রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিপদাপন্ন সময় পার করছে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সুবিধাবাদ, সময়োপযোগী সঠিক রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্তের অভাবে দলের আজ এ অবস্থা। তারপর আবার বেগম জিয়া ছাড়া জিয়া পরিবারের সকল সদস্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বেগম জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নানারকম মামলার খড়গ ঝুলছে। বিএনপিতে বিভিন্ন দলছুট সুবিধাবাদী রাজনীতিক ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হওয়ায় নীতি-আদর্শহীন দলে পরিণত হয়েছে বৃহৎ এ দলটি।
দলের অভ্যন্তরেই রয়েছে নানা দল-উপদলীয় কোন্দল-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপোড়েন। অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে সংস্কারপন্থী ও সরকারপন্থী-সুবিধাভোগের অপবাদও। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না; দলে নেই কোনো চেইন অব কমান্ড। সব মিলিয়ে যেন এক প্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছে বিএনপিতে। ফলে এক সময়ের প্রচণ্ড ক্ষমতাসীন এই দলটি ক্রমেই যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কৌশলের অভাব থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার অদম্য ইচ্ছার ঘাটতি নেই দলটির। নানা সংকটে পড়ে দলটি আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার করতে না পেরে বিদেশিদের সঙ্গে এক প্রকার আঁতাত করতেই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এই বৃহৎ দলটি। ক্ষমতার রাজনীতির দৌড়ে তাদের রাজনীতি এখন কূটনৈতিক নির্ভর হয়ে পড়েছে। নেতৃত্বশূন্যতা, দক্ষ ও দূরদর্শী সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হচ্ছে দলটি। ফলে চরম হতাশ হয়ে পড়েছে দলের নেতা-কর্মীরা।
এদিকে মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ বিএনপি। সারাদেশে বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের অনেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার অনেকে নতুন মামলায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। জানা যায়, দলের স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ৪ জন বাদে সকলের নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামেও আছে ৫টি মামলা। খালেদা জিয়ার ২ পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো মামলার ভয়ে দেশ আসতেই সাহস করছেন না। পাশাপাশি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের কোনো নেতাই মামলার ভয়ে রাজপথের রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। ফলে ঝিঁমিয়ে পড়েছে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। খালেদা জিয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ ফাঁকা।
এতে স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই উদ্বিগ্ন-হতাশ। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিএনপি। সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ভাষণে সাধারণ মানুষের বিরাগ ভাজন হয়েছেন খালেদা জিয়া। তাঁর বিরুদ্ধে সংলাপের বিপরীত পথে হাঁটার অভিযোগ জনগণের। গত ৪ মে খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে চূড়ান্ত আল্টিমেটাম দেয় সরকারকে।
ইদানিং আবারও সংলাপের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সহিংস হরতাল করছে বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলছেন, সংলাপে শান্তি নয়, সহিংসতায় মুক্তি খুঁজছেন বিএনপি প্রধান। তাই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সর্বমহলের প্রত্যাশিত সংলাপের পথই মাড়াচ্ছেন না তিনি।
এদিকে তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। কবে তিনি দেশে ফিরবেন, আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা, রাজনীতিতে তার অবস্থান কি হবে, তা নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর।
বেগম জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা, বয়স, তার ওপর রাজনৈতিকচাপসহ নানারকম রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যেই তিনি বসবাস করছেন। বিএনপি এখনো সুসংগঠিত নয়। দলের নেতাদের মধ্যে বিভাজন, বাহাস, অনৈক্য, সুবিধাবাদ সুস্পষ্ট। সরকারের অব্যাহত চাপের মুখে দলের অনেক নেতা সরকারের সঙ্গে নানা ধরনের গোপন আপসকামিতার মধ্যে আছেন। এরকম অবস্থায় বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে আনতে অতীতের যেসব ভুলপথ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সেসব বিবেচনায় নিতে হচ্ছে।
বিশেষত তারেক জিয়ার কারণে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে ফাঁটল তৈরি হয়েছিল, তা মেরামত করা ছাড়া এ দুর্যোগ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই। বিএনপি এখন সে কারণেই অনেক বেশি বিদেশমুখী পথে হাঁটছে।
বিএনপি যে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও কূটনৈতিক নির্ভর হয়ে পড়ে উইকিলিকসে সেই চিত্র ধরা পড়ে। সেখানে বলা হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত বড় ছেলে তারেক রহমানকে রক্ষা করাই খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্যসচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী বাংলাদেশ নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসকে এ কথা বলেছিলেন।
হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ভিন্নধারার গণমাধ্যম উইকিলিকস এ খবর প্রকাশ করেছে।
২০০৫-এর ১৩ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সঙ্গে ৪০ মিনিটের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে হ্যারি কে টমাস কামালউদ্দিনকে উপদেশ দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে তারেক রহমানের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বৈঠকে হ্যারি টমাস এও বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়। ’ একই বৈঠকে কামালউদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও সেসময়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বৈঠকের কারণে খালেদা জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনামের জন্য রাজশাহীতে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যদের রক্ষা করা যাবে না এবং জেএমবি গ্যাংস্টারদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
সেই বৈঠকে তিনি এও বলেন, এটাই বিএনপি সরকারের সমস্যা। এ সরকার কেবল চাপের মধ্যে পড়ে কাজ করে।
ফলে কয়েক মাস আগে যা করা উচিৎ ছিল, তা পরে করার ক্রেডিট বিএনপি সরকার নিতে পারে না। খালেদা জিয়ার মুখ্যসচিব হ্যারি কে টমাসকে আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী (আইভি রহমান) ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এসএএমএস কিবরিয়ার হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি আনতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ অত্যাবশ্যক।
এদিকে তারেক জিয়া, আরাফাত রহমানসহ জিয়া পরিবারের অন্য সদস্যদের বিদেশবাস নিশ্চিত, নির্বিঘœ ও নিরাপদ করতে হলে পশ্চিমা দেশসহ ক্ষমতাধর চীন, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে তারেক জিয়ার উদ্যোগে বাংলাদেশে তাইওয়ানের দূতাবাস খোলার কারণে বিএনপির পুরানো মিত্র চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। অন্যদিকে হাওয়া ভবনের নানাবিধ অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট। ভারত, বিএনপি বিশেষত তারেক জিয়া সম্পর্কে খুবই নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করে। জিয়া পরিবারের নানা দুর্গতির জন্য এই বিষয়টিকে বড় কারণ হিসেবে দেখা হয়। মহাজোট সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে নানামুখী প্রয়াস চালায়।
এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা ছাড়া বিএনপির পুনর্জাগরণ অসম্ভবÑ এই সত্যটা বেগম জিয়া উপলব্ধি করেছেন। এবং এক্ষেত্রে দলের কোনো নেতার ওপর নির্ভর করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তাও তিনি জানেন। সে কারণেই চীন ও ভারত সফরে দলের নেতৃত্বের বড় অংশকে তিনি সঙ্গে নেননি। সাবেক আমলাদের একটা অংশকে ওয়ার্কিং টুলস হিসেবে ব্যবহার করে নিজেই দেনদরবার করেছেন।
সুতরাং হঠাৎ করে বিএনপির ভারতমুখী নীতি গ্রহণের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির যতটা সংযোগ আছে, তার চেয়ে জিয়া পরিবারের বর্তমান দুর্যোগ কাটানোর পথ বের করার বিষয়টিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে বলে জানা যায়।
ভারতের সঙ্গে যেসব বিষয়ে প্রকাশ্যে তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে এসেছেন, অন্তরালে আরও অনেক বিষয়ে দেনদরবার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর এ বিষয়ে দলের নেতারা কেউ ওয়াকিবহাল নন। বেগম জিয়া নিজেই এসব ফেস টু ফেস নেগোসিয়েশনের কাজটা সেরেছেন। তাই বিদেশি কূটনীতি নিয়ে ব্যস্ত বিএনপি, নেই রাজনৈতিক কঠোর কর্মসূচি। বিএনপির সাম্প্রতিক ডিমেতাল কর্মসূচি বিদেশি কূটনৈতিক নির্ভরতা সুস্পষ্ট করে তুলছে।
ইদানিং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনারা। কখনো কূটনীতির ভাষায় কখনো ‘কূটনীতির রীতিনীতি বহির্ভূত’ কথাবার্তা বলছেন তারা। কিন্তু কেন? এদেশে কি জ্ঞানী গুণীর অভাব? বিষয়টি বুঝতে হলে বেগম জিয়ার চীন, ভারত, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য সফরগুলোর দিকে নজর দেয়া দরকার।
চীন সফর শেষ করেই ভারত সফর করেছেন বেগম জিয়া। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা সরাজ, বিজেপির প্রেসিডেন্ট নিতিন গড়করি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন ভারতীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকের পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার সফরসঙ্গীরা ভারতীয় মিডিয়ায় বলেছেন, বিএনপি ও ভারতের নতুন সম্পর্ক শুরু হলো।
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র একে ‘সামনে তাকানো’ নয়া দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ভারতীয় মিডিয়ার বড় অংশ একে বাংলাদেশের বহুদলভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের নিবিড় যোগাযোগের অধ্যায় বলে অভিহিত করেছেন। ট্রানজিট, নিরাপত্তা বিষয়ে বিএনপির ভারতবিদ্বেষনীতি এক সফরে পুরো উল্টোপথে হেঁটে ভারত সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের নিরাপত্তা বিঘিœতকারীদের কোনো জায়গা তার দল দেবে না। ভারতীয় সরকারের আমন্ত্রণে গিয়ে বেগম জিয়া তার সপ্তাহব্যাপী নানা বৈঠক, নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই বার্তা পরিষ্কার করেছেন, বিএনপি ভারতবিদ্বেষের অতীত নীতি পরিহার করছে।
ভারত বিষয়ে আওয়ামী সরকার যেসব নীতি নিয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে ভারতকে সহায়তা করবে বিএনপি। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে নেয়া সকল ইতিবাচক পদক্ষেপ অটুট রাখবে। বিএনপির এই ভারত ঘোষণা মহাজোট সরকারকে দারুণ নার্ভাস করে দেয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বিগ্নতা কমাতে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দলীয় মুখপাত্রদের নানান বক্তব্যে তা প্রমাণিত হতে থাকে।
যেসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ভারতপ্রীতিতে যুক্ত, সেসব জায়গায় ভাগ বসাতে চলেছে বিএনপি। বেগম জিয়া ভারতে গিয়ে এ রকম উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবেন, ভারতের সঙ্গে তার নীতিগত বৈরিতা ইতিবাচক সম্পর্কে মোড় নেবে তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি সরকার ও আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার শেষপ্রহরে এসে বিরোধী দলকে ভারত এত গুরুত্ব দেবে এবং বিএনপির সঙ্গে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ ঘটবেÑ এ বিষয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে কোনো তথ্য না থাকা, প্রস্তুতি না থাকায় সরকার কিছুটা সন্ত্রস্তও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি নেত্রীর এই ভারতনীতি কি হঠাৎ করেই তৈরি হলো? নাকি এর প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরে নীরবে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পররাষ্ট্র বিশ্লেষকের অভিমত, মূল খেলাটি খেলেছে আমেরিকা।
বলা হয় বাংলাদেশস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজিনা বেগম জিয়ার এই কূটনৈতিক ভোলবদলের মূল কারিগর। এর নেপথ্যে কাজ করেছে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের প্রিয়ভাজন একজন সাবেক কূটনীতিকের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান। বেগম জিয়ার ভারত সফরের আগে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার নিজ নামে একটি ইতিবাচক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস জার্নালে বেগম জিয়ার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এ দুই জায়গাতেই খালেদা জিয়া পরিষ্কার করেছেন, ভারত সম্পর্কে বিএনপি তার পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে এই সম্পর্কের বদলে বেগম জিয়াকে রাজি করতে এর পেছনে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এর নেপথ্য কারিগরদের। যে কারণে বেগম জিয়া ভারত সফরের আগে চীনে যেতে চেয়েছেন। চীন থেকে ফিরেই তিনি ভারত সফর করেছেন, যাতে মনে না হয়, বেগম জিয়া শুধু ভারতের সঙ্গেই সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চান।
ভারতও এই কূটনীতিকে সম্মান দিয়েছে। চীনে বেগম জিয়া যেসব দৃশ্যমান দাবি তুলেছেন তার মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রে ডিপ-সি পোর্ট নির্মাণে চীনা অর্থায়ন।
চীন এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের সঙ্গে ভারতকে অংশীদার করার আগ্রহ দেখিয়েছেন বেগম জিয়ার কাছে। কাজেই এটা খুব সুস্পষ্ট বেগম জিয়ার চীন ও ভারত সফরের মধ্যে রাজনৈতিক সাযুজ্য আছে। এবং এটি নেপথ্য কারিগরদের বড় রাজনৈতিক প্লানের অংশ হিসেবেই পরিকল্পিত উপায়ে ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কর্মকাণ্ডে তাই একটা পরিবর্তিত বিএনপিকে দেখা যাচ্ছে অনেক নমনীয় রাজনীতির চেহারায়।
হরতাল, অবরোধসহ ভাঙচুরের রাজনীতির পথ থেকে অনেকটা ভিন্ন পথে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে বিএনপিকে। বিএনপির এই নয়ানীতি দলের মধ্যে দক্ষিণপন্থীদের নিরাশ করছে। তারেক জিয়ার নাম ভাঙিয়ে দলের মধ্যে ‘ভাইয়াতন্ত্রে’র পূজারিদের ক্রমশ ম্রিয়মাণ হতে দেখা যাচ্ছে। দলে মধ্যমপন্থী যারা, তারা অবস্থা বুঝে বেগম জিয়ার আস্থাভাজন হতে চাইছে নয়ানীতি অনুসরণ করে। দেখা যাচ্ছে দলের প্রগতিশীল, চাণক্য অংশকে দ্রুত সামনে এগিয়ে আসতে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপিতে দক্ষিণপন্থী, উগ্র ডানপন্থীদের অবস্থান ততই দুর্বল হচ্ছে।
তবে ইদানিং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতায় এক প্রকার সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও তৎপরতার অভাবে অনেক ইতিবাচক বিষয়েও প্রতিকূল ও জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ফলে দলের এই দুঃসময়ে কূটনৈতিক তৎপরতার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক ভূমিকাকে ব্যর্থতার দৃষ্টিতেই দেখছেন প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ নেতারা। আর এ ব্যর্থতার কারণে এত দিন কোনোরকমে চললেও সরকারের শেষ সময়ে এসে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন মুল্লুকের অনুকূল হাওয়ায় উল্টো স্রোত বইতে শুরু করেছে- এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ ছাড়া বিএনপির পক্ষে যারা এই তৎপরতা চালানোর দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা, দু-একজন ছাড়া সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ নেতার অনভিজ্ঞতা, অপরিপক্বতা ও অনেকের দাম্ভিকতাসহ এককেন্দ্রিক মনোভাবকেও এ প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক এ সম্পর্ক বা তৎপরতার ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ডকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা পর্যন্ত অমান্য করে চলেছেন সংশ্লিষ্ট এ নেতারা। সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক ব্যর্থতার সমালোচনা করে দলীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট উইয়ের নেতাদের দায়ী করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তারা মনে করছেন গত ৩ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ৩ দিনের বাংলাদেশ সফরকালীন সময়ে খালেদা-প্রণব মুখার্জির নির্ধারিত সাক্ষাৎসূচি বাতিল করে বিএনপি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েনডি শেরম্যানের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকে এর সর্বশেষ প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এমন সাবেক একাধিক মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওয়েনডি শেরম্যানের সাক্ষাৎকার বাতিলের বিষয়টিকে দলীয় ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, শেরম্যান নিজেই ঢাকা ছাড়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সামনে পরিষ্কার ভাষায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করে গেছেন। বলে গেছেন, হঠাৎ করে হরতাল আহ্বানের কারণে আগে থেকে নির্ধারণ করা কর্মসূচি বাতিলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে হরতাল-সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদও দিয়ে গেছেন বিরোধী দলকে।
এর আগে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরকালেও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাত বাতিলের ক্ষেত্রেও কিছু অতি-ভারতবিরোধী ছাড়া বেশির ভাগ অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতা দলের কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যর্থতাকেই দায়ী করেন। তাদের মতে, ঢাকা সফরকালে প্রণব মুখার্জি অধীর আগ্রহে অপেক্ষাও করেছিলেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া গত বছর ভারত সফরকালে প্রথম দিন অনিবার্য কারণে শিডিউল পরিবর্তনের পরও প্রণব মুখার্জি সফরের শেষ দিন ৩ নভেম্বর ২০১২ সকাল ১০টায় সে দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বের হয়ে দিল্লি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘আমি অভিভূত। রাষ্ট্রপতি ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবার আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় আমি আনন্দিত।
’ নয়াদিল্লি ছাড়ার আগে বেগম খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণও জানিয়ে আসেন একাধিকবার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রপতি যখন আগে থেকেই সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে বাংলাদেশে এলেন, তখন বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎও করলেন না। এ সিদ্ধান্ত কোথা থেকে এলো তা আজও জানেন না দলের অনেক নীতিনির্ধারক। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিজ হাতে তৈরি ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’র কার্যক্রমকেও পরোক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে হ্যাঁ বা না কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান ওই কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে, দলের এমন একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা ও দলের নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আমরা বড় বড় অনেক দেশের অ্যাম্বেসি থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত পাই। অ্যাম্বাসেডর ও তাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগও রয়েছে ভালো। কিন্তু বিএনপি থেকে যখন কোনো কিছুর আয়োজন করা হয়, কিংবা প্রয়োজন হয়, তখন দলের পক্ষ থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয় না। ফলে সঠিক সমন্বয়টা আর হয়ে ওঠে না। ’
বিএনপির হাল রাজনীতির এই লেজেগোবরে অবস্থা শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে কোথায় দাঁড় করাবে তা অবলোকন করার জন্য নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তাহলে কি বেগম জিয়ার দল নির্বাচনে অংশ নেবে? কূটনীতি পাড়ার ব্যতি-ব্যস্থতা ও আমাদের রাজনীতিবিদগণের আনাগোনা ইঙ্গিত দিবে কোন দিকে মোড় নিবে সংলাপ কিংবা সমঝোতা। তবে জনবিচ্ছিন্নতা যে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনে না তা এ দেশবাসী ভালভাবেই জানেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।