০০০০০০০০০০ রোদেলার সাথে আমার পরিচয় ক্লাস নাইন এর বার্ষিক পরীক্ষার পর। স্কাউটের একটা ক্যাম্পে। ক্যাম্পটা আমাদের স্কুলে হয় প্রতিবছর। ও পড়ত একটা সনামধন্য গার্লস হাই স্কুলে,একই ক্লাসে। আগেই বলে রাখি আমরা দুইজনই থাকি চট্টগ্রামে।
তো সন্ধ্যার পর সবাই ক্যাম্প ফায়ার জ্বালাচ্ছে আর আমি বেচারা বসে বসে দেখছি। ক্যাম্প ফায়ার জ্বালানোর পর সবাই ওটার পাশে বসে মজা করছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা মেয়ে বেশ দূরে একা বসে আছে আকাশের দিকে মুখ করে।
মোটামুটি সুন্দর চেহারা কিন্তু মেয়েটাকে হালকা মোটাই বলা যায়,তাই হয়ত কোন ছেলে ওর আসে পাশে নাই। আমি কি ভেবে ওর পাশে যেয়ে বসলাম।
খুবই বেমানান দেখাচ্ছে,কারণ তখন আমি খুবই চিকন ছিলাম। ওর সাথে কথা বলতে চাইলাম,প্রথমে ও খুব কথা না বললেও একটু পর খুবই ফ্রী হয়ে গেলাম। যতটুকু তখন ওর সম্পর্কে জানতে পারলাম তাতে আমারই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওর জন্মের সময় ওর মা মারা যান,আর বাবা মারা যান গত কয়েক মাস আগে। একমাত্র বড় ভাই এর কাছে থাকে।
এখন বুঝলাম ও কেন রাতের আকাশের দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিল। ওর সাথে বন্ধুত্ত শুরু হল তখন থেকে। ও আমার বাসার মোবাইল নাম্বার নিল আমিও ওর বাসার নাম্বারটা নিলাম। ওই সময় মোবাইলের তেমন একটা চল ছিলনা। আর মিনিটও ছিল আঠার-বিশ টাকা করে।
আমি ওকে মাসে এক বার কল দিতাম আর ও দিত দুই চার বার। কয়েক মিনিটের বেশী কথা হতনা।
ক্লাস ১০ এ রমজানের ঈদে ওর বাসায় দাওয়াত দিল। যাওয়ার পরে বুঝলাম ও চট্টগ্রামের এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতির মেয়ে। তখন থেকেই ওর সাথে নিরাপদ দুরত্ত বজায় রাখতাম।
কিন্তু কেন জানি ও আমাকে প্রচণ্ড পছন্দ করত।
পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে আমার অনেক স্টাডি গ্যাপ যায়। আর ও ঠিকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে সাড়ে তিন বছরে বিবিএ শেষ করে চাকরীতে যোগ দেয়। শিল্পপতির মেয়ে কেন চাকরী করবে আমার মাথায় কিছুই ধরেনা। তখন আমি কেবল বিবিএ ফোর্থ সেমিস্টার শেষ করছি।
-ওই তোর দাওয়াত
-কিসের?তোর বিয়ার?
-না আমি চাকরী পাইছি তাই। আর বিয়া করলেতো তোরেই করুম।
-খাওয়াবি কই এইটা বল?
-জাস্ট রাত ৯টায় আগ্রাবাদে এম্ব্রসিয়াতে চলে আসবি। ওকে,বাই।
রাতে যখন রেডি হচ্ছি মা জিজ্ঞাস করল কোথায় যাই।
বললাম রোদেলা দাওয়াত দিছে খাইতে যাই। আম্মু-আব্বু রোদেলাকে ভাল করেই চিনে। ও অনেকবার আসছে আমাদের বাসায়,আর আমিতো প্রায়ই যাই ওর বাসায়। সিএনজি তে যেতে যেতে ওর কথা চিন্তা করছি। নাম রদেলা,কিন্তু মুখটা সবসময় মেঘলা।
খুব কম সময় ওর মুখে হাসি দেখছি। আগে একটু মোটা ছিল। এখন ডায়েট কন্ট্রল করে মোটামুটি স্লিম হইছে। আমার নিজের দিকে তাকাইলাম একবার,আগে খুব চিকন ছিলাম। গত দুই বছর টানা মাল্টি-জিম করে এখন মোটামুটি পেশীবহুল শরীর।
সব খরচ বহন করছে ও,এমনকি ওর ভাই যখন বিদেশে গেছে তখন আমার জন্য প্রোটিন বার আর প্রোটিন পাউডার আনাইছে। ফ্যাশন ডিজাইনের উপর আমি একটা ডিপ্লমা করছি,ওর বদলতে দুইটা বুটিক হাউসে ডিজাইনার হিসাবে আছি।
রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখি একটা কোনার টেবিল এ উদাস মনে বসে আছে। টুকটাক কথা হল,খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর উঠতে যাব ও বলল আরেকটু বস। বসলাম।
হঠাৎ করে ও একটা রিং এর বক্স খুলে বলল
-উইল ইউ মেরি মি?
আমি পুরাই টাস্কি খাই গেলাম!বলে কি মেয়েটা!!!
-প্রপস করছস ভাল কথা,এইটা কি রিং দিলি না গোল্ড না ডায়মন্ড।
-পিওর প্লাটিনাম। ভাইয়া বাইরে থেকে আনছে।
-তুই ভাল করেই জানিস আমি তোকে বিয়ে করবনা। যদিও করি তাহলে বিবিএ পাসের পর।
-ততদিনে আমি থাকব না
-কই যাবি?
-তুই আমাকে বিয়া না করলে এমবিএ করতে লন্ডন যাব। হয়ত আর আসব না।
-হুম।
-ওকে একটা ডিল হোক
-মানে?
-আমার ব্যাংক একাউন্টে এখন প্রায় ৫ কোটি টাকা আছে
-তো?
-আমাকে বিয়ে করার ৬ মাস পর এই টাকা তোকে দিয়ে দিব। দেন আমাকে ডিভর্স দিয়ে দিস।
-ইম্পসিবল।
আমি স্পষ্ট দেখলাম ওর দুই চোখ পানিতে ছলছল করছে।
-বুঝলাম। চল উঠি
-চল
বাসায় যেয়ে ঘুমানোর আগে ওকে নিয়ে অনেক চিন্তা করলাম। আমি এই পর্যন্ত যত প্রেম করছি ও সব জানে,তারপরও কেন ও এইটা করল?কোন দিনত ও আমাকে বলে নাই যে ও আমাকে ভালবাসে,আর আমিওত ওকে খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড হিসাবে দেখছি আর কিছু না।
ভাবতে ভাবতে ঘুমাই গেলাম।
পরের দিন নাকি ওর বড় ভাই আসছিল আমার আব্বু-আম্মুর কাছে। উনি নাকি আব্বুকে বলছিল আমি যদি রোদেলাকে বিয়ে করি তাহলে আমার নামে একটা ইন্ডাস্ট্রি লিখে দিবেন। আব্বু এতে খুবই আপমানিত বোধ করলেন তাই ওইখানেই সব সেশ। তারপরও রোদেলার সাথে আমার বন্ধুত্ত নষ্ট হ্য়নি।
কিন্তু মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতাম ও আমার থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছে।
২ মাস পর। ১৮ই জুন। রোদেলার জন্মদিন। রাত ১২ টায় কল দিলাম।
-শুভ জন্মদিন
-ধন্যবাদ। আজ দুপুরে আমার বাসায় তোর দাওয়াত।
-ওকে,আসব।
তারপর কিছু টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।
সকালে ওর জন্য সুন্দর থেকে একটা নেকলেস কিনলাম।
দুপুরে ওর বাসায় যেয়ে দেখি মস্ত আয়োজন। ওর সব ফ্রেন্ডরা এসেছে। কেক কাটার পর লাঞ্চ করলাম সবাই। আমার মাথাটা খুব ধরেছে। সারা রাত বুটিকস হাউসের জন্য কিছু পোশাক ডিজাইন করেছি।
আর নেট এ ফ্রী-ল্যান্সিং করি। তাই ভোরেও কিছু কাজ করতে হইছে। যার ফলাফল মাথা ধরা। রোদেলাকে বলতেই ও বলল ওর রুমে যেয়ে দরজা লক করে ঘুম দিতে। কেউ আমাকে ডাকবেনা।
ওর রুমে ঢুকে দরজা লক করলাম। এই রুমে আগেও এসেছি তাই জানি ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে টুকটাক ওষুধ থাকে। তাই মাথাবেথার ওষুধ খোঁজার জন্য ওর ড্রয়ার খুললাম। কোন ওষুধ নাই। শুধু একটা ডাইরি দেখতে পেলাম।
কি ব্যাপার ওত ডাইরি লিখেনা। যাজ্ঞে। ঘুম দিলাম।
টানা আড়াই ঘণ্টার ঘুম ভাঙ্গল ওকে হারানোর স্বপ্ন দেখে। কি মনে হল ওর ডাইরিটা খুল্লাম।
কয়েক লাইন পড়ে আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে উঠল। দুই মাস আগে ওর ব্রেইন টিউমার ধরা পরছে। ডাক্তারের মতে ও মাত্র ৬ মাস বাঁচবে। মানে আর মাত্র ৪ মাস বাকি আছে ওর। ও ওর ফামিলির সবাইকে বুজাইছে এটা যেন কেউ না জানতে পারে।
বিশেষ করে আমি। আস্তে করে ডাইরিটা রেখে দিলাম।
পরের দিন আম্মুকে সব বুঝিয়ে বল্লাম,আব্বুকে রাজি করাতে বলে আমি বের হয়ে গেলাম। সকাল ১১টা, ফোন দিলাম ওকে। তারাতারি জিইসি মোড়ে আয়।
আধ ঘণ্টার মাথায় ও পোঁছাল। ওকে নিয়ে সোজা কাজী আফিস এ আসলাম। কিন্তু ও মানা করল। বলল ওর ভাইয়াকে না জানিয়ে কিছু করবেনা। রাজি হলাম।
এখনও বলিনাই আমি ওর সব কথা জানি। রাতে শুধু দুই ফামিলির উপস্থিতিতে বিয়ে হল।
বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই আমরা ইউরোপে হানিমুন এ গেলাম। পুরো তিন মাস হানিমুনে কাটালাম ওর কথামত। একটিবারও ওকে জানতে দেইনাই আমি যে ওর অসুখের কথা জানি।
সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল হানিমুনে ও একটা ছবিও তুলতে দেয় নাই। তিন মাস পর তখন সুইডেন এ আমরা। হঠাৎ ওর অবস্থার খুব অবনতি হল। ওইখানের ডাক্তাররা বলল কিছুই করার নাই। ওকে নিয়ে দেশে যেতে।
দেশে আসার পর ওর সাথে আমার শেষ কথপকথন,ও আমার হাত ধরে ক্লিনিকের বেডে শুয়ে আছে।
-তুমি আমার ডাইরি পড়ছিলা,তাইনা?
আমার দুই চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারার মত পানি ঝরছে,আমি নির্বাক,কি বলব
-আচ্ছা তুমি কি আমাকে একটুও ভালবাসনা?আমি মারা যাব জেনে তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে তাইনা?
আমি চুপচাপ ওর কথা শুনছি
-জবাব দেও
-আগের কথা বাদ দেও,এখন আমি তোমাকে কত ভালবাসি তা তো তুমি জান।
রোদেলা মাথা নাড়াল।
-তুমি একটু আমার পাশে বসবা?আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাব।
আমি ওর বেডে বসলাম,ওর মাথাটা আমার কোলের উপর রাখলাম।
ও শক্ত করে আমার হাতটা ধরে ওর বুকের উপর রাখল। কতক্ষণ হবে জানিনা হঠাৎ টের পেলাম ওর হাতের চাপটা হালকা হয়ে গেছে। টের পেলাম ওর বুকের স্পন্দনটাও থেমে গেছে চিরতরে। সাথেসাথে বুকের ভিতর থেকে অস্ফুস্ট আর অব্যাক্ত এক চিৎকার বেরিয়ে আসল।
৪ বছর পর.........
সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ।
ফজরের আজান দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম ভাঙল আমার। বিছানায় হাত দিয়ে বুঝলাম রোদেলা নেই। গত ৪ বছর এই একটা আভ্যাস হয়ে গেছে। যদিও জানি ও আমার থেকে অনেক দূরে তারপরও ওর কোনকিছুই আমি ভুলতে পারছিনা।
আজ আমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এমবিএ সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে।
গত ৪ বছরের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেশের টপ ফ্যাশন ডিজাইনারদের ভিতর আমি অন্যতম। আন্তর্জাতিক ভাবেও আমি দুইটা পুরষ্কার পেয়েছি। দেশে-বিদেশে আমার বুটিক হাউসের যথেষ্ট সুনাম। ইন্টারিয়র ডিজাইনার হিসাবেও আমার অনেক সুনাম।
সমাজে সবাই আমাকে এক নামে চেনে কিন্তু কোন একটা কিছুর অভাব আজ আমার আছে,আজীবন থাকবে। রোদেলার কথা মনে হতেই নিজের অজান্তে বুকের বামপাশটা মোচড় দিয়ে উঠে।
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।