আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি ন্যাংটা হওয়ার গল্প ও কিছু কথা … …

http://mdtarik.blogspot.com/ আমি বাংলায় ভালবাসি, আমি বাংলাকে ভালবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি... ১. ঘটনার শুরু আমার ছোট বোনকে দিয়ে। হঠাত প্রসঙ্গক্রমে একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, বলোতো বাংলা ভাষা কবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়? ওর সহজ-সরল উত্তর: ১৯৫২। আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম, এটাও ঠিকমত জানো না! এরপর ওর সাথে আরেকটু কথা বলে বুঝলাম, বিভিন্ন রচনা-বই আর Text বই পড়ে পড়ে “জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা” – এই টাইপের রচনা লেখার জন্যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ওর যতটুকু জানা-শোনা তা-কে ২/৩ লাইনেই সাজিয়ে ফেলা যায়। এরপর একটু ঘাটাঘাটি করলাম আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্লাস ৫/৬/৭ এর পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস অংশগুলো। দেখলাম, সব জায়গায়ই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে “ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস”টাকে প্রায় ৪/৫ লাইনের মধ্যেই বেধে ফেলেছে।

ঘটনাগুলো অনেকটা এরকম: জিন্নাহর “উর্দূ এবং উর্দূই …” ঘোষণা -> নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা -> ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করা -> রফিক, শফিক, ছালাম, জব্বারের মৃত্যু … ব্যাস, ভাষা আন্দোলন শেষ। ও আমাকে ওর পড়া সবগুলো বই এনে দেখালো যে, এর কোনটাতেই ১৯৫২ এর ২১ এ ফেব্রুয়ারীর মিছিলের পড়ে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত আর কোন তথ্য নেই। আমার বোনকে আর খুব বেশি দোষ দিতে পারলাম না। এরপর ফেসবুকে একটা জরিপ চালিয়ে দেখলাম যে ফেসবুক-বন্ধুদের অধিকাংশেরই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞান আমার বোনের মতই। বুঝলাম যে, এদের অধিকাংশই জানে না যে “২১ শে ফেব্রুয়ারি “জাতীয় শহীদ দিবস” হিসেবে পালন করতে পারার পিছনে যুক্তফ্রন্টের অবদানের কথা … ” জানে না, “ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামটাও … …”।

আর আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস প্রশ্নে জানাটা এককথায় একলাইন: ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। অধিকাংশই জানে না যে “আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস”এর স্বীকৃতি আদায় করার পেছনে প্রবাসী সালাম-রফিককে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে! ফেসবুকে একুশ নিয়ে Wall কাঁপিয়ে status দেয়া বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটা এখন ১ দিনের (২১ শে ফেব্রুয়ারি) ছকে আঁটকে পড়েছে। কয়েক বছর পরে সেটা হয়ত ১ ঘণ্টার ছকে আঁটকে পড়বে। কারণ ইতোমধ্যেই গ্রামীণফোন এটাকে ” ৩০ মিনিটেই ইতিহাস রচনা” হিসেবে দাবী করে !!! ২১ শে ফেব্রুয়ারি এখন শুধুই একটা উৎসবের উপলক্ষ! একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র! চুরি হতে হতে আমাদের এই বিশাল আন্দোলনের ইতিহাসটা এখন মাত্র কয়েকটা লাইনেই বন্দী হয়ে আছে! আজকালকার অনেকেই জানে না, “আমার ভাইয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি …” গানটার লেখক কিংবা গায়ক কে ছিলেন! ভাষা আন্দোলনের সুবিশাল ইতিহাসটা এখন ন্যাংটা প্রায় … ২. কয়েকদিন আগের কথা। আওয়ামী-লীগ খুব ঘটা করে ৬০ বছর পূর্তি উজ্জাপন করল।

বুয়েটে “আওয়ামী-লীগের জন্মদিন পালন” নিয়ে খুব উল্লসিত ছাত্রলীগের কয়েকটা ক্লাসমেট আর জুনিয়রকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা আসলে আওয়ামীলীগের জন্মের শানে-নুযুলটা জানে কিনা। খুব অবাক হয়ে উপলব্ধি করলাম, এদের কাছে “আওয়ামীলীগ” আর “শেখ মুজিব” প্রায় সমার্থক শব্দ! এদের ১ জনকেও পেলাম না যে জানে আমাদের ইতিহাসের কোন পর্যায়ে কীসের প্রয়োজনে “আওয়ামী লীগ”-এর জন্ম হয়েছিল! অথচ এরা একেকজন “জয় বাংলা … জয় বাংলা …” বলে দিনরাত গলা চেচায়! উপলব্ধি করলাম যে, ‘প্রতি বছর জন্মদিন পালন করলেও আওয়ামীলীগের ইতিহাস আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়, এটা পুরোপুরি চুরি হয়ে গেছে শেখ পরিবারের হাতে !’ যে আওয়ামীলীগ এক সময় ৬/৭ কোটি মানুষের সম্পদ ছিল, তা আজ চুরি হয়ে গেছে একটা পরিবারের হাতে!!! আর তাইতো জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জন্মদিনে শুধু তার বাবার কবরেই শ্রদ্ধা জানান, অকপটে “আওয়ামী লীগ”কে তার পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন; আর আমরা “নৌকার নতুন প্রজন্ম” নাম নিয়ে সেই জন্মদিন পালনের কেক খাই … … কোটি বাঙালির প্রাণের সম্পত্তি “আওয়ামী লীগ”এর ইতিহাসটাও আজ ন্যাংটা … … ৩. আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমূল্য অর্জন নিজেদের একটা পতাকা। ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে সব জাতীয় উৎসবে আমাদের রাষ্ট্রনেতারা জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে পতাকা তোলেন। অথচ গত কয়েকটা মাসে শ’খানেক বন্ধুর সাথে কথা বলে বুঝলাম, আমাদের পতাকার ইতিহাসটাও চুরি হয়ে গেছে! আমাদের পতাকার ডিজাইনার হিসেবে “কামরুল হাসান” এর নাম আজ সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু এর পুরো কৃতিত্বটা আসলে তার প্রাপ্য নয়! আমাদের পতাকার প্রকৃত ডিজাইনটা করেছিলেন “শিব নারায়ণ দাস” বুয়েটের শেরে-বাংলা হলের একটা রুমে বসে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আরও অনেক বিশিষ্টজন।

আমি গত কয়েকটা মাসে শেরে-বাংলা হলের অনেকের সাথে কথা বলে দেখলাম, এরা কেউই জানেনা, “সারা দেশ জুড়ে যে পতাকাটা পত পত করে ওড়ে তার যাত্রাটা শুরু হয়েছিল এই হল থেকেই !” কী করে জানবে বলুন, দোষটা যে ওদের নয়! বুয়েটে শেরে-বাংলা হলে ৪/৫ বছর কাটিয়ে গেলেও এটা জানার কোন উপায় যে নেই! কারণ জাতীয় জীবনের ইতিহাসের এই অংশটার কোন স্মারক শেরে-বাংলা হলে সংরক্ষণ করা হয়নি! কিংবা তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি কেউ! আমাদের ইতিহাসে “শিব নারায়ণ দাস” আজ একটা চুরি যাওয়া নাম! এক সময় হয়ত “কামরুল হাসান” নামটাও হারিয়ে যাবে! জয় কিংবা পুতুলের ছেলে দাবি করবেন তাদের Grand-Grand Papa স্বপ্নে এই পতাকা পেয়েছিলেন! কিংবা রহমান পরিবারের কেউ দাবী করবেন যে, এই পতাকার জন্ম হয়েছিল ১৫ অগস্ট, তাই ১৫ অগস্ট হবে “জাতীয় পতাকা দিবস” ! কিংবা Grameen Phone বিজ্ঞাপন করবে ১ মিনিটেই আকাশ থেকে ধপাশ করে নাজিল হল যে পতাকা ! ন্যাংটা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক পতাকার ইতিহাসটাও … … … ৪. আসলে আমার এই লেখাটার স্বার্থে উপরের উদাহরণ কয়টা ব্যবহার করলাম মাত্র। এ রকম চুরির লিস্ট নিয়ে একটা পোস্ট দিলে সেটাও হয়ত কয়েক শত লাইন হয়ে যাবে। আসলে জাতি হিসেবে আমরা হয়ত গর্ব করতে পারি। কিন্তু যাদের নিয়ে আমাদের এত গর্ব, আমাদের দেশে সেই কৃতি সন্তানেরা কখনোই খুব একটা সম্মান পায় নি। আর এ জন্যে কি আমরাই দায়ী নয়? এ দেশে চিরাচরিত-রাজনীতিবিদদের হাত ধরে যত উন্নতিই হোক না কেন – সেটা আমাদের দেশকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়ে আমি স্বন্দিহান।

কারণ আমাদের অধিকাংশ নেতাই আসলে “যথার্থ শিক্ষিত” নন। কিংবা “শিক্ষা” এদের অন্তরে পৌছায়নি। এদের অধিকাংশই ঠিকমত দেশের ইতিহাস জানে না। কিংবা জানলেও স্বার্থের বিবেচনায় সেই ইতিহাস স্বীকার করতে চায় না। অথচ নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেম, মূল্যবোধ – এগুলো গড়ে তোলার জন্যে এই ইতিহাসের বিস্তার অনেক বেশি জরুরী।

এদেশ যাদের কাছে “ঋণী”, সেই মানুষগুলো আমাদের কাছে যথার্থ রাষ্ট্রীয় সম্মান পায়নি কখনোই। অনেকেই পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আর তাই প্রতি পাঁচ বছরে আমাদের “দেবতা” বদলায়! ইতিহাস চুরি যায় প্রতিদিন। আওয়ামী লীগের আমলে দেশের ইতিহাস আটকে যায় “ছয় দফা থেকে ৭৫” এ , আর বিএনপি আমলে “২৭ শে মার্চ কালুরঘাট থেকে ৮১ পর্যন্ত” এসে। যত রাজনীতিবিদদের গালাগালি করি না কেন, দেশের এই করুন-রুগ্ন দশার জন্যে কি আমরা একটুও দায়ী নই? নিজের পরিবারে নিজের সন্তানকে দেশের ইতিহাসের শিক্ষা দেয়েছি আমরা কয়জন? কিংবা নিজের ছোট ভাইবোনদের? আমরা আমাদের ইতিহামকে লালন করিনি, তাই দিনে দিনে চুরি যাচ্ছে আমাদের সব রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক সম্পদ।

শত বছরের পুরোনো লালনের আখরায়ও আজ হাত পড়েছে চোরেদের! সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন লালনের আখরা বসবে GP-House এ, আমাদের তরুনরা ভাববে, লালন ছিলেন গ্রামীনফোনের একজন CEO !!! স্বার্থন্বেষী শাষকমহল নিজেদের স্বার্থেই মূলত ইতিহাস Modify করে। এ বছর এক লাইন Modify করতে পারলে পরের বছর তার ফল ভোগ করতে পারবে – এই আশায়। নব্বইয়ের দশক থেকেই এদেশে “নামকরণ” এর একটু নতুন রেওয়াজ চালু হয়েছে। পাবলিক টয়লেট থেকে শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পযন্ত সবকিছুতেই এই ব্যাধির ছোঁয়া লেগেছে। গত বিএনপি আমলে বরিশালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েই তার নামকরণ করা হল “জিয়া”র নামে! বরিশালে কী এমন একজন কৃতিসন্তানকেও খুঁজে পাওয়া গেল না ? জীবনানন্দ দাশ, অশ্বিনী কুমার দত্ত কিংবা ব্রজোমোহন দত্তরা কি বরিশালের জন্যে কিছুই করেন নি ??? একটা নভোথিয়েটার করা হল, তার নামও সেই “নামকরন” তত্ত্ব দিয়ে, এদেশে কি এমন একজন বিজ্ঞানীও পাওয়া গেল না যার নামটা টাঙানো যেত নভোথিয়েটারের দরজায় ??? অন্নদাশঙ্কর রায়ে “পারী” গল্পটা হয়ত পড়েছেন অনেকেই।

দেশের ইতিহাস তথা কৃতি সন্তানদের সম্মান জানানোর কী যথার্থ উপায় বের করেছে ফরাসীরা। অথচ আমরা আঁটকে গেলাম একটা “শেখ-রহমান” আবর্তে !!! ৫. প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদে জানা-অজানার যে কয়টি উদাহরণ দিলাম, তা শুধু দেয়ার জন্যে নয়। একজন মানুষকে সব জানতে হবে – তা নয়। কিন্তু ধরনের এই তথ্যগুলো নতুন প্রজন্মের এ জন্যে জানা জরুরী যে এগুলোর সাথে কৃতজ্ঞতাবোধ জড়িত। এদেশ অনেক ঋণে ঋণী।

প্রতিবছর ১৬ই ডিসেম্বর/২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরেই প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধে যান পতাকা তুলতে। আমরা কি পারতাম না একবারের জন্যে হলেও শিবনারায়ণ দাসের উত্তরাধিকারী কাউকে খুঁজে এনে একবার রাষ্ট্রীয়ভাবে পতাকা উত্তোলেনের সুযোগ দিয়ে শিবনারায়ণ দাসের প্রতি সম্মান জানাতে? প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদমিনারে প্রথম ফুলটা দেন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি; অথচ আমরা পারি না প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত কাউকে দিয়ে প্রথম ফুলটা দেয়াতে ? অথচ প্রথম শহীদ মিনারটা ঠিকই উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ-শফিউরের বাবা! এগুলো হয়ত শুধুই অনুষ্ঠানিকতা হবে, কিন্তু তবুও তো একটা রাষ্ট্রীয় সম্মান। আমাদের রাষ্ট্রীয় আচার আচরণ কখনোই কারও কাছে ঋণ স্বীকার করতে চায় না। আর তাইতো অনেক সময়ই দাবীও শোনা যায়, “৯৯ সালে আমাদের আমলেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে” !!! আর এভাবেই মুখে মুখে চুরি যায় আমাদের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধটাও এখন কয়েক লাইনের ইতিহাসে পরিনত হয়েছে।

কোন পাঁচ বছরে সেটা থাকে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”র নামে “মুক্তিযোদ্ধা কোঠা” বানিয়ে চাকরি বানিজ্যের মাঝে, আর অন্য পাঁচ বছরে সেটা থাকে “জামাত ইসলামীর ১৬ ডিসেম্বরে মিষ্টিবিলানো”র মাঝে। কোন পাঁচ বছরে সেটা থাকে “জয় বাংলা … বাংলার জয় … হবে নিশ্চয় …” গানে, পরের পাঁচ বছরে সেটা হয়ে যায় “প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ; জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ …”। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলেই প্রথম ২/৩ লাইনে কোন রকমে ” … আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল …” বলেই শুরু হয় ব্যাক্তিগত কৃতিত্ব চুরির পর্ব। ৬. আজকালকার তরুনদের মাঝে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে “জামাত ইসলামীকে গালি দেয়া” একটা ফ্যাশনে পরিনত হয়েছে। ৭১ এ কর্মকাণ্ডের জন্য জামাত ইসলামীর কতিপয় নেতা শুধু গালি নয়, গালির থেকে বেশি কিছু প্রাপ্য এদের।

কিন্তু ব্যাপারটা খটকা লাগে তখনই যখন দেখি, একাত্তরে পাক-জামাত বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে ফেসবুক-ব্লগ কাঁপিয়ে দেয়া তরুনেরা পাহাড়ে গণহত্যা নিয়ে কিছুই বলে না। একদিন হঠাত এক বড়ভাই ফেসবুকে তার একটা নোটের লিংক দিয়ে লাইক দিতে বললেন; গিয়ে দেখলম জামাতীদের গালি দিয়ে ব্যাপক এক প্যারোডি লিখেছেন। সাথে সাথে তুললাম পাহাড়ে গণহত্যার প্রসঙ্গটা। দেখলাম, ভাইয়ের ইন্টারেস্ট নাই। আমি “যুদ্ধাপরাধিদের সাফাই” গাইছি না মোটেই।

কিন্তু এই ফ্যাশনসূলভ গালি দেয়া, আর জামাতিদের গালি দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের ধিক্কার জানাই। আমাদের দেশের তরুণরা ইতিহাসটা জেনে জামাতিদের গালি দিক, তারা ন্যায়-অন্যায়টা ইতিহাস থেকে জানুক। তাহলেই তারা সত্যিকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। যারা যুদ্ধাপরাধিদের বিচার সোচ্চার, তারা পাহাড়ে গণতহ্যার প্রতিবাদেও সোচ্চার হবে, তারা সব অন্যায়ের সমান প্রতিবাদ করবে। দেশপ্রেমটা অন্তরে জন্ম নিক।

অন্যসব কিছুর মত “দেশপ্রেম”টাও হালের ফ্যাশনে পরিনত হয়ে পরিনত হয়ে গেলে এই দেশটার ডুকরে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। ৭. আমাদের ইতিহাসটা এতটাই চুরি যাওয়া যে একজন প্রধানমন্ত্রী ভরা মজলিসে দাড়িয়েও অকপটে ইতিহাস বিকৃত করে ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দিতে পারেন অনায়াসেই। কিছুদিন আগে ভাষা আন্দোলনটাও শেখ পরিবারের চুরির নজরে পড়েছে। ইতিহাসের এই অংশটায় শেখ সাহেবের তেমন নাম আসে না – এটা মেনে নিতে পারে না তার উত্তরাধীকারিরা। তাই হয়ত চুরির লিস্টে নতুন এই জিনিসটা যোগ করা।

শেখ মুজিব আমাদের ইতিহাসের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু তাই বলে বাঙালির ইতিহাসের সবই তার স্বপ্ন থেকে এসেছে – এমনটা নয়। দেশের ইতিহাসটা প্রতিদিন চুরি যাচ্ছে বলেই হয়ত দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে এমন ইতিহাস-চুরির সাহস দেখাতে পারেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আসা একটা ছেলে দেখলাম “ছাত্রলীগ” নিয়ে বেশ উৎসাহী, বুয়েটে আসার ৬/৭ সপ্তাহ না যেতেই রাজনীতি চিনে বসেছে। একদিন রুমে ডেকে কিছুক্ষণ গল্প করলাম, তারপর প্রশ্ন করলাম, তোমার রাজনৈতিক আদর্শ কে? অকপট উত্তর, “শেখ মুজিবুর রহমান।

” জানতে চাইলাম, মুজিবের জীবনাদর্শ, রাজনৈতিক আদর্শের উপরে কোন বই পড়েছ? সরল উত্তর : “না”। তাহলে সে তোমার আদর্শ হল কীভাবে? ছেলেটা আমার দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কী যে বলেন ভাই, শেখ মুজিবের আদর্শ জানতে বই পড়া লাগে !” আমি নিশ্চুপ, আমার কিছুই বলার নেই। ইতিহাস চুরির সুযোগটা যে আমরাই করে দিচ্ছি !!! ৮. মাত্র ত্রিশ/চল্লিশ বছরে আমাদের ইতিহাস বিকৃতির যে করূণ দশা, তাতে আগামী একশ বছর পরে এই ইতিহাসের কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান! আসলে আমাদের ইতিহসটাও “নোংরা রাজনীতি” আর “করপোরেট বেনিয়া”দের হাতে পড়েছে। প্রায় ন্যাংটা হয়ে যাওয়া এই ইতিহাস পুরোটা ন্যাংটা হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই দেশ, এই ইতিহাস বাঁচাতে হলে শিক্ষিত তরুনদের রাজনীতিতে আসতেই হবে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতেই হবে।

আমরা কি পারি না পরিবার থেকেই এই ইতিহাস-চর্চাটা শুরু করতে। আমরা কি পারি না আমাদের ইতিহাসের প্রতিটি কৃতি সন্তানকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে। আমাদের ইতিহাসটা অনেক সংগ্রামের, অনেক গর্বের। ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে বলেই আমাদের তরুনদের মাঝে আজ “দেশপ্রেম” হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ইতিহাসটাই হতে পারত আমাদের দেশ গড়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

আমরাই আমাদের ইতিহাসকে লালন করিনি। আমরাই আমাদের কৃতিসন্তানদের মূল্যায়ণ করিনি। অথচ এই দেশপ্রেমটা যাদের মাঝে ছিল, তারা দেশের মাটি ছেড়ে শত শত মাইল দূরে থেকেও দেশটাকে ভালবেসেছেন। তাইতো দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হয়েও কানডায় বসে আব্দুস সালাম আর রফিক কাজ করেছিলেন বাংলা ভাষাকে আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পাইয়ে দেয়ার জন্যে। কী অবাক কাণ্ড, কেউ যখন দূর পরবাসে বসেও স্বার্থহীনভাবে দেশের চিন্তুা করে, অন্য কেউ তখন দেশের মাটি দেশের ইতিহাস চুরির নেশায় মত্ত।

পার্থক্যটা এখানেই যে, পরবাসে থাকলেও তাদের দূজনের অন্তরেই ছিল দেশের গৌবজ্জল সংগ্রামী ইতিহাস; আর দেশের এই চোরদের মাঝে এই জিনিসটারই বড় অভাব। অথচ ৯৯ সালের পরে ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা শীর্ষক” কোন ইতিহাসে আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়নি এই দুই ভিন্নধারার ভাষা-সৈনিকের নাম!!! কলেজে থাকতে এক স্যার একবার বলেছিলেন, “নিজের মূলকে যারা ভুলে যায়, তারা কখনো বড় হতে পারে না। ” আমাদের হয়ত আজ সেই দশাই হচ্ছে। দিনে দিনে আমরা আমাদের শিকড়গুলো হারিয়ে ফেলছি। আর তাই হারিয়ে যাচ্ছে দেশপ্রেম … … আসুন না, পরিবার থেকেই ইতিহাস চর্চাটা শুরু করি।

দেশের কৃতি-সন্তানদের অবদান, সাহসিকতার গল্প বলে আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে উদ্বুদ্ধ করি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেই দেশপ্রেম … … … । পূর্বতন একটি আলোচনামূলক পোস্ট: আসুন নিজের সংস্কৃতিকে বলাৎকার করি ... ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.