দাশ ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র হিসেবে ব্রহ্মবাদী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁকে সাহায্য করতেন তাঁর ভগ্নিপতি (অর্থাৎ জীবনানন্দের পিসেমশাই (ফুপা) ) মনমোহন চক্রবর্তী। পত্রিকাটির প্রথম দিকের বেশ কিছু কবিতা মনমোহন চক্রবর্তীই লিখেছিলেন; (জীবনানন্দের শৈশবের সাহিত্যিক পরিমন্ডলের কথা ভেবে বিস্মিত হতেই হয়) তবে ব্রহ্মবাদী পত্রিকার অনেক কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ ।

সব মিলিয়ে শ’ খানেক। কিন্তু, শ’ খানেক কবিতা কীভাবে রচিত হল? অনুমান করি- সংসারে নানান কাজ ছিল, জটিলতাও কম ছিল না। সে বিষয়ে জীবনানন্দ আমাদের জানাচ্ছেন, ‘ (মা) সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন ...এমন সময়ে ব্রহ্মবাদীর সম্পাদক আচার্য মনমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুনি ব্রহ্মবাদীর জন্য তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে। লোকে দাঁড়িয়ে আছে। শুনে মা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত, যেন চিঠি লিখছেন, বড়ো একটা ঠেকছে না কোথাও; আচার্য চক্রবর্তী কে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন।

’ (‘আমার মা বাবা’ ) পরবর্তীকালে মনমোহন চক্রবর্তী বরিশাল থেকে এলাহাবাদ বদলী হয়ে যান। ওখান থেকে বের করেন বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকা । এতেও জীবনানন্দের মায়ের কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিল। কেবল তাই নয়, কুসুমকুমারী দাশ ‘কবিতা মুকুল’ নামে একটি শিশুতোষ কবিতার বইও বের করেছিলেন। কবিতা ছাড়া গদ্যও লিখেছেন কুসুমকুমারী দাশ ।

‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এটি ছিল প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণের ওপর লেখা গল্প। তা, কুসুমকুমারী দাশ, আমাদের প্রিয়তম কবিটির মা তাঁর একান্ত ঘরের উঠানে কেমন মানুষ ছিলেন? সে কথাও জীবনানন্দের লেখাতে উল্লেখ রয়েছে। কবিদের বরিশালের বাড়িটির টিনের ছাদের তলায় ছিল বিরাট এক জমজমাট যৌথ সংসারের কলহাস্যধ্বনি; অনেক মানুষের গুঞ্জনে অহোরাত্র কোলাহল মূখর । (জীবনানন্দের লেখা গল্পউপন্যাসে তার অনেক ছবি পেয়েছি) ... কবির জেঠিমা (হরিচরণ-এর স্ত্রী?) এবং মা দু-হাতে সংসার ঠেলছেন।

(এ ক্ষেত্রে আমাদের ভেবে নিতে হবে কলকাতার বেথুন কলেজে পড়া এক কেতাদূরস্ত মেয়ে বরিশালের মতন একটি মফঃস্বল শহরের একটি একান্নবর্তী পরিবারে খেটে মরছে! ) পরিবারের অবস্থা যে বিশেষ সচ্ছল ছিল না, তার ইঙ্গিত আমি আগেই দিয়েছি। তবু কবির ঠাকুরমা প্রসন্নকুমারী দাশ, কবির জেঠিমা এবং কবির মা এই তিন নারীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় প্রতিটি সংসারের প্রতিটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিই সামলে নিতেন। কবির মাই হয়তো এক্ষেত্রে মধ্যমনি ছিলেন বলে অনুমান করি। কেননা, ইঁনিই তো কিশোরী বয়সে লিখেছিলেন: বিপদ আসিলে কাছে, হও আগুয়ান, নাই কি শরীরে তবে রক্ত মাংস প্রাণ? হাত পা সবারি আছে, মিছে কেন ভয়, চেতনা রয়েছে যায়, সে কি পড়ে রয়? সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে জীবনানন্দের মা কবিতার লেখার বেশির সময় পাননি। অবশ্য পরিবারটি ছিল আলোকিত, পরিবারের লোকজন কাব্যচর্চার মর্ম ঠিকই বোঝত, তবে নারী বিশাল যৌথপরিবারে ঘানি না-টেনে কাব্য চর্চা করছে-এমন চিত্র পুরুষশাসিক সমাজে যে আজও অকল্পনীয়।

সে কারণেই কি জীবনানন্দ খানিকা ক্ষোভের সুরে লিখেছেন, ‘কবিতা লেখার চেয়ে কাজ ও সেবার সর্ব্বাত্মতার ভেতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো। তাঁর কাজকর্মের আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সেইকথা মনে হলেও ভেতরের খবর বুঝতে পারিনি, কিন্তু তিনি আরো লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন মনে হয় । ’ সে যাই হোক। কুসুমকুমারী দাশ যে ছেলের জীবন বাঁচিয়েছিলেন সেটাই তাঁর জীবনে সবচে বড় অর্জন বলে মনে করি । এখন সেকথাই বলি।

জীবনানন্দের ছেলেবেলায় এক ধরণের যকৃতের রোগ হয়েছিল । বাঁচবার আশা ছিল না। ডাক্তার ‘হাওয়া পরিবর্তনের’ উপদেশ দিলেন। ছেলের মা ছেলেকে নিয়ে গেলেন লখনউ, আগ্রা দিল্লি। সঙ্গে পরিবারের একজন পুরুষসঙ্গী।

জলের মতন টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। আমি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি যে দাশ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য কুসুমকুমারী দাশ-এর এমন নিদারুণ প্রচেষ্টাকে যৌথপরিবারের অনেকের কাছেই ‘আত্মঘাতী’ বলে মনে হয়েছিল। তবু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি জীবনানন্দের মা। যৌথপরিবারের সমালোচনা অগ্রাহ্য করে পশ্চিমের স্বাস্থনিবাসে দীর্ঘ দিন কাটিয়ে ছেলেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করেই তবে বরিশালে ফিরে এসেছিলেন।

তথ্যসূত্র: ক্লিন্টন বি সিলি; অনন্য জীবনানন্দ। অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন। জীবনানন্দ স্মৃতি। আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র জীবনানন্দ দাশ Fakrul Alam; Jibanananda Das Selected Poems with an Introduction , Chronology, and Glossary এই পোষ্ট লিখতে এই বইয়ের Introduction কিছু কাজে লেগেছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.