প্রতি বছরের মত এবারো আমরা শীতবস্ত্র সংগ্রহ করার দায়িত্ব নিজে থেকে কাঁধে তুলে নেই। আমরা যারা শহরে বিল্ডিং- এর ভিতরে থাকি, তারা বেশ কিছুটা শীতকে উপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু যারা রাস্তায় আছে, তাদের কষ্ট আমাদের চোখের সামনে ! কেউ কেউ দেখি , কেউ কেউ দেখেও দেখিনা! ইটের দেয়াল সীমানা করে দিয়েছে শৈত্যপ্রবাহের সাথে সাথে মনুষ্যত্বকেও ! এখন প্রশ্ন হতে পারে দেয়ালের ভিতরে মনুষ্যত্ব নাকি বাহিরে!! দেয়ালটা কি ইটের নাকি চামড়ার !!
শীত বেশি বলে এবারের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি বলে মনে করে কাজে নেমে পরি আমরা শপথ ফাউন্ডেশন । সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি এবার ১০০+ মানুষ শীতে মারা গেছে বাংলাদেশে!
আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন এলাকায় বাসায় বাসায় গিয়ে কড়া নেড়ে শীতার্তদের হয়ে সাহায্য কামনা করি। সেই সাহায্য আর্থিক অথবা বাসায় ফেলে রাখা শীতবস্ত্র অথবা পুরান কাপড়।
এই ভাবে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি , এলাকা ভেদে সাহায্যের প্রকার ভেদ আছে । যেমন এপার্টমেন্ট গুলাতে ঢুকা যায়না , নিরাপত্তা জনিত কারণে । নিতান্ত পরিচিত কেউ না থাকলে একদমই যাওয়া যায়না । ফলে যেসব এলাকায় এপার্টমেন্ট বেশি , সেসব এলাকায় সংগ্রহ একদম কম। নাই বললেই চলে।
যেসব এলাকা সাধারণ দালান , মধ্যবিত্তরা থাকে , তাদের পর্যন্ত আমরা পৌছাতে পারি । গরীবের কষ্টের কথা তুলে ধরি , সারা ভাল পাই। এই কাজের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি সমাজে এখনও ভাল মানুষ আছে। যারা খুশি হয়ে শুধু পুরান নয় , ব্যাবহার যোগ্য নতুন কাপড় তুলে দেন। আমাদেরকে অনেক বাহাবা দেন।
বেতিক্রম কিছু আছে , যারা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন, ভিক্ষুকের মতো আমাদেরকে তাড়িয়ে দেন । তখন এই উপলব্ধিও হয় , আমরাও অনেক সময় ভিক্ষুককে তাড়িয়ে দেই! উপলব্ধি করি এমন ব্যাবহারে কতটা কষ্ট হয় । অন্যকে সাহায্যের জন্য কাজ করতে নেমে আসলে আমরা নিজেরাও শিখে নেই আমাদের ভুল আচরণ কোনটা , যেনে যাই ভাল মানুষের পরিমাণ বেশি , কিন্তু কি অজ্ঞাত কারণে এই ভাল মানুষ গুলো একত্রীত হতে পারছে না !? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে থাকে!
সমাজের সবাই , সব সংগঠন একত্রিত হলে এই অসহায় শীতার্ত মানুষকে বাঁচাতে পারি, যেকোনো জাতীয় সমস্যার সমাধান হতে পারে।
সমাজের মানুষ গুলা এক হতে পারছেনা কেন না জানলেও সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে যেসব সংগঠন তারা কেন এক হতে পারছেনা তার কিছুটা ধারণা আমরা পেয়েছি। একত্রীত না হতে পারার কারনের মধ্যে অন্যতম কারণ ভুল অহংকার ।
একে অপরের থেকে সুপ্রিম মনে করা , কাজের অগ্রগতির জন্য একে অপরের নেতৃত্ব মেনে নিতে না পারা। নিজেকে একমাত্র ভালর ধারক মনে করা। হয়তো এগুলাই কারণ সমাজের মানুষ গুলা এক হতে পারছে না । এটাও সত্য ভাল কাজে নিয়জিত অনেক ভাল সংগঠন খুব বেশি প্রচারমুখী হওয়ায় তারা সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ! অবশ্য আমার মনে হয় এক হতে না পারাটা আমরা শিখে নিয়েছি , শিখানো হয়েছে !!
ছোট বেলা থেকে আমরা শিখেছি কি করে প্রতিযোগিতা করতে হবে সহপাঠীদের সাথে, প্রতিযোগিতায় জিততে হলে নিজের ভাল নোট অন্য কাউকে না দেয়া , নিজের মধ্যে ভাল নোট রেখে দেয়া , যাতে পরীক্ষায় একাই ভাল ফলাফল করে এগিয়ে যেতে পারি! আমার কাছে মনে হয় , অদ্ভুত হলেও সত্য, এটা একটা বড় কারণ আমাদের আত্মকেন্দ্রিক মন মানুষিকটার জন্য । এভাবেই আমরা আত্মকেন্দ্রিক সমাজ গড়ে তুলছি! অন্যকে সাহায্য করার আনন্দ আমরা আমাদের ছাত্র জীবনের কোথাও পাইনা ।
আমরা শিখি কি করে এরিয়ে যেতে হবে , ভালকে আড়াল করতে হবে, একজন বন্ধুকে যতটা কাছের মানুষ ভাবতে শিখি তার থেকে বেশি শিখি সে একজন প্রতিযোগী । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা জানিনা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে সূত্র বিশেষ, যার সাহায্যে জীবন থেকে সব শিক্ষা শিখে নিতে হবে!
অনেকে মনে করে জীবনে একটা পর্যায়ে পৌঁছে পড়াশুনা শেষে সমাজ সেবা করবে ! বেশীর ভাগ সময়েই দেখা যায় তা স্বপ্ন রয়ে যায়। কেন রয়ে যায় সেই প্রশ্নের উত্তর আমি অনেকটা এমন ভাবে দেখি যে পড়াশুনার ব্রত যদি হয় টাকা উপার্জন , তাহলে সেই পড়াশুনা কি করে কল্যাণের কাজ করবে ?! অন্নের ভাল করা জীবনের শুরু থেকে প্রাকটিস করে আসি নাই! তাই চাইলেও আমরা অনেকেই মনের এই দেয়াল ভাঙ্গতে পারিনা। ।
ভাঙ্গা জরুরী ।
এবার শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে আমরা গিয়েছিলাম গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ভাপাচিলা গ্রামে। শহর থেকে গ্রামের ভিতরের এলাকায় ত্রান দেয়াটাই বেশি জরুরী মনে হয় আমাদের। কারণ দূরে কষ্ট করে গিয়ে ত্রান দেয়াটা অনেক কষ্টের কখনও ভয়ের। জরুরী মনে করি কারণ , দূরে যেতে পারেনা বলে ঢাকার আসে পাসে সাহায্য দেয় অনেকে। এছাড়া ঢাকার শহরের আসে পাশে ফুটপাথে থাকা দুঃখী মানুষ গুলো সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে কষ্টে রাখে অতিরিক্ত সাহায্যের আশায়।
এজন্য সব মিলিয়ে দূরে গিয়ে ত্রান দেয়াটাই আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। এটাও খেয়াল রাখার চেষ্টা করি , যেই গ্রাম এলাকার নাম সংবাদ পত্রে এসেছে সেই এলাকায় না গিয়ে এমন কোথাও যেতে যেখানের কথা প্রকাশিত হয়নি। কারণ আমরা দেখেছি , সংবাদপত্রে প্রকাশের কারণে একই জায়গায় অনেক বার অনেক সংগঠন সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে। তাই যে এলাকার নাম প্রচার মাধ্যমে আসেনি , চেষ্টা করি সেরকম একটা এলাকায় যেতে।
প্রতিবারের মত এবারো আমরা ত্রানের সাথে ট্রাকে করে রওনা দিয়েছিলাম ।
ট্রাকে করে যাওয়াটাকে আমরা প্রাধান্য দেই যাতে ভলান্টিয়াররা দৃশ্যগত কষ্টটা ছাড়াও শারীরিক ও মানুষিক কষ্টকে ভালভাবে বুঝতে পারে, উপলব্ধি করে। আমাদের সংগ্রহ অনুযায়ী আমরা নতুন পুরান মিলিয়ে ৬৫০০ এর অধিক গরিব মানুষকে ত্রান দেয়ার প্রস্তুতি ছিল । আমাদের সংগঠন শপথ ফাউন্ডেশন এর সাথে আরও ৮টা সংগঠন তাদের সংগ্রহ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল যার মধ্যে বিদেশে থাকা বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠনও তাদের স্বার্থ মত সাহায্য পাঠিয়েছে।
তাদের মতে , প্রবাসীরা দেশের মানুষের পাশে দাড়াতে চায় , কিন্তু ভরসা করার মত সংগঠন পায়না , অনেক জায়গায় প্রতারিত হয়েছে , তাই নিরুপায় তারাও।
ভাপাচিলা গ্রামে পৌঁছে দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে গ্রামবাসির আগমনের অপেক্ষা করতে করতে ভাবলাম প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করে যেনে নাই গ্রামের অবস্থা।
যোগাযোগ করে দেখা পেলাম সহকারী প্রধান শিক্ষকের । পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি , গ্রামের চেয়ারম্যান অথবা প্রভাবশালী বেক্তিরা ত্রান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনের তাগিতে। তাই শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম গ্রামের মানুষরা শীতে কতটা কষ্টে আছে? চেয়ারম্যান কে , সে কোন রাজনৈতিক দলের ? জবাবে বললেন চেয়ারম্যান তার বড় ভাইয়ের মত , এখুনি উনি এসে পরবেন! সেই সব কিছু বলবে! বুঝলাম ভুল জায়গায় আমি প্রশ্ন করেছি। তারপর আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা আসছি উনি জানলেন কি করে ? তখন বললেন আমার লোক নাকি কথা বলেছে! পরে বুঝলাম , আমাদের সাথের সহযোগী সংগঠনের ভলান্টিয়াররা জানিয়েছে। যারা ট্রাকে করে না এসে আলাদা ভাবে এসেছে, যেনে খারাপ লাগলো , কারণ কাউকে না জানিয়ে আসতে চেয়েছিলাম , তাহলে প্রভাবশালীদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা যায়।
কিন্তু অন্য সংগঠন নতুন থাকায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বলেছে। আর ভুল করেছে। চেয়ারম্যান এসে দেখে আমরা গ্রামবাসীদের নিয়ন্ত্রণ করছি লাইন ধরে নেয়ার জন্য। আমরা লাইন করে গ্রামবাসীদের বসিয়ে রাখি, আর ত্রান আমরা গিয়ে তার হাতে তুলে দেই।
এতে করে ঠেলা ঠেলি মারামারি উপেক্ষা করা যায়।
আমরা ত্রান বিতরণের সময় এটাও বলছিলাম যতক্ষণ না সবাইকে দেয়া শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ কেউ যেতে পারবেনা । এমনটা করার কারণ , যাতে কেউ বাসায় ত্রান রেখে এসে দ্বিতীয় বার নিতে না পারে।
সব কিছু পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে চলছিলো , পুরুষদের আলাদা লাইন , মহিলাদের আলাদা লাইন এবং বাচ্চাদের আলাদা লাইন। যাতে করে বিতরণে সুবিধে হয়।
কিন্তু বাঁধ সাধে কিছু মানুষের উসকানি।
আচমকা পুরুষ লাইন এ হাওকাও এবং ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয় , ত্রান নিবার জন্য তোরজোড় শুরু হয় , দেখতে দেখতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় । এমন সময় চেয়ারম্যান এর লোক বলল আপনারা তারাতারি চেয়ারম্যান এর সাথে কথা বলেন , না হলেতো মাইর খেয়ে ফিরবেন । আমি কথা বলতে যাই , আমাকে চেয়ারম্যান বললেন , আপনারা প্রথম থেকেই ঠিক মত কাজ করছেন না , আমাকে বললে আমি সব প্রথম থেকে ঠিক করে দিতাম। উনি প্রস্তাব করলেন উনি সব শান্ত করে দিবেন , আমরা তারপর ত্রান বিতরণ করবো। ক্ষণিকের জন্য ঠাণ্ডা হলেও বিতরণের সময় ত্রানের কাপড় নিয়ে টানাটানি বেধে যায়।
এক সময় ভলান্টিয়ার দের নিয়েও টানাটানি শুরু হয়। তখন আমি ত্রান বিতরণ স্থগিত করে সবাইকে ট্রাকে উঠতে বলি। এ সময় চেয়ারম্যান বললেন , পরিস্থিতি ত খারাপ করলেন , এখন জনগণের জন্য দেয়ার কিছু থাকলে আমাকে দিয়ে জান , আমি পরে দিয়ে দিবো। আমরা অজ্ঞতা বস্তা ভরতি ত্রান স্কুলের একটা কক্ষে রাখা শুরু করি। ওদিকে গ্রামবাসী উসকানি পেয়ে ট্রাকে উঠতে চেষ্টা শুরু করে দেয়।
বিপদের গন্ধ পেয়ে ৩টা বস্তা মাঠের ৩টা জায়গায় উত্তপ্ত গ্রামবাসীর মধ্যদিয়ে রেখে আসি, গ্রামবাসীর মনোযোগ ফেলে আসা বস্তার দিকে গেলে আমাদের ট্রাক চালু করতে বলি। আমরা প্রস্থান করি। চলে আসার আগে , স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এর সাথে কথা হয়েছিল, তার কথার প্রেক্ষিতে অবশিষ্ট কম্বলের ২০টি কম্বল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিলাম। এর পর ফিরতি পথে আরও একটি স্কুলে ট্রাক থামিয়ে , বাকি সব ত্রাণ স্কুলের বাচ্চাদের জন্য দিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা।
ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার , কেউ যদি ত্রাণ দিতেও যায় তাহলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে স্থানীয় প্রভাবশালী বেক্তিরা, নিজেদের নির্বাচনী সুবিধার দিকে খেয়াল রেখে।
ফলে প্রকৃত দুঃস্থ মানুষের কাছে ত্রাণ পৌছায় না, পৌঁছালেও মিথ্যা নাটকের সৃষ্টি করে ত্রাণ আয়ত্তের চেষ্টা চলে। আমরা তাদের হাতে দিলেও সব দিয়ে দেইনি। গ্রামবাসীর মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে আমরা আরেকটা স্কুলে ত্রাণ দেই , বিনা বাধায় , বিনা প্রতিবন্ধকতায়। ঢাকার ফিরতি পথেই নতুন বছর শুরু হয় ।
একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় আর গানের মধ্যদিয়ে অন্ধকার চিরে ঢাকা আসতে আসতে আলোকিত আকাশ দেখতে পাই আমরা ২১ জন।
নতুন বছরের নতুন শিখে নেয়ার ব্যাপার পেলাম , রাজনীতি না করলেও রাজনীতি বুঝতে হবে, না হলে রাজনীতি আমাদের বুঝে নিবে ।
শুভকাল
কাল বৈশাখ
http://www.shapath.org
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।