যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে. ১।
এক কুয়াশাঘেরা শুভ্র সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম বললে ভুল বলা হবে। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন সায় দিচ্ছিল না। রীতিমত ঘুমের ভান করে পরে ছিলাম।
আহ! কি শন্তিই না পাচ্ছিলাম এভাবে শুয়ে থাকতে। ক্লাস না থাকায় শান্তি ডাবল মনে হচ্ছিল। তার উপর আবার আমার আব্বা এবং আম্মা দুজনেই বেড়াতে গিয়েছেন। যেন সোনায় সোহাগা। আব্বা বাসায় থাকলে অবশ্য এতটা আরাম পেতাম না।
তাই বলা যায় ট্রিপল শান্তি।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে চারিদিকে কোলাহল বাড়তে লাগলো। রিকশার টুংটাং শব্দ চারিদিকের কোলাহলকে নতুন এক মাত্রা দিয়ে যেতে লাগলো। মানুষের অবিরাম ছুটে চলা বাড়তে লাগলো। ইতিমধ্যে কুয়াশা ভেঙ্গে সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
খানিক গরম যেন মিশে আছে এর সাথে।
বেলা সাড়ে ১২ টায় লেপ + বিছানার মায়া ত্যাগ করে উঠে পরলাম। নাহ! আর ঘুমিয়ে থাকা যায় না। অনেক কাজ আছে।
২।
বিকেল ৫ টা ২০ মিনিট,
বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম। পড়ন্ত বিকেলে হাল্কা সুন্দর আবহাওয়ায় বেশ ভাল লাগছিল। পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি হাতে নিতেই কল পেলাম রাজিবের। বেশ ভাল লাগলো ওর ফোন পেয়ে। কারণ এই শালা সহজে কাউকে ফোন দেয় না।
বরং ওর কোন দরকারে আমাদেরই ফোন দিতে হয়। চরম কিপটে একটা বন্ধু সে আমাদের। তবে বেশ ভাল বন্ধু সে। যেকোন দরকারে তাকেই কাছে পাওয়া যায়। আমাদের বন্ধু মহলে সে বেশ প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ।
ফোনটা ধরেই –
রাজিবঃ কি রে ব্যাটা! খবর কি?
আমিঃ খবর তো ভালই। এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো তোর!
রাজিবঃ মাফ কর দোস্ত। অনেক প্রব্লেম চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে।
আমিঃ (শ্লেষা মিশ্রিত স্বরে) কি তোমার এত প্রব্লেম? শুনি! শালা তুমি তো ...............।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে
রাজিবঃ দোস্ত তোমার সাথে একটা কথা আছে।
বলবো?
আমিঃ বল, শুনি
রাজিবঃ আগামী সোমবার আমার বিয়ে। আমার বাসায়। সকাল সকাল চলে আসিস।
এক নাগাড়ে কথা গুলো রাজিব বলাতে আমার হজম হতে দেরি হচ্ছিল। খুব অবাক হলাম ওর কথা শুনে।
এত তারাতারি বিয়ে!
আমিঃ কি কস! মাথা কি ঠিক আছে তোর?
রাজিবঃ সব ঠিক আছে। তুই চলে আসিস। পরে কথা হবে। রাখছি আমি
ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়ার শব্দ পেলাম।
ঘটনার সত্যতা উৎঘাটনের জন্য পরের দিন সকালে ইউনিভার্সিটি যেয়ে বন্ধুদের যারা যারা রাজিবকে চিনে তাদের সবার সাথে আলাপ করলাম রাজিবের বিষয়টা নিয়ে।
ওদেরকেও একইভাবে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। অথচ আমরা কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতে পারি নি আগে ব্যপারটি। যাই হোক, হতাশ হলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিকই একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। হয়ত বাকিরাও হচ্ছিল।
৩।
সোমবার বেলা ১২ টা ঠাকুরবাড়ি লেন,
আজ বহুদিন পর এই রাস্তায় এলাম। তাও প্রায় ৫/৬ বছর পর। এত অল্প সময়ের ভিতরেই এই লেনের পরিবর্তন চোখে পরার মত। চারিদিকে পরিবর্তন দেখতে দেখতে কখন যে চলে এলাম রাজিবদের বাড়ির কাছে টের পেলাম না।
শুধু এই একটি বাড়ি আমার কাছে আগের মতই লাগলো। অন্যগুলোর থেকে বেমানান বলাই যায়। এরকম সাতপাচ ভাবতে ভাবতেই রাজিব বাসার দরজা দিয়ে জোরে হাক দিল। সৎবিত ফিরে পেয়ে দেখলাম রাজিব ডাকছে। ওর সাথে মোলাকাত করে বুঝতে পারলাম খুব খুশি সে আমি আসায়।
বিয়ে বাড়িতে ঢুকে বেশ হই হূল্লোড় করে সময় কাটছিল। রাজিব তার কাজিনদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ঘন্টা দুয়েক পরে আমাদের সব বন্ধুরাও চলে আসলো। বিয়ের বাড়ির সব কাজ আমাদের উপর দেয়া হল। বাড়ি সাজানো, বাসর ঘর সাজানো, রান্না বাড়ার তদারকি ইত্যাদি সবকিছু আমরা নিজেদের দ্বায়িত্বে নিয়ে নিলাম।
রাজিবের বাবা খুব খুশি হলেন আমাদের এই উদ্দোগে।
৪।
বিকেল ৫ টা,
বাসর ঘর সাজাচ্ছি আমি আর আমার ২ বন্ধু মিলে। হাসি ঠাট্টা করে সময়টা দারূণ কাটছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম বাসর ঘরে এক অষ্টাদশী মেয়ে প্রবেশ করেছে।
কারো সাথে কোন কথা বলছে না। শুধু বার বার আমার দিকে অপলক চেয়ে আছে। চোখে চোখ পরলে সে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বেশ কয়েকবার এই ব্যপারটি আমি লক্ষ করলেও আমার বন্ধুরা তা করে নি। শেষে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সে রুম থেকে বিদায় নিয়েছিল।
এরপর থেকে আমি যেখানেই যাই সেখানেই সেই মেয়ের আগমন ঘটতে থাকে। এটা এতটাই বেড়ে গেল যে আমার বন্ধুরাও শেষে লক্ষ করলো বিষয়টা। তবে আর যাই হোক, মেয়েটা দেখতে খারাপ না। তাই আমার মনের মধ্যে একটা আকুপাকু ভাব অনুভব করলাম।
বরের সাথে যখন কনেকেও বসানো হল একসাথে তখন স্টেজে আমরা ছিলাম।
কেউ কেউ ছবি তুলছে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এক কোনায়। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশেই সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। সে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি খেয়াল করি নি। কোন কথা না বলে শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ।
কি এমন আছে এই মেয়ের মধ্যে যে বার বার তার দিকেই আমি আকর্ষিত হচ্ছি। বা সে আমাকে দেখে যাচ্ছে এভাবে। বিয়ে বাড়ির সব ঝামেলা শেষে যখন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে আসছি তখন রাস্তার ওপারে সেই মেয়েটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম বিষন্ন বদনে। রাস্তার লাইটের আবছা আলোয় যা আমি স্পষ্ঠ দেখতে পেলাম।
৫।
২/৩ মাস পর,
পড়াশোনার প্রেশারে বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিয়মিত পরীক্ষার টেনশেনে যখন মাথা খারাপ অবস্থা তখন একদিন সকালে বাসে উঠেই চমকে গেলাম। আমি যেই সারিতে দাঁড়িয়েছি তার ঠিক পিছনের সারিতে সেই অপরিচিতাকে বসে থাকতে দেখলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনেছে সে। আমার দিকে চোখ পরতেই মুচকি একটা হাসি দিল।
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে না পেরে মাথা ঝাকালাম।
আমার গন্তব্য উত্তরা। সেই মেয়েরও হয়ত। ইতিমধ্যে পাশের সিট খালি হলে আমি একরকম তারাতারি যেয়েই বসে পরলাম তার পাশের সিটে। সে এটা দেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল একটা।
এই প্রথম তাকে এত সুন্দর করে হাসি দিতে দেখলাম।
অচেনাঃ কি ব্যপার? খুব যলদি মনে হচ্ছে?
আমিঃ নাহ! আসলে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব পা ব্যাথা করছিল।
অচেনাঃ ও আচ্ছা। বুঝেছি।
আমিঃ আপনার নামটা জানতে পারি?
অচেনাঃ হ ম ম।
আমি অহনা।
আমিঃ বাহ! সুন্দর নাম।
অহনাঃ আপনার নাম আমি জানি তাই জানতে চাইলাম না।
আমিঃ (অবাক হয়ে) কি করে জানেন?
অহনাঃ সেটা বলবো না।
আমিঃ কেন? আচ্ছা............
অহনাঃ আপনি কই যাচ্ছেন?
আমিঃ ইউনিভার্সিটি।
আপনি?
অহনাঃ আপনি যেখানে যাচ্ছেন, আমিও সেখানে যাচ্ছি।
আমিঃ রাজিব আপনার কি হয়?
অহনাঃ বন্ধু।
আমিঃ ও আচ্ছা।
অহনাঃ আমি কিন্তু আপনারও বন্ধু!
আমিঃ (অবাক হয়ে) কি করে? আমরা তো মাত্রই পরিচিত হলাম।
অহনাঃ আসলে, তুমি একটা গাধা!
আমিঃ (আকাশ থেকে পড়ার মত) কি বললেন!
অহনাঃ আরে বোকা ছেলে, আমি তোমার স্কুলের সেই অহনা।
যার জন্য তুমি ৩ বছর পিছে পরে ছিলা। একবার তো চড় ----------
আমিঃ (প্রায় ৫ মিনিট পর) আরে!! তুমি তাহলে সেই অহনা?
অহনাঃ হ ম ম। এতক্ষণে তাহলে চিনতে পারলে!!
আমিঃ (নিজেকে ধিক্কার দিয়ে) আসলে আমার স্মৃতি শক্তি এতটা ভাল নয়। আমি আসলেই লজ্জিত।
অহনাঃ (অভিমানী ভঙ্গীতে) থাক, আর লজ্জিত হওয়া লাগবে না।
ইউনিভার্সিটির সামনে বাস এসে থামার পর দুজনেই নেমে গেলাম। বিদায় জানাতে মন চাইছিল না। তারপরও বিদায় দিতে হবে। অহনার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম ওর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে।
কিন্তু পারছে না। মনের ভিতর যে একটা ঝড় হচ্ছে তার সেটা বোঝা যাচ্ছে। অবশেষে নিরবতা ভেঙ্গে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। কিন্তু কি মনে করে জানি তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই অহনার জন্য সেই স্কুল সময় থেকেই পাগল ছিলাম।
তখন সারা না পেলেও আজ বাধা নেই কোন। তাহলে কিসের এত জড়তা? কিসের এত ভয়?
মনের ভাবনাকে দূরে ঠেলে অহনাকে পিছন থেকেই ডাক দিলাম। দৌড়ে তার সামনে যেয়ে বললাম -
“তোমার হাতটা সারাজীবন ধরার অনুমতি পেতে পারি?”
অহনার মুখে একটা খুশির আভা দেখতে পেলাম। যা আমাকে আশাহত না করে আলোর পথ দেখালো। মুখে কিছু না বলে আমার হাতটা ধরে তার হাতে রাখলো।
ব্যস! আমি আমার উত্তর পেয়ে গেলাম।
বিঃদ্রঃ বছরের শেষ গল্প এটা। সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ার। ভাল থাকবেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।