আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপের খোঁজে পথে পথে

শফিক হাসান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক গাজী মুনছুর আজিজকে পার্টটাইম সাংবাদিক, ফুলটাইম পর্যটক অভিধায় চিহ্নিত করলেও তার পরিচয় নির্ধারণে খুব একটা হেরফের হবে না। কারণ সারা বছরই তিনি এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে ভ্রমণ করে বেড়ান। আজ কক্সবাজার তো দুইদিন পর খুলনা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া! বিদুৎচমকের মতোই যেন তিনি এই ধরা দেন, আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যান! কাজে-অকাজে পুরো বাংলা চষে ফেরেন তিনি। বেড়ানোটা এই বাংলাপ্রেমীর সখই নয়, নেশাও। অবশ্য ‘স্বার্থপরের’ মতো তিনি ভ্রমণ আনন্দটুকু একার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেন না, ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে।

পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত তার লেখা পড়ে পাঠক অজান্তেই যেন বেরিয়ে পড়ে রূপসী বাংলার রূপের খোঁজে। এ তরুণ সাংবাদিক বছরভরই ব্যস্ত থাকেন ভ্রমণের নেশায়। অতঃপর ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ রূপ দেন বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক পাক্ষিক মাসিকের পাতায়। দেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় স্থান পায় তার লেখা। তার লেখার সিংহভাগ দখল করে আছে ভ্রমণকাহিনী, বাংলাদেশের পর্যটন।

দেখেন এবং দেখান; দেখান এবং দেখেন। আবারো দেখা এবং দেখানোর জন্য পলকে বেরিয়ে পড়তেও আলস্য করেন না। এ নিরলস চক্র চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর...। বিভিন্ন সময়ে, প্রায় ৫ বছর যাবৎ প্রকাশিত হতে থাকা ভ্রমণকাহিনীগুলো এবার এক মলাটে। ভ্রমণবান্ধব প্রকাশনা সংস্থা উৎস প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে ভ্রমণগ্রন্থ রূপসী বাংলার রূপের খোঁজে।

এটা লেখক হিসেবে প্রকাশিত তার প্রথম বইও। চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য নাম থেকেই অনুমেয়। ৪ ফর্মার বইটিতে স্থান পেয়েছে রকমারি স্বাদের ১৫টি লেখা। মুনছুরের লেখার সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সহজ কথাটি সহজভাবে বলতে পারা। কঠিন কথাকে এড়িয়ে যাওয়া।

পরিমিতি জ্ঞান তার প্রখর, আবেগ বা বর্ণনার বাড়াবাড়ি থেকেও মুক্ত। অল্পকথায় স্বল্প আয়তনে শেষ করেন ভ্রমণের আনন্দযজ্ঞ। বইটির শুরুর রচনা পাখির খোঁজে বাংলার চরে। এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের প্রথম বাংলাদেশি পর্যটক ইনাম আল হকের নেতৃত্বে প্রতিবছর বাংলাদেশে পাখিশুমারি হয়ে থাকে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এ কাজ করছেন তিনি।

তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছেন লেখক। যাত্রা শুরু থেকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো, টেলিস্কোপে পাখি দেখা এবং দিনব্যাপী পাখিশুমারির আদ্যোপান্ত ধরা পড়ে দক্ষ সাংবাদিকের কলম এবং ক্যামেরায়। পাখিশুমারি নিয়ে এ বইয়ে আরো একটি লেখা স্থান পেয়েছে-পাখির খোঁজে চরে চরে। বাংলাদেশ বার্ডস ক¬াব আয়োজিত এ শুমারির গন্তব্যস্থলও ভোলা। অবশ্য নোয়াখালীতেও নামতে হয়।

নোয়াখালীর হাতিয়ার জাহাজমারা চরে আইরিশ পাখির আধিক্য চোখে পড়ে। নোয়াখালী এবং ভোলার বিভিন্ন চরে নৌ বাহনে চড়ে যায় দলটি। এ ভ্রমণ যেন শুধু ভ্রমণকাহিনী নয় রোমাঞ্চ গল্পও! টানটান উত্তেজনায় লেখকের পিছু পিছু পাঠকও চলতে শুরু করে। সাংবাদিকতার সাথে সাহিত্যের কোনো বিরোধ নেই; বরং সাংবাদিকতায় সাহিত্যের আমেজ যুক্ত হলে সেটা পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা হিসেবে বিবেচিত হয়। সাহিত্যরসসমৃদ্ধ এ লেখা পুরোনো কথাটিকেই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ যাত্রার স্থায়িত্বকাল দীর্ঘ ৯ দিন। আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন ড. রোনাল্ড হালদার, অধ্যাপক ড. মনিরুল খান, এম এ মুহিত (এভারেস্ট বিজয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশি), সামিউল মোহসোনিন, সায়েম ইউ চৌধুরী ও পাখিপ্রেমী লেখক সীমান্ত দীপুসহ স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল কিছু মানুষ। বইয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হরিণ দেখতে নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালীর হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা পর্যটনস্পট নিঝুম দ্বীপ। এ দ্বীপকে নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।

যদিও অন্য অনেক ভ্রমণস্পটের তুলনায় নিঝুম দ্বীপে ভ্রমণ কষ্টসাধ্য। কারণ এর যাত্রাপথ বেশ ‘দুর্গম’। মুনছুরের চোখে ধরা পড়ে নিঝুম দ্বীপের রূপবিভার পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিবর্তনের ইতিবৃত্ত। নিঝুম দ্বীপ কীভাবে ‘নিঝুম দ্বীপ’ হয়ে উঠলো, শুরুটা কেমন ছিলো, বর্তমানে নাগরিক সুবিধা-অসুবিধার বিভিন্ন দিকে আলোকপাত করা ছাড়াও লেখক দেখিয়েছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর পর্যটন গুরুত্ব কতটুকু এবং কী। খ্যাতিমান মানুষদের বাড়িও হয়ে উঠতে পারে পর্যটনস্পটের মতোই গুরুত্ববহ।

এ বইতে স্থান পেয়েছে দুইজন কবির বাড়িতে ভ্রমণের কাহিনী। মহাকবি কায়কোবাদ ও পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন-এর বাড়িতেও গেছেন লেখক। কায়কোবাদের ভিটেবাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে হলেও পল্লীকবির বাড়ি সেই সুদূর ফরিদপুরে। ভ্রমণ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি লেখক দুই কবির সাহিত্যকীর্তি, বর্তমান অবস্থাসহ বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। এসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী।

তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে গাজী মুনছুর আজিজ গিয়েছেন মৌলভীবাজারে। এ ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন মুগ্ধতার সাথে। যে মুগ্ধতা সঞ্চারিত হয় পাঠকমনেও। বোঝাই যাচ্ছে এ তরুণ লেখক ভীষণ রকম কবিপ্রেমী। কারণ তিনি বাউলকবি শাহ আবদুল করিমের বাড়ি যেতেও ভোলেননি।

কবি তখনো জীবিত, তবে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। একই যাত্রায় তিনি গিয়েছেন মরমি কবি হাসন রাজা এবং রামারমণ দত্তের বাড়ি। লালনের আখড়া দর্শন নিয়েও রয়েছে এ মেধাবী লেখকের পৃথক ভ্রমণকাহিনী। এসব ভ্রমণ খুব সহজেই মনে করিয়ে দেয় তার ঐতিহ্য অনুরাগের কথা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কথাও।

সুতরাং গাজী মুনছুর আজিজের ভ্রমণকে একজন সাধারণ পর্যটকের সাথে মেলানো মোটেই ঠিক হবে না। তিনিও পর্যটক, কিন্তু শুধুই পর্যটক নন-শিকড়ের টানে অবিরাম ছুটে চলা একজন বাংলাপ্রেমিক। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে, রূপসী বাংলার রূপের খোঁজে যিনি নিয়ত পথে নামেন তাকে সাধুবাদ না দিয়ে উপায় থাকে না। সহজ-সরল কথা, সহজ সরল বাক্যে লেখা হয়েছে বইটি। আলগা পাণ্ডিত্য ফলানোর কোনো প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে না।

সহজ সরল স্বীকারোক্তি চোখে পড়ে ভূমিকাতেও- ...টুকিটাকি লেখালেখি করছি ছোটবেলা থেকেই। এখনও লিখছি। কিন্তু বন্ধুদের জানাতে পারছি না যে, আমি এখনও লিখছি। তাই কয়েকটি ভ্রমণ বিষয়ক লেখা বইয়ের এক মলাটে করা। যাতে কখনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে একটা বই তার হাতে দিয়ে বলতে পারি ‘আমি এসবই লিখি’।

চাইলে, সরল স্বীকারোক্তি না করে তিনি অন্য কিছু লেখকের মতো ভাব-মারা কথা বলতে পারতেন-তা যখন বলেননি, পাঠক হিসেবে আমরা বুঝে যাই লেখক গাজী মুনছুর আজিজের অবস্থান সৎ ও স্বচ্ছ। কোনো আলগা ভনিতা, লোকদেখানো ভাব তার মধ্যে নেই। এরকম অকপট মানুষই দেশের সমৃদ্ধ জনপদের ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি জানতে এবং জানাতে অবিরাম নেমে পড়বেন পথ থেকে পথে-বিচিত্র কী! বইটির প্রায় সব ভ্রমণকাহিনীই দেশপ্রেমের মোড়কে আবৃত-পড়তে গিয়ে উপলব্ধি করা যায়। লেখক হিসেবে গাজী মুনছুর আজিজ ইতোমধ্যে প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। ভ্রমণসাহিত্যে সিরিয়াসভাবে মনোনিবেশ করলে তিনি এখানেও সফল হবেন- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা নিশ্চয়ই অমূলক হবে না।

রূপসী বাংলার রূপের খোঁজে গাজী মুনছুর আজিজ প্রকাশক : উৎস প্রকাশন প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১০ প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান দাম : ৮০ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।