আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি অপূর্নাঙ্গ স্বপ্ন এবং সর্বস্বান্ত আমি

আমিই সেই জন, যাকে খুঁজিয়াছ অকারন... একসময় অনেক অনেক স্বপ্ন দেখতাম; রঙ্গিন স্বপ্ন। কত রঙের স্বপ্নে দু'চোখ ভারী হত- তার হিসাব কে রাখতো? লাল স্বপ্ন, নীল স্বপ্ন, সবুজ স্বপ্ন, বেগুনী স্বপ্ন, কলাপাতা রঙের স্বপ্ন- আরো কত বর্নের বর্নিল সব স্বপ্ন। অনেকগুলো রঙের নামও জানতাম না। পরে নাম জেনেছি। কিন্তু ততদিনে স্বপ্নরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

চলে গেছে হয়ত আতলান্তিকের বুকে জেগে থাকা কোন এক পাথুরে দ্বীপে। আর কখনই আমার কাছে ফিরবে না বলে। তারা হয়ত দ্বীপের সৈকতে নারকেল গাছের ছায়ায় বসে বসে রোদ পোহায়। আহার সারে লাল কাঁকড়ার কাবাব দিয়ে। তারা হয়ত একে অন্যের সাথে সঙ্গমে মাতে রাতের চাদরে; হয়তবা দিনের বেলাতেও।

মিলনে জন্ম নেয় ফুটফুটে কিছু স্বপ্ন। তারা শালদুধ খায়। কারন শালদুধে আছে পুষ্টি। এগুলো সবই অবশ্য অনুমান। তাদের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।

স্বপ্নরা যে এখনো বেঁচে আছে এটাইতো জানতামনা আমি যদি ঐদিন তার সাথে দেখা না হত। বা হয়ত জানতাম। আরো পরে। সময়টা ছিল শীতের শেষভাগ। সেদিনও গালি দিতে দিতে বিছানা ছেড়েছিলাম।

আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন কাকে গালি দেওয়া হয়েছিল, সদুত্তর পাবেন না। এমনও হতে পারে গালি দিয়েছিলাম নিজেকেই ফালতু একটা ভার্সিটিতে পড়ার জন্য। অথবা ভাগ্যকে- পড়ানোর জন্য। অথবা পাশের বিল্ডিঙের ছোকরাটাকে- অনেক রাত পর্যন্ত হাই ভলিউমে গান ছেড়ে রাখার অপরাধে। ভোরে উঠতে হয়েছিল কারন সাড়ে আটটায় ডিএলডি ল্যাব।

হাড়কাঁপানো শীতে ছয়টায় বিছানা ছাড়া আর ভাঙ্গা কাঁচের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি একই। এটাও অনুমান। কারন আমি কখনো ভাঙ্গা কাঁচের উপর দিয়ে হাঁটিনি। মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফার্মগেট ব্রিজে উঠতে যাবো, ফ্যাসফ্যাসে একটা কন্ঠে নিজের নাম শুনে ঘাড় ঘুরাই। কন্ঠটা ফ্যাসফ্যাসে ছিল এটা জোর দিয়ে বলতে পারিনা।

হয়ত সেটা ছিল ভরাট এবং গম্ভীর। আগাগোড়া চাদরে ঢাকা মূর্তির পেছন পেছন একটা গলিতে ঢুকি। সেই ভোরের নির্জনতা ছাপিয়ে গলির নির্জনতা আরো প্রকট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে নির্জনতারা কান চুলকাতে চুলকাতে পাহারা দিচ্ছিল। কোথাও কোন শব্দের ইংগিত পেলেই তেড়ে যাচ্ছিল উৎসাহে।

তার গায়ে ছিল ঘিয়া রঙের চাদর। বা লাল বা সোনালী রঙের। তার মুখের ওপর চাদরের লম্বা ঘোমটা দেয়া ছিল। মুখের যে কিয়দংশ আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল তা ছিল ফ্যাকাশে আর রক্তহীন। অথবা সজীব আর রক্তপুষ্ট।

স্মরন নেই এখন আর। সে আমার হাত দেড়েক দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিই মুখ খুলি আগে। জানতে চাই পরিচয়। -আমি স্বপ্ন।

-স্বপ্ন??!! কার স্বপ্ন??!! আমিই বা কি করতে পারি??!! বিদ্রুপ গলে গলে পড়ল কন্ঠ বেয়ে। যেখানে বিদ্রুপ পড়েছিল সেই জায়গাটা হয়ত এখনো পিচ্ছিল হয়ে আছে। -তোমার স্বপ্ন। -আমার স্বপ্ন??!! এইবার আর না হেসে থাকতে পারি না। এরপর হয়ত আমি চলে যেতাম।

ল্যাবের দেরী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু 'আমার স্বপ্ন' আমার শৈশবের কিছু স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসে। তারা দূরে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসে। হাসির আড়ালে হুংকার দেয় চাপা বিরক্তি। শৈশব স্মৃতিরা বিরক্ত ছিল।

তাদের বাস মনের এমন একটা অংশে যেটা অবচেতনের খুব কাছাকাছি। সেখান থেকে তাদেরকে তুলে নিয়ে আসায় তারা বিরক্ত ছিল। যদিও তারা হাসছিল। তবুও তাদের বিরক্তিভাব প্রকাশ পেয়েছিল রংধনুর মতো। প্রকাশভাব অল্প; কিন্তু প্রকটভাবেই প্রকাশিত।

তাদের কাছ থেকে আসা একটা গন্ধ নাকে লাগল। মনে হল এই গন্ধের সাথে আমার পরিচিত সম্পর্ক। আর কিছুই মনে আসল না। শৈশব স্মৃতিদের রঙ যে সবুজ তা জানতাম না। শীতের সকালে শিশির জমা সবুজ ঘাসের সবুজ।

বুঝলাম আমার সামনে যে দাঁড়ানো চাদরমোড়া, যার রক্তহীন বা রক্তপুষ্ট মুখের কিছু অংশ দৃশ্যমান- সে বাস্তবেই আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন এবং বাস্তবের এই মিলবিন্দু খুঁজে পেয়ে আমি যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন জানাল অনেক অজানা কথা। জানলাম ব্যর্থ সব স্বপ্নরাও এখনো বহাল তরিয়তেই আছে। জন্ম থেকে আমি ছোট-লম্বা-বাস্তব-বড়-খাটো-অবাস্তব যত স্বপ্ন দেখেছি সবার নাকি নিজস্ব সত্ত্বা আছে।

স্বপ্ন দেখার শুরুতেই সে স্বত্তাপ্রাপ্ত হয়। যতদিন স্বপ্ন দেখি স্বপ্নস্বত্তা বেড়ে ওঠে আরো পূর্নাঙ্গ হবার ইচ্ছায়। একসময় হয়ত সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। বুঝে যাই এ স্বপ্ন দেখা অর্থহীন। সে স্বপ্ন হয়ত আর দেখা হয় না।

কিন্তু স্বপ্নস্বত্তা বিলীন হয় না। সে চলে যায় আমাকে ছেড়ে। চলে যায় আগের সব ব্যর্থ স্বপ্নের কাছে। হয়ত হিমালয়ের কোন একটা পর্বতে। সেখানে হয়তবা তপস্যামগ্ন হয়।

কিংবা এভারেস্ট জয়ের প্রস্ততি নেয়। তবে যাবার আগে নিয়ে যায় কিছুটা স্মৃতি। যে স্মৃতি আমাকে একমুঠো সাহস দিয়েছিল স্বপ্নটা দেখতে। চাদরমোড়া স্বপ্ন এসেছিল একটা স্মৃতি নিয়ে যেতে। রোদেলার স্মৃতিটা।

যে স্মৃতির আলোয় আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু স্বপ্নটা দীর্ঘায়ু পায় নি। আরো অনেক স্বপ্নের মত যার স্থান হয়েছিল স্বপ্নের হিমাগারে। আর স্বপ্নস্বত্তা হারিয়ে যায় সাবেক সব স্বপ্নের ভীড়ে। কিন্তু স্মৃতিটা রয়ে যায় আমার নিউরনে যে কিনা চাদরমোড়া স্বপ্নের পিতা; আর যাকে ছাড়া চাদরমোড়া অসম্পূর্ন এক স্বপ্ন।

হয়ত সে স্মৃতি চুপচাপ নিউরনে বসে বসে পা দোলায়। হয়তবা কষ্ট সিদ্ধ করে খায়। মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে ওঠে। তার ভীষনরূপ দেখে সবাই বোবা বনে যায়। তখন তার দৌরাত্নে অন্য স্মৃতিদের অবস্থা করুন হয়ে ওঠে।

সে নিউরন ধরে ঝুলে থাকে। তখন আমার সামনে আসে খুব নিরীহ একজন। সে নিজের পরিচয় দেয় 'বিষন্নতা' বলে। সে আমাকে গিলে নেয়। এক টুকরো স্মৃতিটা শান্ত হলে আবার উগড়ে দেয় আমাকে বাস্তবতায়।

আবারও কমলা রঙের বাস্তবতা স্পর্শ করি গভীর মমতায়। কিংবা প্রবল ঘৃনায়। - সেই স্মৃতিটা তার চাই। আমি বললাম 'নিয়ে নাও। নিয়ে যাও।

' স্মৃতিটি নিয়ে সে মাথা হেট করে হেঁটে যায়। তার চাদরের এক কোনা রুক্ষ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে এগোয় তার সাথে। আর আমি ভয়াবহ সেই স্মৃতির হাত থেকে মুক্তি পেয়েও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। দীর্ঘশ্বাসে মিশে ছিল সব হারানোর বেদনা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.