আমরা প্রসঙ্গক্রমে হরহামেশা স্বাধীনতাযুদ্ধের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, সেই সূত্রে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার উপলক্ষে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার কথাও বলি। সম্প্রতি শাহবাগ মঞ্চের উদ্যোক্তা তরুণদের একটি ঘোষিত দাবি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিষয়টা নিয়ে সভা-সমাবেশে-স্লোগানে যতটা তোলপাড় চলে, সে তুলনায় দৈনিক পত্রের লেখায় টিভি চ্যানেলের আলোচনায় প্রকাশ অপেক্ষাকৃত কম।
কেন? এর কারণ কী বিষয়টি নিয়ে আইনি তর্ক-বিতর্কের জটিলতা নাকি অন্য কোনো তাৎপর্য এর পেছনে কাজ করছে। এ পর্যন্ত একজন আইনজ্ঞ সাংবাদিক বন্ধুই দেখছি এ বিষয়ে নিরলস শ্রমসাধ্য চর্চা করে চলেছেন।
পুরনো সাক্ষ্যসাবুদ, অনলাইনের তথ্যাদি নামিয়ে এনে ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশ- এই ত্রিদেশীয় সুপ্রিম কোর্টের নজির তুলে এ দেশে জামায়াত রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছেন নিরপেক্ষ গবেষকের মতো।
সব কিছুর সূত্রে একটি বিষয় মানতেই হবে, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত জামায়াত রাজনীতি বা ধর্মীয় রাজনীতির প্রশ্নে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদের আশ্রয় নিয়েছি, সুবিধাবাদীর মতো আচরণ করেছি। রাজনৈতিক আপাত সুবিধার জন্য ধর্মবাদী, সম্প্রদায়বাদী জামায়াতকে সহযোদ্ধা হিসেবে সঙ্গে নিয়ে চলেছি, রাজপথে যথারীতি স্লোগান তুলেছি... 'নিপাত যাক' বা 'ধ্বংস হোক'।
একবারও ভেবে দেখিনি বামপন্থী বা গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে মতাদর্শ বিচারে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শের কতটা প্রভেদ। প্রভেদ এতটাই যে তা ছিল পাহাড় ডিঙানোর মতো।
জামায়াতি তাত্তি্বকরা যেভাবে অন্য সব আদর্শের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সেভাবেই তাদের নীতিনির্ধারণ করে চলে, আমাদের গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী বা বামপন্থীরা তা করেছিলেন বা এখনো করেন বলে মনে হয় না। করলে রাজনীতির সংসদীয় যাত্রায় বেশ কিছু ভুলের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত। এক সময় ঢাকা শহরের দেয়ালগুলো রাজনৈতিক স্লোগানের ক্যানভাস হয়ে উঠেছিল। পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের জ্বলজ্বলে বর্ণমালা। বর্তমান শাপলা চত্বরের খানিকটা উত্তরে একটি হলুদ দোতলা দালানের দেয়ালে খুব উঁচুতেই নানা স্লোগানের মধ্যে একটি 'মওদুদির চিন্তাধারা বিশ্বকে আজ দিচ্ছে নাড়া।
'
কে এই মওদুদি- যার পুরো নাম আবুল আলা মওদুদি, নামের প্রথমে অবশ্য মওলানা শব্দটি সর্বদা উপস্থিত থাকে। ইসলামী রাজনীতির বিশেষ ধারার রূপকার হিসেবে বিভাগপূর্বকাল থেকে পরিচিত মওদুদি ও তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন। আল্লামা মাশরেকির বেলচাধারী অনুসারী খাকসারদের মতো পোশাকি চেহারায় জঙ্গি না হলেও মওদুদির চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত কট্টর জঙ্গি সংগঠনটির নাম জামায়াতে ইসলামী। মওদুদির লক্ষ্য তাঁর নিজস্ব চিন্তার ইসলামী রাষ্ট্র গঠন।
এদের স্ববিরোধী রাজনীতির খবর একালের মানুষ বোধহয় কমই রাখে।
চল্লিশের দশকের শেষ দিকে আল্লামা মাশরেকির মতোই মওদুদিও সম্ভাব্য খাস পাকিস্তানে বসেই জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তেমনি ছিলেন কাদিয়ানি তথা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘোর শত্রু হিসেবে বিবেচিত। মওদুদির হাতে সূচিত কাদিয়ানিবিরোধী দাঙ্গার উন্মত্ততা বন্ধ করতে সেনাবাহিনী তলব করতে হয়েছিল পাকিস্তান সরকারকে।
আর সে হত্যাকাণ্ডের দায়ে বিচারে মওদুদির মৃত্যুদণ্ড; যদিও তা রাজনীতির খেলায় শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। এখনো পাকিস্তানে কাদিয়ানিদের অমুসলমান ঘোষণার আন্দোলন এবং সেই সূত্রে দাঙ্গার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে জামায়াত।
তেমনি রেখেছে একদা পূর্ব পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে। মওদুদির পরবর্তী লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগের সঙ্গে একটা বাহ্য সম্পর্ক রেখে ইসলামী জিহাদের স্লোগান তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি ব্যাপক জনসমর্থন না থাকার কারণে। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিরোধিতার কারণেও।
আর এই মওদুদি শিষ্যরাই কি না তাদের একদা বিরোধিতা ভুলে গিয়ে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান রক্ষার উন্মাদনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশ-বিরোধিতার শপথ নেয়, জান কোরবানির ঘোষাণ দেয়।
দেশপ্রেমী মানুষের রক্তে আস্তিন ভিজিয়ে লাল করে, লাঞ্ছিত নারীর আর্তনাদে ইসলাম মুক্তি পায়, আর গোলাম আযম-নিজামী গং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তাঁদের ঘাতক ক্যাডার বাহিনী আলবদর, আলশামস পৈশাচিক নির্মমতায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তাদের হামলায় মানুষজনসহ ঘরবাড়ি পোড়ে, দোকানপাট, সম্পত্তি বেদখল ও তরুণী-যুবতী লোপাট হয়। সব কিছুই ধর্মের নামে, ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার পবিত্র দায় পালনে।
এসব অমানুষিক বর্বরতা যদি অপরাধ না হয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের হিসেবে এর চেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধ আর কী হতে পারে।
মানবসমাজের সেই নিকৃষ্টতম অপরাধ খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কারণে অপরাধীদের শাস্তির রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির যখন স্বরূপে ফিরে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুরূপ তাণ্ডব চালায়, হামলা চালায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর, তখন সেই পূর্ব অপরাধ নতুন প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বর্তমান অপরাধীদের তালিকা।
তাদের প্রধান জোট শরিক নেতা-নেত্রী যতই গণহত্যার দায় ভিন্ন দিকে চালিত করার চেষ্টা করুন না কেন, একাত্তরের স্বজন হারানো মানুষ, বর্তমান হামলার শিকার মানুষ তারুণ্যের আয়োজিত গণজাগরণের প্রভাবে ও উদ্দীপনায় সহৃদয় জনসমর্থন পেতে থাকবে, জামায়াতি অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির পক্ষে যুক্তির শৃঙ্খল তৈরি হবে। শাস্তি তাদের পেতেই হবে। এটা সাধারণ মানুষের দাবি।
কিন্তু জামায়াত-রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখন যেমন আইনি জটিলতার কথা উঠছে, তেমনি উঠছে তাদের সংগঠিত শক্তি, সামর্থ্য ও তিন দশকে গড়ে তোলা অর্থনৈতিক-সাংগঠনিক ক্ষমতা ও বিদেশে তৈরি সমর্থক নেটওয়ার্ক, তদুপরি মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর ইসলামপন্থী দেশগুলোর সাহায্য-সমর্থনের কথা। দুর্বোধ্য কারণে আন্তর্জাতিক মহলের শক্তিমান প্রধান যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় রাষ্ট্র-গোষ্ঠী গণতন্ত্রের নামে তাদের বিচার নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছে। তুলছে জামায়াত নিষিদ্ধ করার সরকারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও। তাই সরকারও ধীর পায়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছে।
এদের গণতন্ত্রের চরিত্র মহিমা বোঝা মুশকিল।
কারণ যে গণতন্ত্র গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির মিথ্যা অজুহাতে নেহাত রাজনৈতিক স্বার্থে যৌথ আগ্রাসন চালিয়ে ইরাকের মতো প্রাচীন সভ্যতার দেশকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে ফেলতে পারে, যেখানে মৃত্যু ও রক্তপাত প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেই গণতন্ত্রের মাপকাঠি মানবিক চেতনার সমান্তরাল নয়। তেমন গণতন্ত্রের প্রতি যুক্তিবাদী মানুষের আস্থা থাকার নয়।
তবু পরাশক্তিকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস আমাদের শাসনযন্ত্রের নেই, তেমন দৃঢ় মেরুদণ্ড গড়ে ওঠার এখনো অনেক বাকি। তাই আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি কথিত আন্তর্জাতিক বিবেচনাও আমাদের মতাদর্শগত বিচারে দুর্বল শাসনযন্ত্রকে তাড়া করার সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদী রাজনীতির ঊর্ধ্বেও এসব হিসাব-নিকাশ ঠিকই বিবেচ্য মনে হবে।
আমাদের রাজনৈতিক আচরণের ধারাবাহিক স্ববিরোধিতাগুলো সম্ভবত তেমন প্রমাণ বহন করে।
ধর্মীয় চেতনার দিক থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতি যে কত স্ববিরোধিতার উদাহরণ রেখেছে পঞ্চাশের দশক থেকে অগ্রসর যাত্রার ঘাটে ঘাটে তার প্রমাণ ছড়ানো। তাই ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে রচিত যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহার একুশ দফা গণতন্ত্র ও সমাজবাদী আদর্শের রূপরেখা ধারণ করেও বিশেষ ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তাই 'নীতি' হিসেবে শিরোধার্য করেছে এমন বাণী : 'কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে। ' এখানে গণতন্ত্রের বদলে একক ধর্মতন্ত্রই বড় হয়ে উঠেছে।
এভাবে আমাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই স্ববিরোধিতা আমাদের গ্রাস করেছে একুশ দফার গণতান্ত্রিক চারাগাছের শিকড় কাটার মতো করেই। এটাকে কেউ কেউ স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ শাসনে কৌশলগত দিক হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। হতে পারে। কিন্তু নীতির দিক বিচারে এটা তো নিশ্চিত আপসবাদ। আর এ আপসবাদিতা পরবর্তীকালেও রাজনীতিতে বহুলদৃষ্ট ঘটনা, যা সুবিধাবাদে পরিণত হয়ে একুশ শতক অবধি প্রসারিত।
নানা যুক্তিতে এসব ঘটনা জায়েজ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা ও আপসবাদ জামায়াত সম্পর্কেও দেখা গেছে। দলবিশেষের বদৌলতে তারা ক্ষমতার অংশীদারও হয়েছে। এখনো তারা কথিত জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ, যে জোটের প্রধান দলে রয়েছেন এবং ছিলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা, বামপন্থী রাজনীতিক ও কিছুসংখ্যক বীর সেনানি। এ-ও এক বিস্ময়কর স্ববিরোধিতা, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অবাঞ্ছিতকেও বাঞ্ছিত করে তুলেছে।
এরাই তো জামায়াত নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা।
তাই তারুণ্যের 'আলটিমেটাম' মাথায় রেখেই যেমন শাহবাগ মঞ্চের, তেমনি দেশের অসাম্প্রদায়িক শক্তির কাজ হবে জামায়াত-শিবিরের মতো অপশক্তিকে রুখতে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তোলা, সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বিচ্ছিন্ন করার মতো নীতি অনুসরণ করে জনসচেতনতা গড়ার বাস্তবিক কাজে আন্তরিক হওয়া। কাজটা কিছু সময়সাপেক্ষ হলেও তা জামায়াত নিষিদ্ধ করার বড় উপায় হয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে চলতে থাকুক আইনি প্রক্রিয়া তার ফাঁকফোকর নিয়ে। আমার আশঙ্কা, আগামী নির্বাচনে জামায়াত না আবার তার প্রধান সহযোগীকে নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
সে ক্ষেত্রে আইনি প্রচেষ্টা মাঠে মারা যাবে। তখন এক মাত্র ভরসা তারুণ্যসহ ব্যাপক জনসমর্থন। আহমদ রফিক এর কলাম থেকে, কালের কণ্ঠ পত্রিকা থেকে নেওয়া। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।