এক. শনিবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৬৬তম অধিবেশনে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনে একটি ভাষণ দিয়েছেন। অকুস্থলে শ্রোতার সংখ্যা ছিল একশর কম। কিন্তু বাংলাদেশে বিটিভি এবং তিন-চারটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচারের ফলে শ্রোতা দর্শক ছিল নিশ্চয়ই কোটির বেশি। সম্প্রচারের সময়টি বাংলাদেশ সময় রাত প্রায় সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার একটু বেশি হওয়ায় শ্রোতা-দর্শক সংখ্যা ছিল আওয়ামী লীগের আশার তুলনায় কম। সম্প্রচারের সময়টা ছিল বক্তার প্রতিকূলে।
দুই. মঙ্গলবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে বিরোধী দলীয় নেত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ঢাকায় নয়া পল্টনে তার দলীয় অফিস ভবনের সামনে রাজপথে বানানো ছোট মঞ্চ থেকে একটি ভাষণ দিয়েছেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, এই ভাষণটি বিটিভি সম্প্রচার করে নি। কিন্তু ইটিভি ও বাংলাভিশনসহ আরো দু’একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারের ফলে এখানেও শ্রোতা-দর্শক ছিল সম্ভবত কোটির বেশি। সম্প্রচারের সময়টি, বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছ’টা ছিল বক্তার অনুকূলে। অকুস্থলে শ্রোতার সংখ্যা ছিল কয়েক লক্ষ এবং এই সংখ্যা ছিল বিএনপির আশার তুলনায় বেশি।
এটা বোঝা যায় কারণ এই সভার আয়োজকরা স্পিকার ও টিভি মনিটর ফিট করেছিলেন, কাকরাইলের মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত। কিন্তু শ্রোতা জমায়েত হয়েছিল কাকরাইলের গোলচত্বর ও মসজিদ থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত। এখানেই হাসিনা ও খালেদার ভাষনের ছবিটি গুণগতভাবে ভিন্ন হয়ে যায়। নিউ ইয়র্ক জাতিসংঘ ভবনে হাসিনার লাইভ অডিয়েন্স সংখ্যায় ছিল কম এবং সেটা টিভিতে দেখা যায়। ঢাকায় ভিআইপি রোডে খালেদার লাইভ অডিয়েন্স সংখ্যায় ছিল বিশাল এবং এটাও টিভিতে দেখা যায়।
যার ফলে, এর রাজনৈতিক প্রভাবও হয়েছে বিরাট।
তিন. বুধবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক ম্যাগাজিন নিউ ইয়র্ক (প্রকাশনা তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১১)-এ গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ইন্টারভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩৩-এ প্রতিষ্ঠিত নিউজউইকের বর্তমান সার্কুলেশন হচ্ছে ১৫ লক্ষ এবং এটির চারটি ইংরেজি সংস্করন ও বারোটি বিভিন্ন ভাষার সংস্করন প্রকাশিত হয়। ধরে নেয়া যেতে পারে ড. ইউনূসের এই ইন্টারভিউটি সারা বিশ্বে অন্তত পক্ষে ১৫ লক্ষ পাঠক পড়েছেন। এখানেই হাসিনা-খালেদার ভাষণের সঙ্গে ড. ইউনূেেসর ইন্টারভিউ গুণগতভাবে ভিন্ন হয়ে যায়।
হাসিনা ও খালেদা, উভয়েরই ভাষণ ছিল বাংলায় এবং সেটা দেখেছেন ও শুনেছেন বাংলাদেশিরা। ড. ইউনূস ইন্টারভিউ দিয়েছেন ইংরেজিতে এবং সেটি পড়েছেন সারা বিশ্বে বহু ভাষী পাঠক।
এই দুটি ভাষণ ও একটি ইন্টারভিউ দিয়েছেন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস যিনি ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ সেনা অভ্যুত্থানের পর হতে পারতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেনা নির্বাচিত প্রধান উপদেষ্টা। তাই বাংলাদেশে আসন্ন রাজনৈতিক ঝড়ের আগে এই তিন প্রধান ব্যক্তি যেসব বক্তব্য রেখেছেন সেসবের তাৎপর্য ও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যেতে পারে।
আমার প্রিয় ভুল
প্রথমে ড. ইউনূসের ইন্টারভিউয়ের বাংলা অনুবাদ পাঠকদের পড়ে নেয়া উচিত হবে।
নিউজউইকের মাই ফেভারিট মিসটেক বা আমার প্রিয় ভুল নামের নিয়মিত ফিচারে ড. ইউনূেেসর ছবিসহ ইন্টারভিউটি বেরিয়েছে। তিনি বলেছেন:
১৯৭৬-এ আমি ২৭ ডলার দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করেছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল গরিবদের সাহায্য করা। এর জন্য দরকার ছিল গরিব এন্টারপ্রেনিউয়ারদের কোনো কোল্যাটারাল বা বন্ধক ছাড়া ছোট পরিমাণে লোন বা ঋণ দেয়া, যেন তারা তাদের নিজস্ব বিজনেস বা ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
গ্রামীণ যে উৎসাহ সৃষ্টি করে তাতে আমি সেটা সম্প্রসারণে উদ্যোগী হই।
তাই আমি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক)-এর কাছে গিয়ে বলি গরিবদের জন্য একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আমি বৈধ কর্তৃত্বের অনুমোদন চাই। সরকার রাজি হয়। পরবর্তীতে এই মর্মে সরকার একটি আইনও পাস করে। কিন্তু ওই আইনে একটা শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, আরবান বা শহর এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করতে পারবে না।
বস্তুত আমিই এই শর্তের প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম।
আমি একজন প্রফেসর ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম বোর্ড হয়তো গ্রামীণ চালাতে শহরে বসবাসকারী একজন ব্যাংকারকে চাকরি দিয়ে নিয়ে আসবে এবং তিনি ব্যাংকের ফোকাসটা গ্রামের গরিবদের থেকে সরিয়ে ফেলবেন। বাংলাদেশে গরিবদের মাত্র ১৫ শতাংশ শহরে থাকে। বাদবাকিরা থাকে গ্রামীণ এলাকায়। আমি চাইনি তাদের কেউ ভুলে যাক।
গ্রামীণ শব্দের মানেটাই তো গ্রাম বিষয়ক।
ব্যাংকের আয়তন বেড়ে যাবার সাথে সাথে বুঝতে পারি আমি একটা ভুল করেছি। অনেকেই আমাদের সাহায্য চাইছিল কিন্তু পাচ্ছিল না। আমরা আইনটি বদলানোর চেষ্টা করি। ২০০৭-এ সরকার এতে রাজি হয়।
কিন্তু পরবর্তী প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় কারণ যখন আমরা গ্রামীণ শুরু করেছিলাম তার তুলনায় বাংলাদেশে এখন বেশি শহর আছে এবং সেখানে যেসব গরিব আছে তাদের সাহায্য করা আগের চাইতে আরো জরুরি হয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক আমি আর এখন চালাচ্ছি না। এ বছরের গোড়ার দিকে সরকার আমাকে বাধ্য করেছে পদটি ছেড়ে দিতে। সরকার যুক্তি দেখিয়েছে ১১ বছর আগেই আমার রিটায়ার করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল।
যে আইনের দ্বারা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে রাজি হবার সময়ে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (যে পদে আমি আগে অধিষ্ঠিত ছিলাম) নিয়োগের কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম সরকারকে। এটা ছিল আমার আরেকটি বড় ভুল।
তবে আমার শিক্ষা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে এখনো শহরের গরিবদের সাহায্য দিতে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে, আমি এখন বিশ্ব জুড়ে অনুরূপ কিছু প্রজেক্ট চালু করেছি।
এবার আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছি না।
যেমন, ২০০৮-এ নিউ ইয়র্কের কুইন্স এলাকায় একটা কর্মসূচি চালু করেছি। গেইল ফেরারো (Gayle Ferraro) একটি ডকুমেন্টারি মুভি বানিয়েছেন যার নাম টু ক্যাচ এ ডলার (To Catch a Dollar অর্থাৎ, একটি ডলার ধরতে)। এই মুভিটি এই সপ্তাহে আমেরিকার বিভিন্ন হলে মুক্তি পাবে। এই মুভিতে দেখানো হয়েছে বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে যে মন্দাবস্থা চলছে, সেটা সত্ত্বেও আমরা শহরের গরিবদের কীভাবে সাহায্য করতে পেরেছি।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটাই হবে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ।
তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া
এবার বিবেচনা করা যাক ড. ইউনূসের এই ইন্টারভিউয়ের তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া।
মাই ফেভারিট মিসটেক বা আমার প্রিয় ভুল বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। ভুল কি কখনো কারো প্রিয় হতে পারে? ড. ইউনূস হয়তো বলতে পারতেন তার সবচেয়ে বড় ভুল কোনটি ছিল? সেক্ষেত্রে নিউজউইকের এই ফিচারের নাম হতে পারতো মাই বিগ মিসটেক বা আমার বড় ভুল।
সে যাই হোক। ড. ইউনূসের নিজের মতে তার প্রথম ভুলটি ছিল গ্রামীণ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শহরে নিষিদ্ধ করণে রাজি হওয়া এবং দ্বিতীয় ভুলটি ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্তির কর্তৃত্ব সরকারকে দেয়া।
গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার বিষয়ে ড. ইউনূসের এই দুটি ভুলের মধ্যে প্রথমটির কারণ তিনি বলেছেন, তিনি কল্পনা করতে পারেন নি যে শহরে অনেক গরিব এনটারপ্রেনিউয়ার থাকবে। আর দ্বিতীয় ভুলের কারণ তিনি না দর্শালেও বোঝা যায়, শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ঈর্ষার গভীরতা তিনি আগে অনুমান করতে পারেন নি।
এই প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ-এ ২৯ জুলাই ২০১১-তে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে।
পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসার শিকার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন, ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বয়সের ছুতা ধরে সরানো হয়েছে। কিন্তু এটা আসল কারণ বলে আমরা মনে করি না।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সমাজে কখনও গ্রহণীয় হবে না। তিনি বলেন, ড. ইউনূস হচ্ছেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। অন্ধকারে বাতিঘরের মতো যিনি বিশ্বের অগণিত মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তার আবিষ্কৃত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ নিজ পায়ে দাড়াতে শিখেছে।
তবে এটা অত্যন্ত মর্মবেদনার বিষয় যে, সেই লোকটিকে বাংলাদেশে অপমান করা হয়েছে।
দারিদ্র বিপর্যস্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ বিষয়ক এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন নিউজওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন। বুধবার ম্যানহাটানে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। সন্ধ্যা আটটার দিকে বিল ক্লিনটন অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। এসময় অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলতে ভিড় জমান।
এ অবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠান শেষে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন নিজেই এগিয়ে এসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় তারা কুশলাদি বিনিময় করেন।
বিল ক্লিনটন বলেন, আরকানসর গভর্নর থাকা অবস্থায় আমরা নিজেরাই ড. ইউনূসকে নিয়ে গিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করেছিলাম। সেটা এখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি জনপ্রিয় কর্মসূচি।
আমি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এর যত ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন সেটা করেছি। এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় যে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেও ড. ইউনূসের একজন অনুরাগী। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজেও এই কর্মসূচিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্বের দারিদ্র দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের কার্যকারিতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্ববাসী সবসময় স্মরণ করবে।
ইতিহাসের পাতা থেকে কেউই তার নাম মুছতে পারবে না।
অনুষ্ঠানে পুরষ্কার গ্রহণের পর সবার উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও ক্লিনটন গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র ঋণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দারিদ্র্য বিমোচনের কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের এসব বক্তব্যে স্পষ্ট যে তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন বাংলাদেশে ড. ইউনূসকে কেন অপমান করা হয়েছে।
কেন ড. ইউনূসকে বাংলাদেশে সুদখোর বলা হয়েছে। কেন, ডেনমার্কের একটি ডকুমেন্টারি মুভির ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকের ফান্ড, এক একাউন্ট থেকে আরেক একাউন্টে ট্রান্সফারের বিষয়টিকে এক ধরনের দুর্নীতি বলে বাংলাদেশ সরকার আখ্যায়িত করেছে। আসলে ড. ইউনূসের প্রথম বড় ভুলটি হচ্ছে নোবেল প্রাইজ নেয়া!
মেজর রাজনৈতিক ভুল
তবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় ভুলটি হচ্ছে, তিনি সরাসরি রাজনীতিতে আসতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়টি তিনি নিউজউইকের ইন্টারভিউতে বলেন নি। ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের সমর্থনে ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার ঠিক এক মাসের মাথায় ড. ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন।
এই ঘোষনার পরপরই ড. ইউনূসের প্রতি বিরূপ জনমত দেখা দেয়। জনগণের সমর্থন না পেয়ে তিনি ওই বছরেই ৩ মে-তে রাজনৈতিক দল গঠনের প্ল্যান থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।
কেন ড. ইউনূস এই ভুলটি করেছিলেন, এ বিষয়ে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তার বই “শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতি চারণ”-এ লিখেছেন:
“আমাদের সামনে তখন অনেক কাজ। সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিরপেক্ষ ও সর্বজনবিদিত একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন করা যিনি জটিল এ সময়ে আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এ ব্যাপারে সবার আগে সদ্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হলো।
এখানে উল্লেখ্য যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস অথবা ড. ফখরুদ্দীনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। আমারও মনে হলো দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতার কারণে নিশ্চিতভাবে ড. ইউনূস এ পদ গ্রহণে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে আগ্রহী হলেন না। সবার অনুরোধে আমি তাকে ফোন করে প্রধান উপদেষ্টা হতে অনুরোধ করে সবরকমের সহায়তার নিশ্চয়তা দিলাম। তবুও তিনি রাজি হলেন না।
তিনি বললেন, বাংলাদেশকে তিনি যেমন দেখতে চান সে রকম বাংলাদেশ গড়তে খ-কালীন সময় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে তিনি আরো দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিতে আগ্রহী। সেই মুহূর্তে আমি ড. ইউনূসের কথার মমার্থ বুঝি নি। তিনি একজন মহান ব্যক্তি। তিনি আসলে কাউকে অবলম্বন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান নি।
পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি তিনি একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন যদিও পরিস্থিতির কারণে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিলো। ”
ন্যাড়া বেলতলায়
জেনারেল মইন লিখেছেন, “তিনি আসলে কাউকে অবলম্বন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাননি। ”
অর্থাৎ, সেনাবাহিনীকে অবলম্বন করে নয়, নিজের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তিকে অবলম্বন করে ড. ইউনূস ক্ষমতায় যেতে অভিলাষী ছিলেন।
কিন্তু নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে জনপ্রিয়তা এবং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও উন্নতিতে সাংগঠনিক শক্তি তার কোন রাজনৈতিক ক্যারিসমা যে সৃষ্টি করে নি, সেটা ড. ইউনূস বোঝেন নি। তিনি দেশের মঙ্গলার্থেই রাজনীতি করতে চাইলেও, এই ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপরিচিত ও নবীন।
পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়েই ছিলেন এবং এখনো আছেন পারিবারিকভাবে ও নিজস্ব যোগ্যতায় সুপরিচিত ও অভিজ্ঞ।
ড. ইউনূস তার এই ভুলটি বুঝতে পেরেই দ্রুত রাজনীতি থেকে সরে দাড়ান। আবার কোনো দিন তিনি রাজনীতিতে ফিরবেন কিনা তেমন একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।
মাইনর ভুল
এই মেজর ভুলটি ছাড়াও, কিছু সমালোচকের মতে ড. ইউনূস একটি মাইনর ভুল করেন, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকার আনীত বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থার মোকাবিলা আইনিভাবেই করার সিদ্ধান্তে। এসব সমালোচকরা বলেন, এটা যখন স্পষ্ট ছিল যে আওয়ামী সরকার প্রশাসনকে দলীয় করেছে, বিচার বিভাগকে সাজিয়েছে, এবং তার অপসারণ ও অবমাননা ১০০% নিশ্চিত, তখন, ড. ইউনূস সব কিছু উপেক্ষা করে, সরকারের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিয়ে বিদ্রোহী অবস্থান নিতে পারতেন।
হয়তো সেভাবেই তিনি নিজের একটা লড়াকু ইমেজ সৃষ্টি করতে পারতেন যা তার জন্য তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক হতো এবং হয়তো ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সুবিধাদায়ক হতো। এই সমালোচকরা বলেন, ড. ইউনূস নিজের সুশীল কিন্তু পলায়নমুখী ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অপর দিকে ড. ইউনূস দাবি করতে পারেন তিনি আইন মেনে চলেছেন। তিনি সান্ত¡না পেতে পারেন, এটা ভেবে যে, এর ফলে বিদেশে তার সিভিলাইজড পার্সন ইমেজ দৃঢ় হয়েছে।
পলায়নমুখিতা নয়, সংগ্রামের পথে
এখন ড. ইউনূস কী করবেন?
আমেরিকার শহরগুলোতে গরিব এন্টারপ্রেনিউয়ারদের সাহায্যে ব্রতী হবেন? তাই তো তিনি বলেছেন।
তাহলে কি তিনি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন? তিনি চাইলেই কি সেটা পারবেন? সেটা কি তার পলায়নমুখিতাকে প্রতিষ্ঠা করবে না?
অনেকের ধারণা খুব সম্ভবত তিনি সংগ্রামের পথই বেছে নেবেন। গ্রামীণ ব্যাংক তারই সৃষ্টি। এই ধরনের সৃজনশীল কাজে বয়স কোনো বাধা হতে পারে না। যতক্ষণ ব্যক্তি সুস্থ ও ফিট থাকবেন ততক্ষণ তিনি কাজে নিযুক্ত থাকবেন। ভয়েস অফ আমেরিকাতেও এখন পূর্ব নির্ধারিত সময়ে রিটায়ার না করলেও চলে।
৭১ বছর বয়স্ক ড. ইউনূসও চাইবেন আবার বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করতে।
তার মাথায় যথেষ্ট চুল এখনো আছে। তিনি ন্যাড়া হন নি। সুতরাং বেলতলায় আবারও তাকে যেতে হতে পারে বাংলাদেশের মঙ্গল সাধনে। দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে।
আগামী দুই বছর বাংলাদেশকে খুব কঠিন সময় পার করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদেরই প্রিয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা থেকে সরে এসেছে। এক্ষেত্রেও তারা তাদেরই সাজানো বিচার বিভাগের রায় দেখিয়ে যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু বিএনপি এটা নাকচ করে দিয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে।
উপরন্তু বিএনপি দাবি করেছে, সব দলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অর্থাৎ, যে সংকটময় প্রেক্ষাপট ২০০৭-এর জানুয়ারিতে সৃষ্টি হয়েছিল, সেই রকমই সংকটময় আরেকটি প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হতে চলেছে ২০১৪ অথবা তার আগেই।
দুই নেত্রীর প্রতিই অনাস্থা, তবে …
তখন ড. ইউনূস যা করেছিলেন সেটা আমরা জানি। এখন ড. ইউনূস কী করবেন সেটা আমরা জানি না।
উইকিলিকসে ফাস হওয়া তারবার্তার মাধ্যমে আমরা এটাও জানি যে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এদের কারো প্রতিই ড. ইউনূসের আস্থা নেই।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, এই দুই নেত্রীই এখনো বাংলাদেশে রাজনীতির দুই প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। যদিও তুলনামূলকভাবে হয়তো খালেদা জিয়ার প্রতি ড. ইউনূসের কিছুটা বেশি শ্রদ্ধা আছে। কারণ, প্রথমত, খালেদা ঈর্ষাপরায়ণ নন। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিতে খালেদা তাকে তাৎক্ষনিক ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার ভাষা শালীন।
তিনি সুদখোর জাতীয় কোনো বিশেষণ কখনোই প্রয়োগ করেন নি।
তাহলে এখন ড. ইউনূস কোন পথ বেছে নেবেন?
এক. তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ ফিরে পেতে সচেষ্ট থাকবেন।
দুই. তিনি তার বিদেশী বন্ধুদের বোঝাবেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে কোন দল বেশি গণতান্ত্রিক। অতীতের আওয়ামী সরকারের চতুর্থ সংশোধনী এবং বর্তমান আওয়ামী সরকারের পঞ্চদশ সংশোধনী যে কতো অগণতান্ত্রিক সেটা তিনি তুলে ধরবেন।
তিন. বর্তমান আওয়ামী সরকার যে আবার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে সেটা তিনি নিউজউইকসহ অন্য মিডিয়াকে জানাবেন।
চার. প্রশাসন দলীয় করন ও বিচার ব্যবস্থাকে সাজানোর ফলে বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে সে কথা তিনি বলবেন।
ড. ইউনূস নিশ্চয়ই বোঝেন যে, প্রথম লক্ষ্যটি অর্জন করতে হলে পরবর্তী তিনটি কাজ এখন থেকেই করতে হবে।
(আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব, জাতিসংঘে শেখ হাসিনার ভাষণ)
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
শফিক রেহমান :প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।