এখানে বিনামূল্যে বিশ্ব-বিখ্যাত মাইন্ড বৈজ্ঞানিক দ্বারা মাইন্ড রিলেটেড এনি প্রবলেম অতি যত্ন সহকারে সলভ করা হয় । সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
নেতৃত্ব এবং বীরত্ব এক বস্তু নয়, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বীরত্বের ব্যাপারটা মূলত ব্যক্তিগত; ব্যক্তিই সেটা অর্জন করে। নিজের মতো করে। ওদিকে নেতৃত্বের ঘটনা যে কেবল ব্যক্তিগত তা নয়।
মূলত তা সমষ্টিগত। নেতার ব্যক্তিগত বিভূতি থাকবে, তার মধ্যে বীরত্বও প্রত্যাশিত; কিন্তু তিনি অতিঅবশ্যি অনেকের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। সামনে থাকেন, পেছনে না থেকে, তবে বিচ্ছিন্ন থাকেন না। নেতা হচ্ছেন জনতার পথ প্রদর্শক। তার প্রধান গুণ সাহস নয়, প্রধান গুণ বিচক্ষণতা।
তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অপরিহার্য হয়ে ওঠে ঝুঁকি নেওয়া। আমাদের সংস্কৃতিতে বীরত্ব গুরুত্ব পায়, নেতৃত্বের চেয়ে বেশী। যে জন্য নেতা পাওয়া যায় না, কিন্তু বীর পাওয়া যায় যেখানে-সেখানে। নেতাকে বীর করে তুলি, গলায় মালা দিই, পারলে নতজানু হই। কিন্তু ওই যে বলছিলাম সৃষ্টিশীলতা, তার জন্য তো নেতৃত্ব দরকার।
বড় ছোট সর্বত্র এমন মানুষ চাই যিনি দৃষ্টান্ত হবেন, পরামর্শ দেবেন, সন্ধান জানাবেন পথের, দিশা তুলে ধরবেন চলবার। তাকে চাই রাষ্ট্রীয় কাজে, চাই প্রতিষ্ঠানে, সংগঠনে, বিদ্যালয়ে, পাড়ায়-মহল্লায়, যে-কোনো আয়োজনে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে গত ত্রিশ বছরে বেশ কয়েকজন নেতা এসেছেন। নেতা না হোন, তাদের মধ্যে প্রতিশ্রুতি ছিল নেতৃত্ব দেবার। তাদের কথা একটু পরে বলবো, যারা আগেও ছিলেন, কিন্তু এখন পরলোকগত।
নতুনদের ব্যাপারটাই প্রথমে ধরা যাক। যুদ্ধের ভেতর দিয়ে কেউ কেউ এসেছিলেন, এদের প্রস্তুতিটা ছিল ষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনে, যার প্রধান ধারাটা ছিল জাতীয়তাবাদী। আজ তাদের অধিকাংশই থেকেও নেই; কেউ কেউ আবার একেবারেই বসে পড়েছেন। যারা রয়েছেন তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন; বিত্তশালী হয়েছেন, কিন্তু নেতৃত্বের গৌরবটাকে ধরে রাখতে পারেননি। বাম ধারায় যারা ছিলেন তাদের কাছে প্রত্যাশাটা ছিল আরো অধিক।
কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। অনেকেই জাতীয়তাবাদী সেজে বড় দলে চলে গেছেন, গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে বীর হয়েছেন কিন্তু নেতা থাকতে পারেননি, বড় নেতা হওয়া তো দূরের ব্যাপার। উজ্জ্বলতা নেই, উদ্ভাস অনুপস্থিত। যারা বাম ধারায় টিকে রয়েছেন, তারাও মনে হয় বেশ কাবু হয়ে পড়েছেন, নেতৃত্ব দিতে পারবেন এমন আশা নিজের মধ্যেও নেই। আবার আত্মবিশ্বাসে যারা বলীয়ান তারা অনেকেই দেখি বেশ ভালো রকমের আমলাতান্ত্রিক।
বীরের জন্য আদর্শবাদ অপরিহার্য নাও হতে পারে, কিন্তু নেতার জন্য তা একেবারে প্রাথমিক শর্ত। জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী উভয় স্রোতেই নেতৃত্ব যে কাহিল হয়ে পড়েছে তার বড় কারণ আদর্শবাদের ঘাটতি। তা আদর্শবাদটা গেলো কোথায়? সরলীকরণ যদি অগ্রাহ্য না হয় তবে বলা যাবে চলে গেছে শ্রেণীর উদরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় দুর্দান্ত রকমের পুঁজিবাদী; তার বীরত্ব অন্যকিছুতেই নেই, আছে টাকা করাতে। এই আদর্শবাদের কাছে সমষ্টিগত স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে আদর্শবাদ সেটা টিকবে কেন, টিকবে কোন জোরে?
একটু পেছনের দিকে তাকালে আমরা তিনজন প্রয়াত অতিবিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেখতে পাবো, যারা একই সঙ্গে বীরও ছিলেন, নেতাও ছিলেন।
এরা হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফজলুল হক নিজের বীরত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অবাঙালী মুসলমানেরা তাকে ‘শেরে বাংলা’ উপাধি দিয়েছিল, সে উপাধিকে তিনি যে অগ্রহণযোগ্য মনে করেছেন তা নয়। তিনি নেতৃত্বও দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও কৃষক উভয়ের জন্যই তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ রেখে গেছেন।
কিছুটা হলেও কৃষককে মুক্তি দিয়েছেন ঋণের জোয়াল বহন থেকে, উঠতি মধ্যবিত্তকে সাহায্য করেছেন শিক্ষা ও চাকরির ব্যাপারে। বাংলার রাজনীতিতে এক সময়ে তিনি তার সমসাময়িক সবাইকে ছাপিয়ে উঠেছিলেন, ব্যক্তিত্বের শক্তিতে। ছোট লাট তাকে ধমক দিতে এসে নিজেই ধমক খেয়ে গেছেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতির ক্ষেত্রে তেমনি ছিলেন ফজলুল হক। কিন্তু তার মধ্যে বীর হবার আগ্রহটা বেশী ছিল নেতা হবার আগ্রহের তুলনায়।
যে জন্য দেখা গেছে তিনি মানুষকে টেনেছেন, ভোটের ব্যাপারে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু মানুষকে সংগঠনে নিয়ে আসতে পারেননি। কৃষক প্রজা পার্টি যেমন কৃষক শ্রমিক পার্টিও তেমনি, খুবই অগোছালো, সাময়িক প্রয়োজনে গড়েছিলেন, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর সেদিকে আর ফিরেও তাকাননি। নেতৃত্ব অবশ্যই দিয়েছেন; কিন্তু কোনো স্থির লক্ষ্য নিয়ে এগোননি, দোদুল্যমানতাও ছিল তার কাজে। জনগণকে যে পথের দিশা দেবেন সেটা সম্ভব হয়নি। চল্লিশে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, কিন্তু পরে সাতচল্লিশে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে তিনি আর নেতৃত্বে নেই।
চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের তিনি প্রধান তিন নেতার একজন, কিন্তু বিজয়ের পর দেখা গেলো যুক্তফ্রন্টকে আর ধরে রাখতে পারছেন না।
ভাসানীর মধ্যেও বীরত্ব ছিল অসামান্য। তাকে অর্ধশিক্ষিত বলেন যারা তাদের হিসাবটা ঠিকই আছে, কিন্তু সেটা অঙ্কের হিসাব, সাহসে, অন্তর্দৃষ্টিতে ও প্রজ্ঞায় কোনো উচ্চশিক্ষিতই তার সঙ্গে তুলনীয় ছিল না, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও নন। তিনি ধমক দেবার ক্ষমতা রাখতেন এবং দিতেন। তবে তার ঝোঁকটা বীরত্বের দিকে নয়, ছিল নেতৃত্বদানের দিকে, যেখানে তিনি ফজলুল হক থেকে স্বতন্ত্র।
মধ্যবিত্তের নয়, তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল শ্রমজীবী মানুষ। তাদের মুক্তি চেয়েছেন। শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন গড়তে চেয়েছেন, তাদের একত্র করেছেন, তাদের দাবিগুলোকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু নেতা হিসাবে তার সামনেও নির্দিষ্ট কোনো পথের সন্ধান ছিল কি? ছিলেন প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী, বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে। কিন্তু কোনো স্থির লক্ষ্য ধরে যে এগিয়ে যাবেন সে কাজ তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তার কাছ থেকে তা প্রত্যাশিতও ছিল না। তাই তিনিও কোনো সংগঠন রেখে যেতে পারেননি, তার অনুসারীরা নির্দিষ্ট একটা পথ ধরে যে এগুবেন সেটা সম্ভব হয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একাধারে বীর ও নেতা। যেমন বীর তেমনি নেতা। বীরত্ব ছিল, ছিলেন সাহসী এবং আপোসহীন, মেরুদণ্ড ছিল শক্ত।
হক ভাসানী দুই জনের তুলনাতেই তার ঝোঁক বেশী ছিল নেতৃত্বের দিকে। ফজলুল হক এবং ভাসানী যা পারেননি শেখ মুজিব তা করেছেন। তিনি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সংগঠন গড়েছেন এবং সংগঠন রেখে গেছেন। সাংগঠনিক শক্তিতে তিনি অন্য দুই জনের তুলনায় অনেক দক্ষ ছিলেন।
নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য ছিল সামনে, সেটা হলো বাঙালীর জন্য অধিকার অর্জন। সেই লক্ষ্য ধরে এগিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব তার নেতৃত্বের জন্য দ্বিতীয় যে পরীক্ষাটি অপেক্ষা করছিল, সেটির মুখোমুখি হলেন তখন দেখা গেলো তিনি নেতৃত্ব দিতে পারছেন না, পিছু হটে যাচ্ছেন, তার দৃষ্টি ঘুরে গেছে বীরত্বের দিকে। অনুরাগীরা তাকে ঘিরে ফেললো, আওয়াজ দিলো মুজিববাদের সেটি ফাঁকা ছিল বলেই উচ্চকণ্ঠ ছিল। তারা তাকে নেতার জায়গা থেকে সরিয়ে এনে বীরের স্তম্ভের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল।
তারা অবশ্য পারতো না, যদি তার নিজের সম্মতি না থাকতো। আসলে এক ধরনের সিদ্ধান্ত পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ঙ্কর রাতেই তিনি নিয়ে ফেলেছিলেন। যার দরুন যুদ্ধের নয় মাস তিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে রইলেন না। যুদ্ধে তিনি অবশ্যই ছিলেন তবে সেই অবস্থানটা যে নেতার হবে সেটা সম্ভব ছিল না, অবস্থানটা ছিল বীরের। স্বাধীনতার পরে দেখা গেলো তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন সেই সমাজতন্ত্র হবে শোষিত মানুষের এই অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তার জন্য ওই অঙ্গীকার রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল না। পথ ছিল না খোলা, অঙ্গীকারের অভাব ছিল। বরঞ্চ এটাই অনিবার্য ছিল যে, তিনি এমনকি সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ থেকেও সরে যাবেন, প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, রাষ্ট্রপতি হবেন এবং আয়োজন করবেন একদলীয় ব্যবস্থার।
আমরা তিনজনের কথা বললাম। আরো একজন ছিলেন যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি দেখা গিয়েছিল বড় ধরনের নেতৃত্বের।
তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। ভালো সংগঠক ছিলেন, চমৎকার বক্তৃতা করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের প্রথম ও একমাত্র উপনির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। সবটাই বীরত্বব্যঞ্জক। কথা ছিল নেতৃত্ব দেবারও, কিন্তু পারলেন না।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একেবারে প্রথম দিকেই তিনি পরাজিত হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা ব্যক্তিগত ছিল না, ছিল দলীয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সভা শোভাযাত্রার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা সরকার জারি করেছিল তা ভঙ্গ করা হবে না। সেই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জানাবার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর, যেহেতু তিনি সংগ্রাম পরিষদের সবচেয়ে বড় অংশ যে আওয়ামী লীগ তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রসমাবেশে তিনি তা জানিয়েছেন, ছাত্ররা তাকে মানেনি।
নত মুখে তিনি চলে গেছেন। বীর পারলেন না নেতা হতে। তারপরে তিনি কারাগারে বন্দী হয়েছেন। কারাগারে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবও গেছেন বহুবার, কিন্তু প্রতিবারই তারা আগের চেয়ে উন্নত মস্তকে বের হয়ে এসেছেন। শামসুল হক পারলেন না।
সাংগঠনিকভাবে নেতৃত্বে ছিলেন, কিন্তু সরে গেলেন। কারাবন্দী অবস্থাতেই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মুক্ত হয়েছেন, কিন্তু সুস্থ হননি। বরঞ্চ অসুখ বেড়েছে। পরে হারিয়েই গেছেন।
তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি বইও লিখেছেন। নেতৃত্বদানের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু তা আর বিকশিত হলো না।
ওই যে তিনজন বড় জননেতা-ফজলুল হক, ভাসানী এবং শেখ মুজিব- এদের পরিবেশে এমন আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না যে, তারা নেতার দায়িত্ব নেবেন। তারা অসাধারণ ছিলেন, মেধায়, অনুশীলনে, সাহসে, বীর হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তাদের জন্য; নেতৃত্বের জায়গাটা ভিন্ন, কিন্তু সেখানেও তারা অনায়াসে চলে এসেছিলেন নিজ গুণে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।