আমি একজন ভাল ছেলে । রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অবাধে চলছে স্বর্ণ বন্ধকির অবৈধ ব্যবসা। রাজধানী ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, নাজিরাবাজার, আজিমপুরসহ পুরান ঢাকা এলাকায় এ ব্যবসার আধিক্য থাকলেও গুলশান, বনানী এবং উত্তরা এলাকায়ও চলছে স্বর্ণ বন্ধকির আদলে হীরা ও মূল্যবান অলঙ্কার বন্ধকির ব্যবসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারী বন্ধকির অর্থ ফেরত দিতে পারেনা বলে লাভজনক এ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
এদিকে প্রশাসনের নাকের ডগায় মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়ার এ ব্যবসা চললেও তাদের এ অবৈধ ব্যবসা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।
জানা যায়, স্বর্ণ গচ্ছিত রেখে টাকা ধার নেয়ার চলন এ দেশে বেশ পুরনো। এ ক্ষেত্রে ধার নেয়া অর্থের বিপরীতে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হয় চড়া সুদও। যুগ যুগ ধরে সারাদেশে চলছে এ বন্ধকি ব্যবসা। অথচ নেই কোনো বিধি-বিধান কিংবা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এতে সংরক্ষণ হয় না গ্রাহকের স্বার্থ।
জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় ও সংরক্ষণ করার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। পাকিস্তান আমলে ঢাকার তাঁতিবাজার ও আশপাশের এলাকায় স্বর্ণ বেচা-কেনার ডিলিং লাইসেন্স ছিল মাত্র চারজনের। ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় পরে এতে জড়িয়ে পড়ে অনেকেই। কেউ কেউ সিটি করপোরেশন থেকে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু রাজধানীতে নয়, সারাদেশের চিত্রও একই।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বর্ণ বন্ধক রেখে চড়া সুদে টাকা ধার দেয়ার ব্যবসা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব জেলায় বন্ধকি ব্যবসা জমজমাট। কিন্তু এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপদ-আপদে মানুষ বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়ে থাকে। কিন্তু সুদের চক্রে পড়ে অনেকেই সময়মতো আসল ও সুদ পরিশোধ করতে পারে না, খুইয়ে ফেলে তার সহায়-সম্পদ।
উদাহরণত উল্লেখ করতে হয়, কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জেবুনা বেগমের কথা। তিন ছেলেই বাকপ্রতিবন্ধী। কোথাও কোনো কাজ পায়না। নিরুপায় জেবুনা বেগম ছেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। একদিন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয় পুরান ঢাকার জনসন রোডের ‘নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড’-এ।
সংসারের শেষ সম্বল আড়াই ভরি স্বর্ণের গহনা গচ্ছিত রেখে ৪৪ হাজার টাকা ঋণ নেয়। এক বছর পরই সুদসহ ৪৮ হাজার টাকা পরিশোধ করে সে। এর পর কেটে গেছে প্রায় ৬ মাস। এখনও ওই প্রতিষ্ঠানটি জেবুনা বেগমের গচ্ছিত গহনা ফেরত দেয়নি। ফলে প্রতিদিন সকালে ওই বৃদ্ধা হাজির হয় প্রতিষ্ঠানটির সামনে।
সন্ধ্যায় ফিরে যান নিরাশ হয়ে, খালি হাতে। শুধু জেবুনা বেগমই নয়, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেডের প্রায় ৩ হাজার গ্রাহক তাদের গচ্ছিত স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করতে না পেরে ঘুরছে দ্বারে দ্বারে।
অপরদিকে শুধু নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানই নয়; পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার থেকে শুরু করে রাজধানীর নিউমার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জুয়েলারি দোকানের আড়ালে ‘স্বর্ণ বন্ধক’ ব্যবসার এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার তথ্য পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় টিকে থাকলেও বন্ধকি ব্যবসায় জড়িত অনেক প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায় দেশে কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকায় মহাজন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, শুধু ঢাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন অন্তত দেড় হাজার ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে অনেক ব্যবসায়ীর লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে তারা তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। গত কয়েক বছরে লাইসেন্স নবায়ন করা ব্যবসায়ীর সংখ্যা সাড়ে ৪শ’র মতো। ফলে অন্তত ১১শ লাইসেন্সের কোনো মেয়াদ নেই।
সিটি করপোরেশনগুলোতে এমন চিত্র দেখা গেলেও মফস্বলে অনেক ব্যবসায়ী স্বর্ণ ব্যবসার আড়ালে ‘থানা পুলিশের টোকেন’ নিয়ে বন্ধক ব্যবসা করছে। অবৈধ ব্যবসার কারণে স্থানীয় থানা পুলিশ, স্থানীয় মস্তানরাও ভাগ পাচ্ছে টাকার। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের চোখও এই বন্ধক ব্যবসায়ীদের দিকে।
জানা গেছে, ১৯৮৭ সালের ভোগ্যপণ্য আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্বর্ণ ব্যবসার জন্য একটি ডিলিং লাইসেন্স দেয়া হয়। এতে স্বর্ণের ক্রয়-মজুদ ও বিনিময়ের কথা বলা আছে।
প্রতি বছর ২৫০ টাকার বিনিময়ে সনদ নবায়নের সুযোগ ছিল এতে। কিন্তু ২০০১ সালের পর জেলা প্রশাসন এসব লাইসেন্স আর নবায়ন করছে না। ওই লাইসেন্সেও স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে যে কোনো হারেই সুদের ব্যবসার কোনো নিয়ম নেই।
স্বর্ণ বন্ধক ব্যবসা সম্পূর্ণ বেআইনি। সঙ্গতকারণেই গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা এবং সুদ আদায় বন্ধ করতে কঠোর নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি।
মূলত সারাদেশে অসংখ্য স্বর্ণের দোকান ব্যবসায়ের আড়ালে রমরমা সুদ বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। শতকরা ১০ টাকা করে মাসিক সুদে চক্রবৃদ্ধি হারে গ্রহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। তারা দীর্ঘদিন থেকে এ চওড়া সুদ বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। তাদের কাছ থেকে চওড়া সুদে ঋণ নিলেও বন্ধক হিসাবে টাকার দ্বিগুণ স্বর্ণ জমা দিতে হয়। গ্রামের অসহায় মানুষ তাদের সর্বশেষ সম্বল তাদের হাতে উঠিয়ে দিয়ে এ সুদ বাণিজ্যের শিকার হয়।
এক বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের ফলে বছরান্তে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে গ্রাহকের সমুদয় স্বর্ণ লোপাট করে দেয়া হয়। এ বন্ধকে কোনো ধরনের রশিদ না দেয়ার ফলে গ্রাহকদের কোন প্রমাণ হাতে থাকে না। যার ফলে বছরের বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির তথা লাখ লাখ লোককে সর্বস্বান্ত করার মাধ্যমে এ ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু এরপরেও দেশের নিরীহ নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে রক্ষার ব্যাপারে সরকারের কোনো সদয় দৃষ্টি নেই। সক্রিয় ব্যবস্থা নেই।
সরকারের আইন শুধু প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের পক্ষে। বলাবাহুল্য, এ বৈষম্য কোনোভাবেই বরদাশতযোগ্য নয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।