মেক্সিকান ছবির ইতিহাসের কথা বললে মূলত ১৯৩০ এ দশক থেকে শুরু করতে হয়। এই সময়টাকে মেক্সিকান ছবির স্বর্ণযুগ বা গোল্ডেন এজ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই সময়টাকে মেক্সিকান ছবির সুবর্ন সময়। অ্যান্তনিও মরেনোর সান্তা ছবিটি মেক্সিকোর প্রথম সবাক ছবি বলা যেতে পারে।
বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মেক্সিকোর ছবি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
আউট অব দ্য র্যাঞ্চো গ্রান্ডে ছবিটি এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ছবি। এটি মূলত রোমান্টিক ড্রামা ঘরানা ছবি। ছবিটির পরিচালক ফার্নান্দো দে ফুয়েন্তে।
১৯৩০ সালে সোভিয়েত ডিরেক্টর সের্গেই আইজেনস্টাইন মেক্সিকো সফরে গিয়েছিলেন। আইজেনস্টাইনের এই সফর সে সময়কার চলচ্চিত্রমোদীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছিল।
তাঁর একটা বড় প্রভাব সে সময়কার মেক্সিকান নির্মাতাদের উপরে ছিল। একটা মজার ব্যাপার, হলিউডের একটা অংশের চেষ্টা ছিল স্প্যানিশ ভাষায় ছবি তৈরির। মূলত লাতিন আমেরিকার দর্শকরা ছিল তাদের টার্গেট। সেটা সফল হয়নি। মেক্সিকোর ছবি তাঁর নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছে।
সালমা হায়েক, গায়েল গার্সিয়া বার্নেল, গিলেরমো ডেল টরো। এমন অনেক নাম এখন পরিচিত। তারা আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রিতে এসে নাম করেছেন।
১৯৯০ এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত যে সময় সেটাকে বলা যেতে নিউ মেক্সিকান সিনেমার যুগ। আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনাররিতু এ সময়কার একজন নন্দিত পরিচালক।
মেক্সিকোর বাইরে ইউরোপে বা আমেরিকায় খ্যাতিমান এমন একজন নির্মাতা। বিশেষ করে ইনাররিত যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন সেটি যে কোন বিচারে মেক্সিকান ছবির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা।
বাবেল
আবার ইউরোপে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো জায়গাতেও ইনাররিতু বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন॥ তাঁর নির্মিত ছবিগুলোর অস্কার মনোননয়ন পাওয়াটা মোটামুটি নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে। বাবেল, আমোরেস পেরোস, কিংবা সাম্প্রতিক বিউটিফুল সবগুলো ছবিই অস্করে মনোনয়ন পেয়েছে। বিশেষ করে বাবেল এবং আমোরেস পেরোস ছবি দুটোর কথা বলতে হবে।
আমোরেস পেরোস, টুয়েন্টি গ্রামস, বাবেল এই তিনটি ছবিকে তাঁর ডেথ ট্রিলজি বলা যেতে পারে। এই ছবিটি তাঁর মৃত্যু ত্রয়ীর অংশ।
মরক্কো, জাপান, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র এই চারটি দেশের পটভূমিতে তৈরি। চরিত্রগুলো আলাদা। কিন্তু সবগুলো চরিত্র আসলে একসূত্রে গাঁথা।
ব্র্যাড পীট এবং কেট ব্লঁশেট অভিনয় করেছেন।
২১ গ্রামস
শন পেন এবং বেনিসিও দেল তোরো। গাড়ি দুর্ঘটনায় এক হয়েছে বিভিন্ন চরিত্র।
ইনাররিতুর হয়ে ওঠা
১৯৬৩ সালে জš§ মেক্সিকো সিটিতে। তাঁর বাবা একজন ব্যাংকার ছিলেন।
কিন্তু ইনাররিতুর যখন ৫-৬ বছর বয়স তখন তিনি দেউলিয়া হয়ে যান। কিশোর বয়সে তাঁকে মেঝে ঝাড়– দেওয়া, ইনজিন মেরামত করা ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছে। সে অর্থে কিশোরকালটা খুব কষ্টে কেটেছে। মজার ব্যাপার ইনাররিতু কিশোর বয়সে একটা কার্গো বোটে চেপে আটলান্টিক মহা সাগর পাড়ি দেন। দীর্ঘ সময় তিনি ইউরোপ আর আমেরিকায় কাটিয়েছেন।
১৯৮৪ সালে তিনি রেডিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রেডিও হোস্ট হিসেবে কাজ করতেন মেক্সিকোতে। এক সময় তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে মোটামুটি নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে তার। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি ছবির মিউজিক কম্পোজের কাজ করেছেন। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন সংগীতে চেয়ে সিনেমার দিকেই আসলে তাঁর আকর্ষণটা বেশি। হতাশাগ্রস্থ সংগীত পরিচালক থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৯৯০ এর দশকে এসে তিনি তাঁর নিজের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। ১৯৯৫ সালে তিনি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য করেন। এর বছর তিনেক পর তাঁর দেখা হয় গিলেরমো আরিয়াগার সঙ্গে। পুরো তিন বছর সময় নিয়ে তাঁরা আমোরেস পেরোসের চিত্রনাট্য দাঁড় করান। ৩৬ টি ড্রাফট।
২০০০ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।
আমোরেস পেরোস বিষয়ে
আমোরেস পেরোস আমাকে মুগ্ধ করে। তবে তার চেয়েও বিস্ময়াভিভূত করে ঢের বেশি। অতীব জটিল সব চরিত্রকে কি আশ্চর্য দতায় এক সুতোয় গেঁথেছেন নির্মাতা! আপাত: সামঞ্জস্য এবং যোগাযোগযোগ বিহীন কিছু চরিত্র তাদের নিজেদের মতো করে এগোতে থাকে।
ইনাররিতুর এক আশ্চর্য মতা এই- তার এই এই ছবিতে কোনো একজন অভিনেতাকেই ঠিক অভিনেতা হিসেবে বিচার করার ব্যাপারটা মাথায় আসেনা।
চরিত্রগুলো যেন ছবির গল্পেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ আর অবিশ্বাস্যরকমের জীবন্ত এবং দারুণ উপভোগ্য তাদের কাজ-কারবার। আমোরেস পেরোস আসলে সবটা মিলিয়েই আমোরেস পেরোস।
২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া আমোরেস পেরোস এর সুবাদেই ইনাররিতুর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। অনেকে এই ছবিটাকে আদর করে ডাকেন মেক্সিকোর পাল্প ফিকশন( কুয়েনটিন ট্যারেন্টিনো)। এই আমোরেস পেরোসই গোটা দুনিয়ার সিনেমা দর্শকদের ব্যাপকহারে পরিচয় করিয়ে দেয় ইনাররিতুর একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্ররীতির সঙ্গে।
অস্কার, কান সহ বেশ কয়েকটি বড়সড় চলচ্চিত্র আসরে ঝড় তোলে ইনাররিতুর এই আশ্চর্য নির্মাণ।
ছবির ঘটনাস্থল মেক্সিকো সিটি। ছবির প্রথম অধ্যায়ে( পরিচালক নাম দিয়েছেন অক্টাভিও অ্যান্ড সুসানা)
আমরা আবিষ্কার করি অক্টাভিও এবং র্যামিরো নামের বিবদমান দুই ভাইকে। বড় ভাই র্যামিরোর বউয়ের সঙ্গে বিধি বহির্ভুত মন দেওয়া নেওয়া চলছে অক্টাভিওর। ছবির আরও দুটো প্রধান চরিত্র।
একজন খ্যাতিমান সুপার মডেল ভ্যালেরিয়া। আরেকজন ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জাঁদরেল প্রকাশক ড্যানিয়েল। তাদের মধ্যকার প্রেমটা লুকিয়ে রাখার জন্য অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন তারা। তবে মুশকিল বাধে অন্য জায়গায়।
অবিশ্বাস্যভাবে তাদের মধুর প্রেমে বড়সড় গোলযোগ বাধিয়ে দেয় পরপর দুটো ঘটনা।
বশংবদ সেই গাড়ি দুর্ঘটনা আর ভ্যালেরিয়ার পুঁচকে কুকুরটার ঘরের কাঠের ফোরবোর্ডের নীচে আটকে পড়া।
ইনাররিতুকে নিয়ে
এক অর্থে ইনাররিতুর এই ছবির গল্প যেন এক জিগস পাজল। শুরুতে সেই জিগস পাজলের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন খন্ডগুলো ছড়ানো-ছিটানো থাকে এদিক-সেদিক। তারপর সেটা কি এক আশ্চর্য কৌশলে আচমকা একটি পরিপূর্ণ কাহিনী হয়ে ওঠে। কাহিনীর সবগুলো মাথা মিশ খেয়ে যায় এক জায়গায়।
আর সেই মিশ খাওয়ার ব্যাপারটা এমন দুর্দান্ত কায়দায় ঘটে যে দর্শকদের যুগপত মুগ্ধ ও বিস্মিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা।
সিনেমার তথাকথিত ‘শুরু’ আর ‘শেষ’ দেখে অভ্যস্ত যেসব দর্শক তাদের হয়তো অস্থিরতা বাড়ে। প্রথম দফায় বিভ্রান্ত হন। কাহিনীর লেজ আর মাথা খুঁজতে গিয়ে হয়রান পেরেশোন হন। হণ্যে হয়ে কাহিনীর যোগসূত্র খুঁজতে থাকা সেই দর্শকই আবার কিয়তন পর তাজ্জব হয়ে আবিষ্কার করে গল্পের সবগুলো সুতো ঠিক এক জায়গায় এসে মিশে গেছে, কোন এক জাদুমন্ত্র বলে।
মেক্সিকোর বিস্ময়, আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনাররিতু ছায়াছবির দুনিয়ায় স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন কেবল তাঁর ছবির তুলনারহিত গাঁথুনির বাহাদুরিতেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।