লোকালয় আর শহর থেকে দূরে, যাওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
এই জলপ্রপাত সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা খুব বেশি দিনের নয়। পরিচিত একজনের কাছ থেকে গল্প শুনেছিলাম। তারপরই এই জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার ভূত মাথায় চাপলো। অবশেষে বন্ধুদের রাজি করানো সবকিছু ঠিকঠাক করা থেকে শুরু করে যাতায়াতের সব খোঁজখবর নেওয়া শেষে একদিন ছুটে গেলাম হামহামের পথে।
কমলগঞ্জের একেবারে শেষ গ্রামের নাম কলাবনপাড়া। তৈলংবাড়ি নামেও জায়গাটি পরিচিত। বলতে গেলে এরপর থেকেই আর তেমন কোনো জনবসতি নেই। আর এখান থেকেই শুরু হয় হামহাম যাওয়ার আসল অ্যাডভেঞ্চার।
চারদিকে ঘনজঙ্গল।
বিশেষ করে প্রচুর বাঁশবন। বেয়ে উঠছি ছোটবড় পাহাড়। আবার কখনও বেশ খাড়া পথ বেয়ে নিচে নামতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। তারপরেও মনে আনন্দ, নতুন জায়গা আবিষ্কারের নেশায় আত্মহারা।
অনেকটা পথ যেতে হচ্ছে হিমশীতল ঠাণ্ডা পানির ঝিরি পথ ধরে। পুরো জায়গা জুড়ে কেমন যেন সুনসান নীরবতা। অনেকটা কাচের ঘরে আটকে থাকলে যেমন লাগে অনেকটা সেরকম। তবে মাঝে মাঝেই খুব কাছে কখনও দূর থেকে ভেসে আসছে অচেনা পাখির মিষ্টি কণ্ঠের গান।
পাহাড়ের গায়ে হালকা বিশ্রাম নিতে নিতেই দেখে নেওয়া যায় অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি।
চোখ জুড়ে থাকে মাতাল করা সবুজে ঘেরা চারপাশে। ঘামে ভেজা শরীর ঝিরির পানিতে ভিজিয়ে সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। পিচ্ছিল পাথুরে পথ, সাবধানে পা ফেলতে হয়। এভাবে প্রায় অনেকটা সময় হাঁটার পর হঠাৎ শুনতে পেলাম এক শিহরণ জাগানিয়া শব্দ। সেই কাঙ্ক্ষিত হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ।
মনে হল এইতো এসে পড়েছি। একটু ভালো করে উঁকি দিলেই দেখা যাবে জলধারা।
হামহাম জলপ্রপাত তবে আমাদের আরও কিছুটা পথ যেতে হল তার দেখা পেতে। অনেকটা কাছে গিয়ে যখন সোজা তাকালাম প্রায় ১৬০ ফিট ওপর থেকে নেমে আসা জলরাশির সেই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য দেখে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। প্রবল ধারায় উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি।
চারদিকে কেমন জানি হিমশীতল পরিবেশ। এক নাগাড়ে ঝরনার পানি পড়ে যাচ্ছে ছোটবড় পাথরের ওপর। তাতেই তৈরি হচ্ছে এক কুয়াশাময় পরিবেশ। হাঁটুগেড়ে বসে সেই পরিবেশ উপভোগ করলাম অনেক্ষণ ধরে।
হামহাম জলপ্রপাত
একদিকে পাহাড়ে ঘেরা বনজঙ্গল আর অন্যদিকে অবিরাম বয়ে চলা জলরাশি পাথরের খাঁজে খাঁজে ঢেউ খেলে যাওয়া পানিতে ব্যাঙ আর ব্যাঙাচির মেলা।
বনজঙ্গলের মায়া ছেড়ে আসতে আমাদের একটু বেশিই সময় লেগে যায়। যদিও সন্ধ্যার আগেই চলে আসা উচিৎ। তবে সেদিন যে ছিলো জ্যোৎস্নায় মাতাল হওয়ার দিন। দূর পাহাড়ের গায়ে বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষলতার ফাঁক দিয়ে গলেগলে পড়ছে চাঁদের আলো। এরকম জ্যোৎস্না স্নানের উৎসব এ জীবনে একবারই হয়তো আসে...।
আসলে এই অনুভুতি ভাষায় বা লেখায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু উপলব্ধি করতে হয়। আর সেই বোধের স্বাদ পেতে যেতে হবে হামহামের পাদদেশে।
পিচ্ছিল পাথুরে পথ যেভাবে যাবেন
পিচ্ছিল পাথুরে পথ
ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। ভাড়া ৪০০-৪৫০ টাকা।
এছাড়া শ্রীমঙ্গল থেকেও যাওয়া যায়। মৌলভীবাজার থেকে যেতে হবে কমলগঞ্জ। সেখান থেকে আদমপুর বাজার, বাস ভাড়া ১৫-২০ টাকা। এখান থেকে ২০০-২৫০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারেন আদিবাসী বস্তি তৈলংবাড়ি বা কলাবনপাড়ায়। এরপর হাঁটা রাস্তা।
প্রায় ৮ কিলোমিটারের মতো পাহাড়ি পথ শেষে হামহাম ঝর্ণার দেখা মিলবে। তবে যেখান থেকেই যাওয়া হোক, কলাবনপাড়ার দিকে অবশ্যই সকালে রওনা হতে হবে।
যেখানে থাকবেন
থাকার ব্যবস্থা বলতে যাওয়ার আগে শ্রীমঙ্গলে এক রাত থেকে পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে শ্রীমঙ্গল ফিরতে পারেন। তবে ওই সময়টায় ফেরার সম্ভাবনা খুব একটা বেশি থাকেনা। সেক্ষেত্রে আদিবাসীদের বাড়িতে থাকা যায়।
যদি শ্রীমঙ্গল ফেরা না যায় তবে দুঃচিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা তৈলংবাড়ি বস্তি বা কলাবনপাড়ায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
সাবধানতা
যাওয়ার আগে অবশ্যই কলাবনপাড়ার স্থানীয়দের কাছ থেকে ভালো-মন্দ জেনে যাওয়া উচিৎ। সঙ্গে সরিষার তেল আর লবণ রাখতে হবে। কেননা প্রচুর জোঁকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই দুটি ব্যবস্থাই কার্যকরী।
হাতে একটা ছোট বাঁশের টুকরা বা লাঠি সঙ্গে নেওয়া ভালো। এতে পাহাড়ি পথে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা থেকে শুরু করে সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপদ রাখবে।
সঙ্গে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর খাবার স্যালাইন রাখতে ভুলবেন না। জীবাণুনাশক ক্রিম আর তুলা সঙ্গে নেবেন। আর খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
খরচ
৪-৫ জনের গ্রুপে খরচ হবে মাথাপিছু ৩ হাজার ৫শ’ টাকার মতো।
ছবি : লেখক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।