আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি আত্নহত্যার নিউজ এবং তৎপরবর্তী প্রতিক্রিয়া

যে মুখ নিয়ত পালায়......। । আমরা পড়ালেখা করি কেন? সহজ উত্তর জ্ঞান অর্জনের জন্য। ভাল মানুষ হওয়ার জন্য। মানুষের মত মানুষ।

তবে এই উত্তর টা কেতাবি উত্তর। পরীক্ষায় যদি এই প্রশ্ন আসে তবে এভাবেই আমরা উত্তর দেব। কিন্তু বাস্তব জীবনে পড়ালেখা করার কারণ সম্পর্কে সবাই সচেতন বা অচেতন ভাবে একমত। সেই মতটা হল “টাকা উপার্জন”। এস এস সি বা এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্টের পর পত্রিকা খুললে দেখা যায় “অমুক ডাক্তার হয়ে মানবতার সেবা করতে চান” তমুক “ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ গড়তে চান”।

দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য কারো অন্য কিছু হওয়ার ইচ্ছা খুব কম। আমি কখনো দেখি নি কেউ বলছে লেখক হতে চায়। যদি কোনদিন পাই তাহলে ছবি তুলে রাখব। এই মানসিকতার জন্য আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট দায়ী। দেশের মূল শক্তি হচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজ।

একটা দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনী যতদিন না পরিবর্তীত হচ্ছে ততদিন এর উন্নতি অসম্ভব। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের একটা সুন্দর চিত্র ফুটে উঠে এই ভাল রেজাল্ট করা ছাত্রদের “আমি ডাক্তার হয়ে মানবতার সেবা করতে চাই” টাইপ ইচ্ছে প্রকাশের মাধ্যমে। অভিভাবক রা ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দেন তোমাকে ডাক্তার হতে হবে। কারন ডাক্তারদের সামাজিক মান সম্মান, টাকা পয়সা দুটোই প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশী। ছেলে/মেয়ে বড় হয় ডাক্তার হবার আশা নিয়ে।

তিন চারটা কোচিং সেন্টারে চলে জ্ঞান(!) অর্জন। সারাদিন জ্ঞান অর্জন শেষে ক্লান্ত খোকন ঘরে ফেরে। মা/বাবা হরলিক্সের গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে বলেন, নে বাবা। খেয়ে আবার পড়তে বস। খোকন আবার পড়তে বসে।

মুখস্ত বিদ্যার প্রতিযোগীতায় ঠিকতে হলে প্রচুর মুখস্ত তথ্য প্রয়োজন। সে তথ্য ঠেশে ভরতে থাকে মন মগজ বা মস্তিষ্কে। সেই তথ্যের ঠেলায় প্রায়শই বেরিয়ে যায়, মনুষত্ব্য, মূল্যবোধের মত অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো। এতে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। খোকনের না, খোকনের অভিভাবকদের ও না।

পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে। অভিভাভকেরা খোজঁ খবর নেন প্রশ্ন টশ্ন আউট হবে কি না। কয়েকজনের সাথে কথাবার্তা ও ঠিক করে রাখেন। তিন লাখ টাকায় প্রশ্ন। এক লাখ আগে।

দুই লাখ পরীক্ষার পর। পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন বিক্রেতার নির্ধারিত বাসায় চলে যান খোকন কে নিয়ে। আরো অনেকে তাদের খোকন দের নিয়ে এসেছে। এই খোকনেরা একদিন ডাক্তার খোকন চৌধুরীতে পরিণত হবে। তারপর আর্ত মানবতার সেবার নিজের দেহ প্রান আত্না সব উগরে দেবে।

দু চোখ ভরা স্বপ্ন অভিভাবকদের। খোকন ৭০-৮০টা অবজেকটিভ মুখস্ত করে ফুরফুরে মনে পরীক্ষা হলে যায়। পরীক্ষা শেষ হয়। খোকন বেরিয়ে আসে। তার চোখ মুখ বিধ্বস্ত।

একটাও প্রশ্ন কমন পড়ে নি! খোকনের আর্ত মানবতার সেবা করা আর হয়ে উঠে না। খোকনের বাবার ও ডাক্তার খোকন চৌধুরীর বাবা হয়ে উঠে না। কিন্তু খোকন দের মনে নীতি নৈতিকতা যা ছিল তা দৌড়ে পালায়। সব ক্লাসে প্রথম হওয়া খোকন প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দেয়ার অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে অভিভাবকদের হাত ধরে প্রবেশ করে দূর্নীতির জগতে। আর যেসব খোকন সম্প্রদায় মুখস্ত বিদ্যার পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় তারা আরো মুখস্ত বিদ্যা চালিয়ে যেতে থাকে।

তাদের অভিভাবকরা আরামে চোখ বুঝেন। তিনি এখন ডাক্তার খোকন চৌধুরীর বাবা। এই খোকন দের কথা বাদ। এখন আসা যাক আরেক ছাত্রসম্প্রদায়ের কথায়। মধ্যম মানের স্টুডেন্ট।

বিশ্বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে অনেক কোচিং টোচিং শীট মুখস্ত করে। একটাই লক্ষ্য পাশ করে বের হবে। ভাল চাকরী করবে। কিন্তু মাঝপথে হতাশা এসে গ্রাস করে। সিজিপিএ খারাপ।

বন্ধুরা সবাই নিজেদের সিজিপিএ নিয়ে চিন্তিত। যেন এই সিজিপিএ ই জগতের সবকিছু। কিন্তু তার সিজিপিএ মাত্র ৩! অনেকে বলছে কিছুই হবে না! ৩ পয়েন্ট ফাইভের নীচে হলে ঘোড়ার ঘাস কাটাও যায় না এই দুনিয়ায়! হতাশ ছাত্র রাত জেগে পরে। দিনে পরে। মুখস্ত করে।

নোট করে। তারপর প্রচুর টেনশন নিয়ে পরীক্ষার হলে যায়। অতিরিক্ত টেনশনে আবার সব ভূল করে আসে! একজন হতাশ ভাব দেখে বলে, গাঞ্জা খা। টেনশন চিন্তা দূর হবে। হতাশাগ্রস্থ ছাত্র, গঞ্জিকা সেবন করে চিন্তা দূর করতে।

আস্তে আস্তে গঞ্জিকা আসক্ত হয়ে পড়ে। রেজাল্ট আরো খারাপ হয়। তারঅপর স্যারেরা তাকে দেখতে পারেন না। মার্ক কম দেন। এটা তার মনে হয়।

একদিন রাতে চিন্তা করতে থাকে। এই রেজাল্ট দিয়ে তো কিছুই হবে না। পাশ করার পর চাকরী ও পাবে না। তার বৃদ্ধ বাবা মা আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন ছেলে পাশ করবে। চাকরী করবে।

আর সে কী করছে? গাঞ্জা আর ফেন্সিডিল খেয়ে নিজেকে ভাবছে পৃথিবীর মহাশক্তিধর কেউ! হতাশার আকার চরম হয়। হতাশাগ্রস্ত ছাত্রের কান্নার শব্দ শোনা যায়। এই কান্নাকে রাত্রীর গভীরতার কারনে বা অন্য কোন কারনে মনে হয় এই পৃথিবী, এই সমাজ এই সভ্যতার প্রতি তিক্ত উপহাস। পরদিন সেই ছাত্রকে রুমেই পাওয়া যায়। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়।

ঝুলার সময় হয়ত তার মনে হয়েছিল সরল দোলকের সূত্রের কথা। যে সূত্র সে একদিন মুখস্ত করেছিল অনেক আশা নিয়ে, একদিন বড় হবে। সে বড় হয় না। তার মৃত্যুতে দেশ বা সমাজের কিছু যায় আসে না। হতাশা যে একটা মানসিক রোগ তার স্বীকৃতি ই নেই এই দেশে! এই ছাত্রের মনে একরাশ হতাশা আকাশ থেকে উড়ে আসে নি।

এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ তার মনে ঠেলে ভরে দিয়েছে হতাশা। তারপর আস্তে আস্তে যন্ত্রনাদগ্ধ হয়ে সে মৃত্যুবরন করেছে। তাকে পরোক্ষভাবে হত্যা করা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। এভাবে হত্যা চলবে। মানুষ প্রতিবাদ করবে না।

মানুষ হতাশাকে রোগ মনে করে না। তাদের সোজা কথা, আত্নহত্যা কর কেন?তোমারে কে বলছে মরতে? বাঙালী মধ্যবিত্ত প্রতিবাদ করবে না। তাদের হিন্দি সিরিয়াল আর জি বাংলায় বাংলা লুতুপুতু টাইপের সিরিয়াল দেখার পর সময় কোথায় যে প্রতিবাদ করবে। বাঙালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা প্রতিবাদ করবে না। তারা সালমান খানের ডিংকা চিকা স্টাইল আর বডিগার্ডের বডিতে মুগ্ধ।

তাদের মুগ্ধতা কাটতে সময় লাগবে। ততদিনে মুন্নি শীলাদের নতুন কিছু চলে আসবে। তারা সেসব নিয়েই আছে। দেশ সমাজ রাষ্ট্র এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়! বুদ্ধিজীবিরা তো ব্যস্ত তাদের নিজস্ব বুদ্ধির চর্চা নিয়ে। তাদের এসবের টাইম নেই।

প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রী ব্যস্ত নামায আর তসবী জপা নিয়ে। কে কত বেশী নামায রোজা করেন সেসবের হিশাব নিচ্ছেন একে অন্যের কাছ থেকে। তাদের এসব আত্নহত্যার মত নাফরমানী কাজ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই! আজকে যে খবরটি পরে এই লেখাটা লিখতে বসলাম সেটা হল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করেছেন। এর আগে জুন জুলাইয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুজন আত্নহত্যা করেছেন। এভাবে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আত্নহত্যা চলছে।

চবি তে নাকী ছাত্রদের কাউন্সেলিংযের জন্য ছাত্র নির্দেশনা কেন্দ্র আছে। প্রতিবছর টাকা ঢালা হয়। কিন্তু তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। কোন মনোবিজ্ঞানী নেই সেখানে। যিনি নিউজটা শেয়ার করেছিলেন, তিনি লিখেছেন, “42 lakh takar garite vromon kora VC sir....ektu nojor din....versityte pori bole ki amdr ma-baap nei??” ভিসি স্যারের নজর দেয়ার সময় থাকুক আর না থাকুক আমার ৪২ লাখ টাকার গাড়িটার দিকে নজর দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

নিশ্চয়ই গাড়িটা অনেক সুন্দর। লিংকঃ ১। এক ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার,বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা, নিস্ক্রিয় ছাত্রনির্দেশনা কেন্দ্র ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.