ঘুরে আসলাম হাম হাম। খুবই রোমঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ইদানিং সিলেটে গেলে রুটিন করেই স্কুল জীবনের বন্ধুরা প্রতিদিন আড্ডা দেই। এবার ঈদের ছুটিতে মোটামুটি সবারই দেখা হলো। সন্ধ্যাবেলার আড্ডায় হটাৎই প্রস্তাব উঠলো হামহাম দেখে আসবো।
যেই ভাবা সেই কাজ। পরদিনই যাওয়া হবে। এই দিক দিয়া নীলমনি বস। দুরন্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সে। আমার মনে হয় সে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
বলার সাথে সাথেই মাইক্রো রিজার্ভ করে ফেললো। চোখের নিমিষে। ঈদের পরদিন অনেক স্বল্প খরচে। যা আমাদের যেকোনো কারো পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। হাম হামের রা্স্তা খুবই খারাপ হওয়ায় সাধারণত কোনো মাইক্রো যেতে চায় না।
ঠিক হলো পরদিন সকাল ৭ টায় রওয়ানা হবো। নীলমনির বাসা থেকে রওয়ানা হবো সবাই। ঘুম থেকে উঠলাম ৬ টায়। জনি আর আমি নীলমনির বাসায় পৌছালাম বেলা ৭.১৫ মিনিটে গিয়া দেখি ঐখানে অলরেডি কল্লোল আর নান্টু। তারা আগের দিন রাতেই আসছে ।
সবগুলা ঘুমাচ্ছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে। দেখেই মেজাজ খারাপ। রাতে ঐ গুলা কেউ ঘুমায় নাই। অনেকদিন পরে ওরা ৩ জন একসাথে হওয়ায় সারারাত আড্ডাবাজি করে কাটিয়েছে। আমরা গিয়া ওদের উঠাইলাম।
ওর বাসা সুরমা নদীর পাশে হওয়ায় ওরা উঠে রেডি হতে হতে আমি আর জনি এক ফাঁকে সকাল বেলার সুরমার হাওয়া খেয়ে আসলাম । সঁকাল বেলা অসাধারন লাগে সবকিছু।
মাইক্রো ছাড়লো ৮.৩০ টার দিকে। একটু দেরীই হয়ে গেছে। এর মধ্যে খেয়াল হলো আমার ব্যাগ নিয়ে আসে নাই কল্লোল আর নান্টু যেটা রেখে আমি হাওয়া খাইতে গেছিলাম ঐটার মধ্যে আবার আমার ক্যামেরা, জামা কাপড় সবকিছু।
নীলমনি গেলো আবার ব্যাগ আনতে দেরী হয়ে গেলো আরোও।
মজার ব্যাপার হলো আমরা যে কয়জন ছিলাম তারা এর আগে কেউ ই হামহামের রাস্তা চিনে না। ভাবছিলাম হয়তো ড্রাইভার চিনে। গাড়িতে উঠার পরে শুনি সে ও চিনে না। ।
অবশ্য আমার কোনোই টেনশন হচ্ছিলো না। সাথে নীলমনি আছে। সে থাকলে সবকিছুই সমাধান হবে । কমলগঞ্জ পর্যন্ত সবাই চিনে। কিন্তু এরপরে কোনদিকে তা জানে না কেউ।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য চারদিকের লোকজনরে জিজ্ঞেস করতে করতে আমরা মাইক্রো চলার শেষ রাস্তা পর্যন্ত পৌছাইলাম। দুনিয়ার বাজে রাস্তা। ড্রাইভার তো মহা বিরক্ত। মুখে তার একই কথা। আর জীবনে সে এই রাস্তায় যাবে না।
আমরা ও বিরক্ত ঝাকুনি খাইতে খাইতে। চা বাগানের ভেতরের উচু নিচু রাস্তা দিয়া যেতে যেতে।
অবশেষে নামলাম মাইক্রো থেকে। এবার শুরু আসল আডভেঞ্চার। ২ ঘন্টার হাটা।
বনের ভেতর দিয়ে... ছড়ার মধ্যে দিয়ে.... হাটু পানি.. ঘেটু পানি..... টিলার উপর দিয়ে যাইতে হবে আমাদের হামহাম দেখতে। আমরা যখন হাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন প্রায় পৌনে ১ টা বাজে। অনেকেই তখন ফেরত আসছিলো। আমাদের দেখে সবাই একটু বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করছিলো..... "এখন যাচ্ছেন.. ফেরত আসতে পারবেন তো?" সন্ধ্যা হয়ে গেলে ঐখান থেকে ফেরাটা সত্যি প্রায় অসম্ভব। কথা শুনে তো প্রথমে একটু খানি ভয়ই পেয়েছিলাম।
ভয় টা আরো গাঢ় হচ্ছিল সত্যি যখন আমরা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। জায়গা টা নতুন আবিস্কার হওয়ার লোকজন বেশি জানে না। তাই রাস্তাঘাট ও নেই।
জঙ্গলের শুরুতে রাস্তা ভালো। আমরা ২০ মিনিটের মতো হাটার পর ছড়ার দেখা পেলাম।
ছড়ার মধ্যে দিয়ে হাটতে হবে অ্যাডভেঞ্চার। জুতা খুলে রাখলাম ব্যগে। মনে হইলো অনেক মজা ছড়ার পানির মধ্যে দিয়ে হাটা। টের পাইলাম একটু পরে যখন পিচ্ছিল পাথর আর কাঁদার মধ্যে দিয়ে হাটা শুরু হলো। একেকজন হাটে আর আছাড় খায়।
পিছলা খাইয়া পড়ে। টেনশন হচ্ছিলো তখন ব্যগে থাকা ক্যামেরাটা নিয়ে ব্যাগ সহ যদি পানিতে পড়ি তাহালে সাধের ক্যামেরা বেচারার ইন্নালিল্লাহ। কি আর করা অতি সাবধানে হাটতে লাগলাম।
কিছু কিছু জায়গায় বাঁশ কেটে সাঁকোর মতো তৈরী করা হয়েছে। ছড়ার বেশির ভাগ জায়গায় কাঁটা বাশ তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
অনেক সময় কাটা বাঁশের ছোটো ছোটো কঞ্চি পায়ের মধ্যে ঢুকে যেতে লাগলো। সঞ্জয়ের তো পা কেটে ছেড়াবেড়া অবস্থা। বেঁচারা লেংচাতে লেংচাতে হাটতে লাগলো।
বনের মাঝে দেখা পেলাম বানরের। প্রথমে একটু সাঁপের ভয়ে ছিলাম।
কিন্তু সাঁপ নাই বলে শান্তি পেয়েছি। অনেক গুলা কাঠবিড়ালীর দেখা পেয়েছিলাম। অদ্ভুত একধরনের পোঁকা দেখলাম। ঠিক দেখলাম না , শুনলাম। কান ফাটানো অতি সু্ক্ষ শব্দ।
মাথা ধরে যাচ্ছিলো। খুব সম্ভবত বাঁশ গাছে থাকে এরকম কোনো পোঁকা।
আমাদের আশপাঁশে অনেক লোকই ছিলো। যারা আমাদের মতোই হামহামের দর্শনার্থী। একটা গ্রুপের দেখা পেলাম।
ওরা ৫-৬ জনের মতো। একজন ওদের লিডার টাইপের। বেশি পাকনামি করছিলো। আর সবাইরে বার বার সতর্ক করছিলো। অন্যরাও ওকে ফাইজলামি করে এম.পি এম.পি বলছিলো।
তো আমরা একটা প্রচন্ড পিচ্ছিল বাঁশের সাকো পার হচ্ছিলাম। সাঁকো নীচেই অনেক বড় একটা খাঁদের মতো। মোটামুটি গভীর। সাবধানেই পার হইলাম। হটাৎ শুনি ধাপাস করে পানিতে পড়ার শব্দ।
পেছনে তাঁকিয়ে দেখি সেই এম.পি বেচারা পানির মধ্যে। অনেক কস্টে শেষ পর্যন্ত তাকে টেনে হিচড়ে উপরে তোলা হলো। এর পর থেকে যতক্ষন পর্যন্ত তারে দেখেছিলাম তার মুখে কোনো কথা ছিলো না।
মাঝখানে একটা টিলা পাড় হতে হয়। প্রায় ঘন্টাখানেক হাটার পড়।
টিলা পাড় হতে গিয়া তো সবার অবস্থা কাহিল। অনেক খাঁড়া। উঠার পরে সবাই হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস নেওয়া শুরু করলাম। মাঝখানে অনেক জায়গার মাটি দিয়ে পানির প্রবাহ হতে হতে মাটি অনেকটা পাথরের মতো হয়ে গেছে। এর মধ্যে দিয়ে হামহাম থেকে বয়ে আসা সচ্ছ পানি।
অসাধারন দেখতে। দেখলাম একটা গ্রুপ মনিপুরী অল্পবয়সী। তারা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে পানির মধ্যে শামুক আর ছোট ছোটো মাছ ধরা শুরু করে দিলো। ইচ্ছা হচ্ছিলো আমরাও ধরি। কিন্তু দেরী হয়ে যাবে বলে হামহামের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম।
কারন তখনো অনেক পথ বাকী।
পথে একধরনের ফুল পড়ে থাকতে দেখলাম। জঙ্লী কোনো ফুল। অনেক সুন্দর। সাদা আর বেগুনী মিশ্রন।
ছবি তুলতে পারি নাই। কারন এমন পিচ্ছিল জায়গা ছিলো ক্যামেরা বের করার সুযোগ মিলেনি। বের করলে হয়তো বা ক্যামেরা সহই আছাড় খেয়ে পড়তাম।
হাটতে হাটতে এমন একটা জায়গায় পৌছাইলাম মনে হৈলো যেন এখানে কখনো সুর্যের আলো আসে নি। বেলা ৩.৩০ টার দিকে ঐখানে অনেক অন্ধকার।
ঘন জঙ্গল। অনেক রোমাঞ্চকর ছিলো। এর মাঝে নাম না জানা পাখির ডাক আর সাথে সেই কান ফাঁটানো বাঁশ পোকার তীক্ষ শব্দ।
অবশেষে পৌছাইলাম সেই কাংখিত স্থানে। অসাধারন লাগলো।
যদিও ঝরনাতে পানির প্রবাহ অনেক কম ছিলো। শীতের শুরু বলে পানি ও কম। তবুও ভালো লাগলো। তবে সত্যি বলতে কি, আমার কাছে হামহাম ঝরনার চাইতে ওর কাছে পৌছানোর রাস্তাটাই অনেক ভালো লেগেছে। প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা, ছড়ার মধ্যে দিয়ে বাঁশের লাঠি দিয়ে পানির গভীরতা মেপে মেপে পথ চলা।
পানির নীচে গর্ত আছে কিনা লাঠি দিয়ে তা দেখে দেখে যাওয়া। পিচ্ছিল বাঁশের সাকো দিয়ে সাবধানে পাড় হওয়া। সব কিছু অসাধারন লেগেছে।
সিলেটের বেশীর ভাগ লোকেরা একটু আরাম প্রিয়। তাই আমাদের সহযাত্রীদের অনেকের মুখেই শুনতে পেলাম আর তারা জীবনে হাম হাম যাবে না।
এতো কস্ট করতে পারবেনা। অনেককেই বলতে শুনলাম কাউরে শাস্তি দিতে হলে হাম হাম পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার কাছে এই কষ্ট টাকেই অসাধারন মনে হয়েছে। এরকম কস্ট আমি প্রতিবার করতে রাজি আছি।
ফেরার সময় সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছিলো।
সন্ধ্যার আগে একটু ভয় ভয় করছিলো। কারন অন্ধকার হয়ে গেলে ঐ খান থেকে ফেরত আসাটা অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত আমরা ফেরত আসতে পেরে ছিলাম সন্ধ্যার আগেই। পরের বার গেলে অনেক সকালে রওয়ানা হতে হবে। ভোর থাকতেই ।
তাহলে অনকেক্ষন দেখা যাবে সব কিছু ভালো করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।