নতুনদিনের মিছিলে,একজন বেয়নেটধারী সৈনিক
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। হিমেল বাতাস যেখানে শহুরে মানুষকেও কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, সেইসময় করিম একটা পাতলা গেঞ্জি পরে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে শুয়ে ছিলো। তার পায়ের কাছেই একটা কুকুর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।
- কি রে, শীত লাগে বুঝি?
কুকুরের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে নিজেই হেসে ফেললো সে। কুকুর কথা বলতে পারলে বেশ হত।
সময় কাটতো। সারাদিনের ব্যাস্ত বড়দিয়া স্টেশন সন্ধ্যা না নামতেই নির্জনতায় ডুবে যায়। করিম গান ধরে-
"মাওলা ঘর ছাড়িলাম রে
আমার মন মানুষের খোঁজে
কোথায় গেলে পাবো তারে
কোন পৃথিবীর মাঝে"
রেলের যারা কুলি, তাদের প্রায় সবার ঘর আছে। যাদের নাই, তারা পরিত্যাক্ত বগিগুলোতে সংসার পেতেছে। করিমের কপালে কোনটাই জোটেনি।
এই প্রাচীন স্টেশনটাই তার ঘর-বাড়ি। এক কাপ চা কলে খারাপ হতোনা। এখন চা খেতে হলে, মাইলখানেক দূরে মানিকদার চায়ের দোকানে যেতে হবে। দিনের বেলা মানিকদার বুড়া বাপ কিংবা বোন দূর্গা দোকান চালায়। রাতে মানিকদা।
করিম গামছাটা গায়ে জড়িয়ে মানিকদার দোকানের দিকে হাঁটা দেয়। কুকুরটাও তার পিছু পিছু আসে। করিম জানে, কুকুরটা বেশিদুর যাবে না। এই স্টেশনের বাইরে কুকুরটা যায়না। স্টেশনটাই তার সীমানা।
শুধু মানুষের কোন সীমানা থাকেনা। করিম আবার গান ধরে। আজ পুর্নিমা। শীতের পুর্নিমাগুলো অপুর্ব আবহ তৈরী করে। কুয়াশার চাদরের মাঝে পৃথীবির সমস্ত রহস্য যেনো লুকিয়ে থাকে।
দোকানে পৌছে করিম দেখে মানিকদা নেই। তার বোন দুর্গা বসে আছে।
- কি রে তোর খব কি? তোর দাদা কই?
- দাদা শ্বশুর বাড়ী গেছে, বৌদিরে লইয়া। আর,আমারে তুই তোকারি করেন ক্যান? আপনেরে না মানা করছি, আমারে তুই-তোকারি করবেন না।
- আইচ্ছা, যা।
তোরে আপনি করে বলবো। এখন এক কাপ চা দে।
- তুই-তোকারি করলে আপনের কাছে চা বেচুমনা।
করিম বিব্রত ভঙ্গিতে হাসে। দূর্গা চা বানাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
চা বানাতে গিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে যায় সে। এই মানুষটিকে কেন জানি খুব ভালো লাগে। আর কি গানের গলা!
- করিম ভাই, আমার কথায় কি কষ্ট পাইছেন?
- আরে যা। তুই বাচ্চা পুলাপান। তোর কথায় কষ্ট পামু ক্যান?
করিমের অবহেলায় দূর্গার মনে অভিমান জাগে।
চায়ে চুমুক দিয়ে করিমের ভালো লাগে। সে গান ধরে-
"মাওলা ঘর ছাড়িলাম রে
আমার মন মানুষের খোঁজে
কোথায় গেলে পাবো তারে
কোন পৃথিবীর মাঝে"
কেটলির উত্তাপে ঘামে ভেজা মুখমন্ডলে জলের যে ক্ষীনধারা ঝরে পড়লো, তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ দেখলোনা। দূর্গার মনে হয়, এই মানুষটার খুঁজে যাওয়া মন মানুষটা যদি সে হতো। করিমের গলা আরো ভরাট হয়ে উঠলো।
(পাঠক, চলচ্চিত্র হলে, আল্লাহ-ভগবানের চিরায়ত দ্বন্দের জাল ভেদ করে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিয়ে দেয়া যেতো।
কিন্তু, বাস্তব চলচ্চিত্রের রঙ্গীন পর্দা নয়। এখানে দূর্গার স্বপ্ন সাদাকালোই থেকে যায়। এমন আরো অনেক ভরা পুর্নিমা, করিমের গান আর দূর্গার চোখের জল যে অপূর্ব সঙ্গীত ঘোর সৃষ্টি করে, তার কোন সমাধান এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে নেই। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।