এ যেন এক মিউজিয়াম !
আবুধাবির শেখ জায়েদ মসজিদ মসজিদে দু'রাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে প্রাণভরে উপভোগ করছি মসজিদটির নান্দনিক সৌন্দর্য। বাহারী কারুকাজে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে চোখ! আমি বিস্মিত! আমি পুলকিত। রোমাঞ্চিতও।
নামাজ শেষে আমার পাশে আমি আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ সাদা চামড়ার এক লোককে।
বুঝলাম সে আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করছিলো। নামাজ শেষ করতেই কাছে এসে দাঁড়ালো সে। আমার নামাজ সম্বন্ধে কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলো Could you tell me man, what have you performed here?
আমি বললাম, Just I have discharged ‘Salat’ it means prayers to Allah the lord of universe.
তখন সে বললো Oh fine! it is a wonderful exercise.
আমি তার মুখের দিকে তাকালাম ভাল করে। প্রশ্নের ধরণ থেকেই অনুমান করে নেয়া যায় লোকটি তো মুসলমান নয়ই, জীবনে কখনো মুসলমানদের সংস্পর্শে এসেছে কি না, সন্দেহ আছে। ধারণা করতে সমস্যা হলো না সে তার এই জীবনে কাউকে নামাজ পড়তে দেখেনি! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
What is your name and Where are you from. Please?
এই ফাকে বলে রাখি, আমার ইংরেজি জ্ঞান ভয়াবহ।
জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো আর কি! যখন কথা বলছিলাম তার সাথে, তখন আমার মনে হচ্ছিলো ভুলভাল মিলিয়ে আমি আমার কথা তাকে বুঝিয়ে ফেলতে পারছিলাম। এখন লিখতে গিয়ে খানিকটা আতংকিত বোধ করছি। ভুল হলে আপনারা আমাকে শুধরে দেবেন। আপনাদের উপর এই ভরসা মনেহয় করতেই পারি।
আমি যখন তাকে তার নাম এবং তার দেশের কথা জানতে চাইলাম,
সে বললো, My name is Michel Shane. I am from Australia.
আমি বললাম, Thank you.
সে বললো, Nice to meet you.
লোকটি চলে গেলো অন্যদিকে।
আমার সাথে পরিচিত হয়ে তার ভাল লাগলেও তার সাথে পরিচিত হয়ে আমার মোটেও ভাল লাগেনি। পবিত্র মসজিদের ভিতর কোনো অমুসলিমকে দেখে ভাল লাগার কথাও না।
একটু কোলাহল শুনে ফিরে তাকালাম পেছন দিকে। ১০/১২ জন মহিলার ছোটখাট একটা মিছিল মনে হল। বুড়ো মায়েরা বুরকা পরেছেন কিন্তু উনাদের তরুণী মেয়েরা বোরকা ছাড়া।
রীতিমত হৈ-হুল্লোড় করছেন। এ যেন কোনো মসজিদ নয়, কোনো বিনোদন পার্ক।
এই কালচারটা আমি আমার দেশেও দেখে থাকি। অধিকাংশ মায়েরাই যখন তাদের তরুণী মেয়েদের নিয়ে বাইরে কোথাও যান, মার্কেটে বা অন্য কোথাও, আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করে থাকি, সেই মায়েরা যথারীতি বোরকা পরে আছেন কিন্তু তাদের মেয়েরা বোরকা ছাড়া। যদিও উভয়েই বোরকা পরতে পারতেন।
আর বোরকার ঘটতি জনিত কারণে ঘরে যদি একাধিক বোরকা না থেকে থাকে, তাহলে আমার তো মনে হয় মায়েরচে' মেয়ের জন্যই বোরকাটা বেশি জরুরী ছিলো। যা হোক।
আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে আসলাম আমরা। ফিরে আসলাম আবারো আবুদাবি মেইন শহরে। সেখান থেকে আল আইনগামী বাস ধরবো, ঠিক তখনি আবুদাবি থেকে অনুমান ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ‘বানিয়াছ থেকে ফোন করলো বন্ধু জামান।
মুহাম্মদ শামছুজ্জামান। অবশ্য আবুদাবিতে গিয়ে সে তার পৈত্রিক নামটা একটু মর্টিফাই করে শামস্ করেছে। সে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ডের ছেলে। যার সাথে আমার সতের বছরের বন্ধুত্ব।
সে কীভাবে কীভাবে জানি জেনে গেছে আমি দুবাই গেছি।
দেশ থেকে আমার ফোন নং যোগাড় করে আমাকে ফোন করলো। বললো তার ওখানে যেতে। না শুনতে সে রাজি হল না। অগত্যা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম বানিয়াছ এলাকায়। গিয়ে দেখলাম অনেক বাঙালি রয়েছেন সেখানে।
এর মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ তিনজন, সিলেট শহরের জামান, টিপু ভাই ও তমজিদ। জামান আমাকে বুজে জড়িয়ে ধরে বললো, “দোস্ত কী খাবি বল?”
আমি কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা না করে সাথে সাথেই উত্তর দিলাম, হাকিমপুরী জর্দা নিয়ে পান খাওয়াতে পারিস কি না দেখ।
সাথে সাথে তার মুখটি কালো হয়ে গেলো। মুখে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠলো। বললো, “খুব কষ্টে ফেলে দিলি দোস্ত।
তবুও দেখি যোগাড় করতে পারি কি না। ”
যেখানে বাঙালি আছে, সেখানে যৎসামান্য পান পাওয়া যায় ঠিক, তবে সেটা খোঁজাখুজি করতে ঘাম বেরিয়ে যায়। আমাদের দেশে গাঁজা-হিরোইন’র পুটলাও এত গোপনে এবং সতর্কতার সাথে বিক্রি করা হয় না যতটা গোপনে সেখানে পান বিক্রি হয়।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ছোটাছুটি করে ১০/১২ জায়গায় ফোন-টন করে জামান আমাদের জন্য ১০টি পান জোগাড় করে আনলো। বুঝাই যাচ্ছে পান না চেয়ে তার কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলেও তার এত কষ্ট হত না।
চুপি চুপি পানগুলো এনে একবার তাকালো চতুর্দিকে। তারপর খপ্ করে পকেট থেকে পানগুলো বের করে ঢুকিয়ে দিল আমার ব্যাগে। কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, “প্লিজ, এখন খাসনে, পরে খাস। ”
আমার হাসি পেয়ে গেল। তার সন্দেহ আমি যদি এখানে পান খাই, আর ধরা পড়ি, আর যদি বলে দেই এই ভয়ংকর জঘন্য বস্তুটি সে আমাকে সাপ্লাই দিয়েছে, তাহলে তার বিপদ হতে পারে।
মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশি মানুষের এই একটি কারণে হলেও বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। পানের প্রতি কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি বলে নির্ভয়ে মুখ ভরে পান খেতে পারছেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এসেছে। জামানের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সে আমাদেরকে ট্যাক্সি ঠিক করে দিল।
৭৫ দেরহাম ভাড়ায় আল আইন পর্যন্ত। রাত ৯টায় ফিরে আসলাম আল আইনে। আল আইনের প্রসিদ্ধ লু লু মার্কেট থেকে হালকা কেনাকাটা করলাম। আব্দুল্লাহ ভাই ফোন করে জানালেন, তিনি গাড়ী নিয়ে আসছেন, আমরা যেন অপেক্ষা করি।
রাতের খাবারের দাওয়াত ছিল সিলেট বিভাগ প্রবাসী সমবায় সমিতি আল আইন আরব আমিরাত’র অর্থ সম্পাদক জালাল ভাই’র ওখানে।
রকমারী আয়োজন দ্বারা সাজানো হয়েছে খাবারের দস্তরখানা। খাওয়া-দাওয়া শেষে ফিরে আসলাম আমাদের আমিরাতের আপন আবাস আব্দুল্লাহ ভাই’র বাসায়। রাত চারটা পর্যন্ত চললো ব্যবসায়িক আলাপ-আলোচনা। আগামীকাল সকালে আল আইন ছেড়ে চলে যাব শারজাহ’র উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসবো।
সঙ্গত কারণেই আল আইনের বন্ধুদের সাথে এই যাত্রায় আর দেখা হবে না।
মাত্র তিন দিনে আল আইনের বাঙালিরা যে মমতা, যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, যে পরিমাণ ভালবাসা দিয়েছেন, তাতে করে তাদের ছেড়ে যেতে হবে ভেবে রাত থেকেই মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু উপায় নেই। শারজাহ থেকে প্রতিদিনই শ্রদ্ধেয় জামীল সাহেব ফোন করছেন। সেখানে চলে যাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন।
ভীষণরকম মন খারাপ ভাব নিয়ে ঘুমুতে গেলাম ভোর রাতে, ফজরের নামাজের পরে। আগামী কাল রওয়ানা করবো শারজাহ'র উদ্দেশ্যে।
চলবে------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।