আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিবেদন

লেখালেখির কারখানা হোক দীপ্তিময় জীবনের স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার মুবিনুর রহমান ---------------------------------------------------------------------- সম্ভাবনার সন্ধানে অর্থনীতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ দেশের বিশ্বজয়ী মানুষের তালিকাটা নেহাত কম নয়, যারা তাদের কর্ম, সৃজনশীলতা আর মেধা দিয়ে বিশ্বের মানুষের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। একজন মানুষ যখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অধ্যবসায় করে যায় কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় তখন সারা পৃথিবীর তাবৎ শক্তি পুঞ্জিভুত হয় তকে সাহায্য করবে বলে। শত প্রতিবন্ধকতা, চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাকে পেছনে ফেলে কিছু মানুষ ঠিকই এগিয়ে যায়, দৃষ্টি সমুখে যারা মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ দেখতে পায় তারা আসলে কোন কিছুতেই পিছপা হয় না। পথ চিনিয়ে দেয় পথের রেখা খুলনা জেলার কয়রা সাতবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল নোমান, তার বাবা একজন ক্ষুদ্র কৃষক, ৬ ভাইবোনের মধ্যে সে তৃতীয়, পড়ালেখায় প্রচন্ড আগ্রহ আর ভাল করার তাড়না তাকে এনে দিয়েছে এস.এস.সি.তে ঈর্ষণীয় সাফল্য। তার ভাষায়, এ সাফল্য ধরে রাখতে তার পরিবার, বিদ্যালয় যেভাবে সাহায্য করেছে এতে করে সে একটি লক্ষমাত্রা অতিক্রম করতে পারলেও পরবর্তী ধাপ পেরুতে তাকে চরম বাস্তবতা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

থেমে থাকেনি আব্দুল্লাহ, সে তার ভিতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলে অবিরাম রেখেছে তার পদক্ষেপ। হারতে আমার মানা বাংলাদেশে নারী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এখনও তেমন সাবলীল ও সহজ হয়নি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা জটিলতায় অল্প সময়ের মধ্যে বসন্তের পত্র পতনের মতোই ঝড়ে পড়ে অগুণতি নারী শিক্ষার্থী। সরকারি উপবৃত্তি কিংবা সামান্য সুযোগ সুবিধাগুলো শহর বা শহরতলীর শিক্ষার্থীরা ভোগ করতে পারলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের ছাত্রী বন্ধুরা বিচ্ছিন্নই থাকে এ সকল সুযোগ থেকে। তারপরেও কেউ কেউ বিজয়ের ঝান্ডা ঠিকই উত্তোলন করে উঠে যেতে থাকে সম্ভাবনার শিখরে।

এমনই অনেক শিক্ষার্থীদের মত একজন সোনিয়া আক্তার, তার বাবাও সামান্য চাকরী করেন, দারোয়ান, বেতন সর্ব সাকুল্যে ৫/৬ হাজার টাকার এক পাইও বেশি না, পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭/৮ জন, তাদের মধ্যে আবার তিন জন পড়াশোনা করছে। বাবার এই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েও সোনিয়া তার আশেপাশের মানুষের ভালোবাসা আর উৎসাহকে সঙ্গী করে যুদ্ধ করে চলেছে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। ফলাফলও সে হাতেনাতে পেয়েছে, ৫ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা ও জেএসসিতে মেধাতালিকায় নিজের নামকে অঙ্কিত করে পেয়েছে স্কলারশিপ, সেই টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে অর্জন করেছে এস.এস.সি. পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সাফল্য। যার পায়ে আলোর পাদুকা, বুকে দুর্নিবার আত্মবিশ্বাস আর মাথায় সদা জাগ্রত উদ্দিপনা তাকে হারায় সাধ্য কার। সোনিয়া এখন এগিয়ে চলেছে আলোর পথে।

আমার আলোয় রাঙাবো আমার ভবিষ্যত অনেক মানুষ আছে যারা সুস্থ-স্বাভাবিক শরীর নিয়েও অথর্বের মতো, গোঁয়ারের মতো সম্ভাবনাময় সকালকে আলস্য আর অপইতিহাসের উত্তরাধিকারপ্রাপ্তির নিকষ অন্ধকারে বিষিয়ে তোলে। আবার বিপরীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা শুধুমাত্র মনের জোড়ে, অন্তর্জগতে এক নিবিড় স্বপ্ন সাজিয়ে জয় করে অসম্ভবকে। অসম্ভবের পথে হেঁটে ছিনিয়ে আনে সূর্য সকাল। শরীরের ও পরিবারের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার আরেক সংসপ্তক সুরাইয়া আহমেদ শরীফা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মেয়ে হয়েও সে অনেকের চোখের পর্দা কেটে দিয়েছে।

জন্মের সময় সে তার বাবাকে চিরতরে হারায়, বয়স যখন ৭ মাস দূর্ভাগ্য তখন দাঁতাল নখ বসিয়ে দেয় ছোট্ট এই মেয়ের চোখের মণিতে। পৃথিবীর রং-রূপ-বৈচিত্র্য দেখার আগেই হারিয়ে যায় তার চোখের আলো। তারপরও তার দৃপ্ত উচ্চারণ ‘আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হলেও আমার মনোভাব দৃষ্টি প্রতিবন্ধির মতো না, আমি কখনো হেরে যাইনি, আমি বার বার সংকটের মুখোমুখি হয়েছি, সংগ্রাম করেছি এবং এখন আমি স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এস.এস.সি.তে সাফল্য তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে। মায়ের মুখ সে কখনো দেখেনি কিন্তু উপলব্দি করতে পারে সেখানে কত কষ্টের বলিরেখা, ভিতরে শক্তি দিয়ে শরীফার প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় নিশ্চিত সেই মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে।

বাংলাদেশের সামাজিক কল্যাণে দীর্ঘ এক দশক ধরে অবদান রেখে চলা প্রতিষ্ঠান ডাচ-বাংলা ব্যাংককের বাৎসরিক ১০২ কোটি টাকার শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্প এমন অনেক ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সংকুল পথচলায় সঙ্গী হয়েছে যা তাদের পরবর্তী ধাপগুলোতে সাফল্য অর্জনে সহায়ক হবে। দেশের জন্য অবদান রাখতে ও পড়াশোনা আরো ভালভাবে চালিয়ে যেতে এ শিক্ষাবৃত্তি তাদের জন্য নতুন বাতায়ন খুলে দিয়েছে। চোখের মাঝে স্বপ্ন অনেক ২২ অক্টোবর ২০১১, আগামী দিনের সম্ভাবনাময় মানুষ গুলো বাংলাদেশের দূর প্রান্ত থেকে এসে হাজির হয়েছে মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে। শরত শেষে হেমন্তের স্নিগ্ধ শিশির ভেজা ভোর থেকেই আস্তে আস্তে ঔজ্বল্য ছড়ানো মুখগুলো আনন্দ আর অজানা অনুভুতির মিশ্রনে মিশে যেতে থাকে একে অপরের সাথে। স্বপ্নের মায়াঞ্জন মেখে ২০১১ সালে এস.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিভিন্ন কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বর্ণিল তোড়ন পেরিয়ে প্রবেশ করে স্টেডিয়ামে।

এ দিনটিকে যেন মেধাবীদের আনন্দের রঙে রাঙিয়ে দিতে স্টেডিয়ামের চারপাশ সাজানো হয়েছে রঙ্গিন ফেস্টুন, ব্যানার আর নয়নজুড়ানো মঞ্চ দিয়ে। এখানে তারা এসেছে সমৃদ্ধির পথে আগুয়ান হওয়ার একটি ধাপ পেরুনোর প্রত্যাশায়। যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ তুলনামূলক লিবারেল আর্টস সাহিত্য, ভাষা, দর্শন, ইতিহাস, গণিত এবং বিজ্ঞান সহযোগে একটি সম্মিলিত পাঠ। লিবারেল আর্টস বা মুক্ত মানুষের বিদ্যা বা মুক্তকলাশাস্ত্র মানুষের বোধের উন্মেষ ঘটায়। মুক্তপ্রকাশ ও মুক্ত বিকাশের জন্য মানুষের দরকার স্বাধীনভাবে শিÿাগ্রহণ, যেখানে কোন কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, ও কূপমন্ডুকতা থাকবে না, সেখানে থাকবে একই সঙ্গে সাহিত্যের লালিত্য, ভাষার সৌকর্য, দর্শনের গভীরতা, ইতিহাসের সত্য, গণিতের যুক্তি এবং বিজ্ঞানের প্রামাণিকতা।

৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান দার্শনিক ম্যাট্রিনাস ক্যাপেলা ৭টি লিবারেল আর্টসকে প্রথম চিহ্নিত করেন যেখানে প্রতিটি সত্মম্ভ এক একটি শাস্ত্র বা পাঠক্রম। যারা বৃত্তি অর্জন করেছে তারা বৃত্তিমঞ্চের স্তম্ভগুলোর মতোই এক একজন আধুনিক মননশীল, যুক্তিবোধসম্পন্ন, মুক্তমনের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। তারা সৃষ্টিশীল ও মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে। যত মত তত পথ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত,এম. পি.ও ড. আতিউর রহমান যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে এ দিন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান জনাব সায়েম আহমেদ।

সেখানে অন্যান্যের মধ্যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস তাবরেজ উপস্থিত ছিলেন। প্রধান অতিথি আবুল মাল আব্দুল মুহিত তার বক্তব্যে বলেন, গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি জানান, চলতি বছর ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির জন্য ১৭ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্য থেকে ৩ হাজার ৮ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাকি ১৪ হাজার শিক্ষার্থীও মেধাবী।

এরা যাতে বৃত্তি বঞ্চিত না হয়, সে জন্য অন্যান্য সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, অনেক সুযোগ শিক্ষার জোরে অর্জন করা যায়। কাজের মধ্যে মহা আনন্দ লুকিয়ে আছে, তিনি সেই আনন্দ লাভের জন্য নিজের কাজকে ভালোবেসে তা করার আহবান জানান। বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ব্যাংকের বৃত্তিপ্রদান কার্যক্রমের প্রশংসা করেন এবং বলেন, দেশের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের ডাচ-বাংলা ব্যাংক অব্যাহতভাবে যে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে তা মূলত দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। তিনি জানান, গত বছর (২০১০) ব্যাংকগুলো শিক্ষাখাতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

এর মধ্যে একটা বড় অংশ ব্যয় করেছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিজেদের এক একজন দায়িত্ববোধ ও মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কঠিন পরিশ্রম করার জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের আহবান জানান। দায়ের প্রতি আবদ্ধতা অনুষ্ঠানে সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান সায়েম আহমেদ বলেন, ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুধুমাত্র ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রসারই নয় পাশাপাশি মানুষ, মানবতা তথা সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিপালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। অনুষ্ঠানে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের মধ্যে ৩০,০০০ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ জন্য প্রতি বছর তাদের ব্যয় হবে ১০২ কোটি টাকা।

২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি মোট ৬ হাজার ৯১৫ জন শিক্ষার্থীকে ১৯ কোটি টাকার বৃত্তি দিয়েছে। আলোচনা ও অনুভূতি প্রকাশ পর্ব শেষ হলে প্রধান অতিথি বৃত্তিপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে বৃত্তিপত্র বিতরণ করেন প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও বিশেষ অতিথি গভর্নর আতিউর রহমান। শেষের পদধ্বনি, শুনি ঐ আগমনী সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচী সমাজ বিনির্মাণে এবং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রকাশের একটি চমৎকার ব্যবস্থা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ একটি অনন্য সাধারণ উদ্যোগ। কেননা এতে করে ভবিষ্যত প্রজন্ম সংবেদনশীল, বোধসম্পন্ন ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তারা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি বার্ষিক শিক্ষা বৃত্তি কার্যক্রম দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা করছে যা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। যা দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজ উন্নয়নের এই কার্যক্রম এগিয়ে যাক, এখানে পথের শুরু, পথ হোক অনিঃশ্বেষ, এ বৃত্তি হোক দীপ্তিময় জীবনের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। নভেম্বর ২০১১ ‘সাপ্তাহিক’ এ প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.